মুসলিম বাঙালিদের পদবী সমূহ

বর্তমান যুগেও অনেক বাংলা ভাষী মুসলিম নামের শেষে পদবী যুক্ত করে থাকে।
পদবী বলতে বুঝায় কোন বংশ বা গোত্রকে। যা আরবরা ব্যবহার করে থাকে। যা তাদের পূর্ব যুগের কোন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম বা উপাধি বা লকব থেকে চালু হয়েছে।
যেমনঃ সাইয়্যেদ/হাশেমী, আলাভী, আউসী, খাজরাজী, উমাইয়া, তামীমী, আদী, ফারুকী, আলাভী, হাসান, কালবী, কাহতানী।
 
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার বাংলাতে প্রচলিত পদবীর অধিকাংশই আসলে কোন পদবী নয়। বরং মুঘল বা ইংরেজ আমলে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের উপাধিই পরবর্তী প্রজন্ম পদবী হিসেবে ব্যাবহার করছে। 

পেশা সংশ্লিষ্ট পদবী সমূহঃ চৌধুরী, তালুকদার, তরফদার, লস্কর, খন্দকার, কাজী, ব্যাপারী, সেকান্দার, মজুমদার, সওদাগর।
 
নিম্নে বিভিন্ন পদবী ও তাদের বর্ণনা দেয়া হল। 

বংশীয়ধর্মীয়শাসন/সম্পত্তিপেশাপেশাঅন্যান্যতুর্কি-পারস্য
সৈয়দখন্দকারমিঞামাওলানালস্করবারীবেগ
আলীশেখচৌধুরীমুফতীআকন্দ/আকনদহকখান
শেখশায়খতালুকদারকাজিব্যাপারীলোহানীমীর্জা
সিদ্দিকীফকিরশিকদারদেওয়ানচোকদারঢালীসেকান্দার
আনসারীমোল্লামজুমদারনিয়াজীসওদাগরবিশ্বাস 
ফারুকীমিয়াজীতরফদারখন্দকারসরকারসিনহা 
হাসানী
শাহচাকলাদারপাটোয়ারীহাজারী/হাজরামোড়ল 
হুসাইনীখাজাভুঁইয়ামণ্ডলপ্রামাণিকবকশ/বক্স 
 
চিশতীজমাদারবেপারীপ্রধান  
 ফরাজিমীরমল্লিকপোদ্দার  
   মাতুব্বরহাওলাদার  
   মুন্সি /মুন্সীসরদার  
   মুহুরীজোয়ার্দার  
   মৃধাদফাদার 

#সৈয়দ

'সৈয়দ' পদবী মূলত এসেছে নবী নন্দিনী ফাতেমা(রাঃ) ও আলী(রাঃ) বংশধর থেকে।

সৈয়দ বা স্যৈয়দ বা সাইয়্যেদ বা সায়্যিদ (আরবি: سيد‎‎; আরবি: سادة‎‎, Sādah) হল এমন একটি সম্মানসূচক উপাধি যদ্বারা নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা ও তার স্বামী আলী এবং তার সন্তান হযরত হাসান ও হোসাইনের বংশধারার

মুহাম্মদের বংশধরগণকে[১] চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এরা মূলত বনু "হাশিম" গোত্রেরই একটি শাখা যারা কিনা ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ (রাঃ) ও আলী ইবন আবি তালিব (রাঃ) এর বংশধর।

সৈয়দ হতে হলে পিতৃগোত্রজ হতে হবে এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। মাতৃগোত্রজ ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এ উপাধি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সৈয়দ বংশীয় নারীদের উপাধি হয়ে থাকে যথাক্রমে সৈয়দা বা আলাউইয়্যা বা শরীফা।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাসান ও হোসাইন উভয়ের বংশতালিকায় নবীর বংশধর বুঝাতে সৈয়দ এবং শরীফ উপাধিদ্বয় ব্যবহার করা হত। অন্যদিকে, পরবর্তী কালে হাসানি বংশ বুঝাতে পুরুষদের শরীফ ও নারীদের শরীফা এবং হোসাইনি

বংশীয় বুঝাতে যথাক্রমে সৈয়দ ও সৈয়দা উপাধিতে ভূষিত করার রেওয়াজ লক্ষ্য করা যায়[৩]

প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সাথে কোনা যোগসূত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবহার করেন। আবার ইরান থেকে আসা শীয়া প্রাভাবিত পুর্বেকার অনেক পরিবারও এ অঞ্চলে এসে

নিজেদের "সৈয়দ" হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবীর অপব্যবহার ও পক্ষেপণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ নন এবং পারিবারিক কোন কুলীন পদবীও নেই, অথবা পূর্ব পদবী ঐতিহ্য

পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক বংশ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষে বাংলাদেশে সৈয়দ পদবী আরোপিতভাবে ব্যবহার শুরু করেছে। প্রচুর বাঙালি মুসলমান রয়েছে যারা পূর্ব ঐতিহ্যগত ভাবে সৈয়দ নন, অথচ তাদের নামের পূর্বে পদবীর

পরিচয়বাহী সংক্ষিপ্ত শব্দ বা শব্দ গুচ্ছ যথা ‘এস-এম’ যুক্ত করে থাকেন। বস্তুত এস.এম হচ্ছে ‘সৈয়দ মোহাম্মদ’ অথচ ব্যবহারকারীরা অনেক সময়ই তা পুরোপুরি ভেঙে লেখেন না হয় তো ভয়ের কারণে।

#শেখ

শেখ বা শাইখ (আরবি: شيخ‎‎ šayḫ বহুবচনে شيوخ šuyūḫ) একটি সম্মানসূচক উচ্চ রাজকীয় পদবি। এটি সাধারণত গোত্রপতিদের ধনীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। গোত্রপতি তার পিতার পর এই পদবি প্রাপ্ত হন। বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর

বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের সাধারণ পদবি হিসেবে ও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে নারীদের ক্ষেত্রে “শাইখা” পদবি ব্যবহৃত হয়। তবে সবাই রাজবংশীয় যারা পদবিতে বহাল।

শেখ আরব থেকে আগতদের পদবী। সম্ভ্রান্ত মুসলমান বা সাহাবাদের বংশধরদের অনেকেই সম্মানসূচক এ বংশ পদবী 'শেখ' ব্যবহার করেন। অনেক অনারব কিন্তু সম্ভ্রান্ত পুড়াতন মুসলিম পরিবার গুলোও 'শেখ' পদবী ব্যাবহার করেন।

# সিদ্দিকি

আবু বকর রাঃ এর বংশধররা নিজেদের এই পদবী বা নামে পরিচয় দেয়।

# আলীঃ আলভী/আলাউই

সাধারনত শিয়া পরিবারগুলো পুর্বে নিজেদের নামের শেষে আলী যোগ করত। কিন্তু বর্তমানে শীয়া বা সুন্নি সকলেই এ পদবী ব্যবহার করেন।

আলাবি (আরবি: علاوي) বা "আলাভি" বা "আলভী" বা "আলাউয়াই" এর অর্থ "আলীর অনুসারী" এবং মুসলিম বিশেষ করে শিয়াদের একটি সাধারণ নাম।

# খান

মুলত আফগান ও পাঠান বংশীয় লোকের এ পদবী ব্যবহার করে। খান বা খাঁ একটি উপাধি যা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। উৎপত্তিগত ভাবে মঙ্গোলীয় ও তুর্কি ভাষায় এর অর্থ সেনানায়ক, নেতা বা শাসক। খান বলতে গোত্রপতিও বোঝায়। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় খানেরা টিকে আছে। খাতান, খাতুন এবং খানম হলো এর স্ত্রী বাচক রূপ। বেশিরভাগ আফগান, পাঠান বা পশতুন লোকদের নামের সাথে খান বিদ্যমান। মোঙ্গলরা “খান” নামটি আফগানিস্তানে নিয়ে এসেছিল, যা বর্তমানে ঐ অঞ্চলের সাধারণ লোকেরা ব্যবহার করছেন ।

#মীর

 মির বা মীর শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। আরবি শব্দ ‘আমীর’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে মীর। সেই অর্থে মীর অর্থ দলপতি বা নেতা, প্রধান ব্যক্তি, সরদার ইত্যাদি। জিতে নেয়া বা জয়ী হওয়া অর্থে মীর শব্দের ব্যবহার হতো। তবে মীর বংশীয় লোককে সম্ভ্রান্ত এবং শাসক শ্রেণীর বা নেতৃত্ব স্থানীয় বলে জ্ঞানীরা মনে করেন। মুঘল আমলে এই পদবীর ব্যপক ব্যবহার ছিল।

#মিঞা বা মিয়াজি

মিঞা মুসলিম উচ্চ পদস্থ সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রম সূচক শব্দ। এক অর্থে সকল মুসলমানের পদবীই হচ্ছে মিঞা। বাঙালি হিন্দুর ‘মহাশয়’ এর পরিবর্তে বাঙালি মুসলমান মিয়া শব্দ ব্যবহার

করে থাকে। ‘মিঞা’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। প্রভু বা প্রধান ব্যক্তি বুঝাতেও মিয়া শব্দের প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। *তবে গ্রামীন প্রধান বা সর্দার অর্থের মিঞা পদবী হিসেবে বাঙালি মুসলমান সমাজে ঠাঁই পেয়েছে।

#মোল্লা

 মোল্লা এবং মুন্সী বাঙালির দুটো জনপ্রিয় পদবী। তাদের প্রসার প্রায় দেশব্যাপী। বঙ্গীয় শব্দকোষ এ মোল্লা শব্দের অর্থ করা হয়েছে মুসলমান পুরোহিত। বস্তুত এভাবে মসজিদে নামাজ পরিচালনার কারণেও অনেকে মোল্লা উপাধি

পেয়েছিল এবং তার পর থেকেই মোল্লা পদবীর ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে, মোল্লা হচ্ছে তুর্কি ও আরবি ভাষার মোল্লা থেকে আগত একটি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট মহাপন্ডিত ব্যক্তি। অন্য অর্থে মুসলিম

পন্ডিত বা ব্যবস্থাপক বা অধ্যাপক হলেন মোল্লা। *পরবর্তী কালে মসজিদে নামাজ পরিচারলনাকারী মাত্রই মোল্লা নামে অভিহিত হতে থাকে। এখান থেকেই সাধারণত বংশ পদবী হিসেবে তা ব্যবস্থার হওয়া শুরু হয়। তাঁরা সকল জ্ঞানের

জ্ঞানী না হওয়া সত্ত্বেও মোল্লা পদবী ধারণ করে। যার ফলে ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’ প্রবাদের উৎপত্তি হয়েছে।

#ভূঁইয়া

ভূঁইয়া থেকে ভূঁইয়া বা ভূঁঞা। এই বংশ পদবীটি এসেছে খোদ ভূমির মালিকানা অর্থ থেকে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যে এ পদবীর প্রচলন আছে। বাঙালি হিন্দু সমাজে যাঁরাই ‘ভৌমিক’ বাঙালি মুসলমান সমাজে

তারা ‘ভূঁইয়া’ হিসেবে পদবী ধারণ করেছেন। মূল সংস্কৃত শব্দ ভৌমিক > (প্রাকৃত) ভূমিকা > (বাংলা) ভূঁইয়া > থেকে ভূঁইয়া বা ভূঁঞা এসেছে। প্রাচীন বড় জমিদার বা সামন্ত রাজার উপাধিও ছিল ভূঁইয়া। প্রকৃত পক্ষে কুলীন বংশ পদবীই

ছিল তা। আবার যে সব মানুষ আগে স্থান বিশেষে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি ও চাষাবাদের পত্তন করেছে তারা স্থানীয় জমিদার রাজার কাছ থেকে ভূঁইয়া নামে অভিহিত হয়ে ঐসব জমি জমার স্বত্ব লাভ করেছে।

#দেওয়ান

দেওয়ান (ফার্সীঃ ديوان) ফার্সী শব্দ। ফার্সী ভাষায় শব্দটির মূল অর্থ গ্রন্থ বা কাগজের বাঁধন, কর্মকর্তা এবং কার্যালয়। মোগল আমলে চাকলার অর্থসচিবদের এবং খাজনা আদায়কারীদের দেওয়ান বলা হতো। এটা অনেকটা চৌধুরী বা তালুকদার এর মত পদবী।

#চৌধুরী

 সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ। এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তগর্ত অঞ্চলের শাসক। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী হচ্ছে চৌধুরী।
আবার অনেকে মনে করেন ‘চৌথহারী’ যার অর্থ এক চতুথাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে ‘চৌধুরী’। সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার।

বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে,‘চতুর’ যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ, তার সাথে যুক্ত হয়েছে ‘ধর’ (অর্থ ধারক) এবং এই দুয়ে মিলে হয়েছে ‘চৌধরী’ > আর তার থেকেই ‘চৌধুরী’। তবে তা মূলত হিন্দী ও মারাঠি শব্দ। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে চৌধুরী বংশ

পদবী ব্যবহার করা হয় এদেশে। বৃটিশ-ভারতের প্রায় সর্বত্র এ পদবীর অস্তিত্ব ছিল। কারণ চৌধুরী ছিল সামন্ত রাজার পদবী।

#তালুকদার

আমাদের দেশে সুপরিচিত একটি বংশ পদবী। বাংলাদেশে চৌধুরী বা জমিদারির পরই তালুক ভূ-সামাপত্তির একটি বিভাগ। মোগল ও বৃটিশ আমলে রাজস্ব ও ভুমি সংক্রান্ত বিষয়াদি থেকে যে সমস্ত পদবীর উৎপত্তি ও বিস্তার তার মধ্যে ‘তালুকদার’ হচ্ছে একটি পদবী। আরবি শব্দ ‘তা’ আল্লুক’ যার অর্থ ভূ-সম্পত্তি এবং এর সাথে ফারসি ‘দার’ যুক্ত হয়ে (তা’আল্লুক+দার) ‘তালুকদার’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। যা ‘ক্ষুদ্র জমিদার’ বুঝায়। তিনি জমি ও ক্ষুদ্র ভূ-সম্পত্তি বন্দোবস্ত নিতেন সরকার ও জমিদারের কাছে থেকে।

সাধারণত কয়েকটি গ্রাম বা কয়েকটি পরগণা নিয়ে এক একটি তালুকের সৃষ্টি। তালুকি স্বত্ব এক প্রকার ইজারা স্বত্বের মতো। এই স্বত্ব বংশানুক্রমে বর্তমান থাকতো খাজনা বাকি না পড়া পর্যন্ত তালুকি  স্বত্ব বিনষ্ট হতোনা ।

#তরফদার

আরবি ‘তরফ’ এবং ফারসি ‘দার’ মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি। জমিদারের খাজনা আদায়ের মহালে তদারককারী কর্মচারী বা খাজনা আদায়কারীর উপাধী ছিল তরফদার। এই পদবী ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষরা এই কাজে

নিয়োজিত ছিলেন, সেখান থেকেই এই বংশ পদবী উৎপত্তি ও প্রচলন। অন্যমতে তরফদার তরফের রাজস্ব আদায়কারী লোক; গোমস্তা, দলের বা পক্ষের লোক। তরফের মালিক; পদবী বিশেষ।

#শিকদার

সুলতানি আমলে কয়েকটি মহাল নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিক। আরবি শিক হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ। এর সাথে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী

রাজকর্মচারী। শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী। এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করতো বলে শিকদার উপাধী পেয়েছিল; সেই থেকে বংশ পরমপরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে।

#খন্দকার

মুসলিম সমাজের ফারসি শিক্ষক হিসেবে খোন্দকার বা খন্দকারের পরিচয় পাওয়া যায় । অন্য দিকে খোন্দকারের ’ পদবী এসেছে সামন্ত সমাজ থেকে পেশাজীবী হিসেবে। সাধারণ ভাবে খোন্দকার বা খন্দকার অর্থ হচ্ছে কৃষক বা চাষাবাদকারী । মনে করা হয় ‘ফারসি‘কনদহ ’ এর যার অর্থ কৃষি’সাথে‘কার যুক্ত হয়ে কনদহকার> খনদহকার>খন্দকার হয়েছে। ভিন্ন মতে, খন্দকারের মূল উৎপত্তি সংস্কৃত কন্দ> খন্দ যার অর্থ ফসল বলা হয়েছে। এই খন্দ এর সাথে কার যুক্ত হয়েও খন্দকার> খোন্দকার হতে পারে। এবং এতেও পূর্বের ‘খন্দকার’ শব্দের উৎসের অর্থের তারতম্য ঘটছে না। আবার ফারসি ভাষায়, খোন্দকার বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ শিক্ষক। সেখান থেকেও খোন্দকার পদবী আসা বিচিত্র কিছু নয়। অথবা খোন্দকার শব্দের যে ভিন্নভিন্ন অর্থ তার সবগুলো মিলিত তাৎপর্য থেকেই বিভিন্নভাবে খন্দকার পদবীর উৎপত্তি হয়েছে।

#আখন্দ

 খন্দকার ও আখন্দ বা আকন সমার্থক। আখন্দ ও আকন নামে যে সব পদবী তাও সম্ভবত খন্দকার পদবীরই রূপভেদ। খন্দকার>আখন্দ> আকন হয়ে থাকতে পারে। আবার ফারসি আখুন্দ থেকেও আখন্দ এসে থাকতে পারে। যার অর্থ শিক্ষক। তবে আকন্দ এসেছে আখন্দ থেকেই।

#সরকার

‘সরকার’ শব্দটি ফারসি থেকে আগত। এর অর্থ প্রভূ, মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা। অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারি ও সরকার। মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারিদের এ পদবী দেয়া হতো। মোট কথা প্রধান

কর্মচারি এবং সম্পত্তি দেখাশুনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে সরকার বলা হতো। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যেই এ পদবীর ব্যবহার আছে।
মল্লিকঃ আরবি ‘মালিক’ বা ‘মলিক’ শব্দ থেকে এসেছে ‘মল্লিক’ বংশ পদবী। ফারসি মালিক শব্দজাত মল্লিক ভূম্যাধিকারী বা জোতদারের উপাধি। গ্রাম প্রধান বা সমাজের প্রধান ব্যক্তি মালিক। আবার লিপিকুশল রাজকর্মচারিকে মোগল

আমলে মল্লিক বা সুলেখক আখ্যা দেয়া হত বলেও আমরা জানতে পারি। হয়তোবা সেই থেকে মল্লিক বংশ পদবী এসেছে।

#মন্ডল

বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সমাজে সমান ভাবে ব্যবহৃত হয় মন্ডল পদবী। বাংলাদেশে অতীত কাল থেকে গ্রামের অনানুষ্ঠানিক এবং সাধারণ ভাবে সীকৃত গ্রাম- প্রধানকে বলা হয় মন্ডল। বাংলা মন্ডলরা আগে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি

ছিলেন। মন্ডলীয় কাজ করে তারা অনেক অধিকার ভোগ করতেন। খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা কিংবা গ্রামীন বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে মন্ডলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন। কোন কোন সময় তাদের অধীনে

পাটোয়ারি, তহসিলদার, চৌকিদার ইত্যাদি কর্মচারী কাজ করতেন। সরকার ও রায়তদের মধ্যবর্তী মানুুষ হিসেবে মন্ডলরা অধিক পরিচিত ছিল।

#ফকির

মুসলমানদের মধ্যে ‘সন্ন্যাসবৃত্তি’ থেকেই এসেছে ‘ফকির’ পদবী। মরমী সাধকরা গ্রহণ করতেন ‘ফকির’ পদবী। এটি আরবি শব্দ, যার মূল অর্থ নি:স্ব। আবার আরবি ফকর শব্দের অর্থ দারিদ্র। এ থেকে ফকির শব্দের উৎপত্তি। ফকির

এবং পার্শি দরবেশ ব্যক্তিগণ সাধারণত এদেশে ফকির নামে পরিচিত। বিশেষ কোন ধর্ম মতের একান্ত অনুসারী না হয়ে যারা সকল ধর্মের মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করেন তাদেরকেও ফকির বলা হয়। আবার সুফি বা বাউল তত্বের ধারকরাও ফকির।

#হাজারী / হাজরা

সহস্র সৈন্যের নায়ক বা সেনাপতি। বাংলাতে একে "হাজারী" বলে আর পাকিস্তান বা আফগানে একে "হাজরা" বলে। আফগান ও পাকিস্তানে "হাজরা" নামক একটি উপজাতিও আছে যারা কিনা মঙ্গল সেনাবাহিনীর একটি দলের (১,০০০ সৈন্যর) বংশধর। তবে এদের ধর্ম শিয়া।

#মজুমদার

‘মজুমদার’ পদবী মূল আসলে ‘মজুনদার’। এর মূল ফারসি শব্দ হচ্ছে ‘মজমু আনদার’। আজকের দিনে কালেকটরেট ভবনে যে জবপড়ৎফ শববঢ়বৎ রয়েছে, মোগল আমলে তারাই ছিল ‘মজুমদার। রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল

পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবী সংরক্ষিত ছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাংলাদেশে ‘মজুমদার’ পদবীর ব্যবহার লক্ষনীয়।

ঢালী

সৈনিক পরিবারের উপাধি। উপমহাদেশে 'ঢালী' একটি অত্যন্ত অভিজাত বংশ। তবে এ বংশ হিন্দু ও মুসলিম উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে দেখা যায়। তবে যতদূর জানা যায়,বহুকাল আগে ইরান থেকে এ ভারত উপমহাদেশে যুদ্ধের জন্য কোনো এক রাজার ফরমায়েশে কিছু সংখ্যক সৈন্য পাঠানো হয় যারা ঢাল তলোয়ারের যুদ্ধে ঢাল নিয়ে যুদ্ধ মোকাবিলা করতে পারদর্শী ছিলো। এরপর তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তখন থেকেই এ ঢালী পরিবারের জন্ম।

ঢালী সৈন্যঃ ঢালধারী পদাতিক সৈন্য। প্রয়োগ - "প্রতাপাদিত্যের পদাতিক সৈন্যগণ ঢালী সৈন্য নামে অভিহিত হইত।" -যশোহর-খুল্‌নার ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড।

#মৃধা


[মির্‌ধা, মির্‌দা, মৃধা] (বিশেষ্য)। অর্থ-১) দশজন গদাধারী পদাতিক সৈন্যের নেতা; জমিদারি ব্যবস্থায় পাইকদের(লাঠিয়াল বা বল্লমদারদের) সর্দার। অর্থ-১) বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের পদবি বিশেষ।
ফারসি মীরদা।

#ব্যাপারী

[ব্যাপারি] (বিশেষ্য) ব্যবসায়ী; বণিক; কারবারি; সওদাগর। ব্যবসায়ী পরিবারের পারিবারিক উপাধি। হিন্দু বণিক। 
(তৎসম বা সংস্কৃত) ব্যাপার+ইন্‌(ণিনি)।


#পাটোয়ারী

পাটোয়ারী শব্দের অর্থ হিসাব রক্ষক, অতি হিসাবী, কূটকৌশলী। সুলতানী ও মুঘল শাসন আমলে ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত কাগজ বা দলিল সংরক্ষনের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাকে পাটোয়ারী বলে ।  সরকারের এই কর্মকর্তারা রাজস্ব সংক্রান্ত অন্যান্য কাগজপত্র ছাড়াও গ্রামের প্রত্যেক কৃষক কতৃক জমাকৃত অর্থের হিসাবও সংরক্ষন করতেন।
একই ধাঁচের আরেকটা টাইটেল হলো তরফদার। যার অর্থ পক্ষপাতিত্ব করা।

#তরফদার

তরফদার (ফার্সি: طرف دار‎‎) আরবি এবং ফার্সি শব্দদ্বয়ের মিশ্রণ (طرف “তরফ” আরবি এবং دار “দার” ফার্সি শব্দ)। ফার্সি ভাষায় তরফদার অর্থ তরফের কর্তা।[১][২] সুলতানি, মোগল আমল এবং ব্রিটিশ আমলে জমিদারির আয়ত্বাধীন পরগনার অংশ বিশেষ ভূখণ্ডকে তরফ বলা হতো আর তরফের ভূস্বামীকে বলা হতো তরফদার। তরফদার বাংলাদেশ, ভারতে মুসলিম এবং হিন্দুদের পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

এটি তালুকদার পদের সমার্থক।

#মাঝি

  • নৌকা চালক  তাদের বংশধরদের মাঝি বলা হয়ে থাকে।
  • প্রভাবশালী সামুদ্রিক মাছ ব্যবসায়ীরা বংশ পরিক্রমায় এই উপাধিটি ব্যাবহার করে থাকে।
  • মাঝি একটি ভারতীয় হিন্দু উপাধি। এটি মূলত ভারতীয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে মহিষ্যা, চাষি কৈবর্ত, জলিয়া কাইবার্ত্ত, সাহানা বা উগ্রা ক্ষত্রিয় বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সুত্রঃ বাংলা উইকিপিডিয়া।

 

লেখকঃ আবু উবাইদা। obayda1757@gmail.com

সূত্র /References:

  1. https://en.wikipedia.org/wiki/Bengali_name
  2. bn.wikipedia.org/wiki/বাঙালি_মুসলিমদের_পদবিসমূহ
  3. https://m.facebook.com/539256209844727/posts/547880572315624/

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন