🌙 মহান ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ও হানাফী ফিকহ 📜
🕌 ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) (৮০ হিজরী - ১৫০ হিজরী) ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ ও ইমামদের একজন। তিনি ছিলেন হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট তাবেঈ। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল নু'মান ইবন সাবিত (রহঃ)। হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজে সম্মানিত।
📘 তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ:
✅ অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও ইসলামি পণ্ডিতগণের মতে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) নিজে কোনো গ্রন্থ রচনা করে যাননি। কেননা সে যুগে কিতাব বা হাদিস সংকলের চল তেমন ছিল না। বরং তারও ৫০-১০০ বছর পর তা চালু হয়েছে এবং ২০০-৩০০ হিজরি পর্যন্ত তা চালু ছিল।
তবে দুটি গ্রন্থকে তাঁর সাথে সংযুক্ত করা হয়:
১। ফিকহুল আকবার (الفقه الأكبر) –এটি ফিকহের কিতাব নয়। বরং আক্বীদাহ বিষয়ক একটি সংক্ষিপ্ত রচনা। আর জানা কথা সঠিক আকিদাই হল সর্বোত্তম ফিকহ। ✍️
২। মুসনাদে আবু হানীফা – এটি হাদিসের কিতাব নয়। বরং কিছু হাদীসের সংকলন যাতে সাহাবাদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে 📚
🔍 এসব গ্রন্থের যথার্থতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, পরবর্তী যুগে তাঁর শিষ্য ও অনুসারীগণ তাঁর মতামতসমূহকে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেছেন। যেমন তাঁর বিখ্যাত ছাত্র ছিলেন ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ), যিনি 'কিতাবুল খরাজ' প্রণয়ন করেন।
হানাফি মাজহাবের মূল কিতাব কি কি?
🌟 ইমাম মুহাম্মদ (রহঃ) ও তাঁর ছয় মূল গ্রন্থ 📚
🕌 ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ash-Shaibani (১৩২ হিঃ – ১৮৯ হিঃ) ছিলেন হানাফী মাযহাবের দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন বিখ্যাত ফকীহ ও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর প্রধান দুই শিষ্যের অন্যতম (অন্যজন ইমাম আবু ইউসুফ)। তিনি একাধারে মুজতাহিদ ও রাষ্ট্রীয় বিচারক ছিলেন।
তিনি হানাফী মতবাদের কিতাবীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর রচিত ছয়টি বিখ্যাত কিতাবকে বলা হয় “যাহিরুর রিওয়ায়াহ” (الظاهر الرواية)— অর্থাৎ হানাফী মাযহাবের মূল রেওয়ায়াতসমূহ। এই কিতাবগুলোই হানাফী ফিকহের মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয়।
📚 ছয়টি মূল কিতাব (الكتب الستة) যাদের 'যাহিরুর রিওয়ায়াহ' বলা হয়
কিতাবের নাম | বাংলা অর্থ | রচনার আনুমানিক সময় | বিষয়বস্তু |
---|---|---|---|
১. আল-মাবসূত (المبسوط) | বিশদ গ্রন্থ | ১৮০ হিঃ-এর দিকে | বিশদ ও বিস্তারিত মাসআলা আলোচনা, ইজতিহাদ ও তুলনামূলক মতামত |
২. আল-জামে’ আস-সগীর (الجامع الصغير) | ছোট সংকলন | ১৮০-১৮৫ হিঃ | সংক্ষিপ্ত মাসআলা সংকলন, সুসংহত ফর্মে |
৩. আল-জামে’ আল-কাবীর (الجامع الكبير) | বড় সংকলন | ১৮৫ হিঃ | ফিকহের নানা দিক, সুনির্দিষ্ট মাসআলা, হাদীসের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ |
৪. যিয়াদাত (الزيادات) | সংযোজন | ১৮৫ হিঃ | পূর্ববর্তী কিতাবের উপর বাড়তি মাসআলা সংযোজন |
৫. আস-সিয়ার আস-সগীর (السير الصغير) | ছোট আন্তর্জাতিক আইন | ১৭৯ হিঃ | যুদ্ধনীতি, কাফির রাষ্ট্র, মুজাহিদ ও বন্দির হুকুম |
৬. আস-সিয়ার আল-কাবীর (السير الكبير) | বড় আন্তর্জাতিক আইন | ১৮০ হিঃ | বিস্তৃত আন্তর্জাতিক ইসলামি আইন, কূটনীতি, যুদ্ধ ও চুক্তি |
📌 সংক্ষিপ্ত আলোচনা
- 🔖 এই ছয়টি কিতাবকেই হানাফী ফিকহের ‘মৌলিক সূত্র’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
- ✍️ ইমাম মুহাম্মদ এই কিতাবগুলোতে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম আবু ইউসুফের মতামত উল্লেখ করেন এবং কোথাও কোথাও নিজস্ব ইজতিহাদও তুলে ধরেন।
- 📜 বিশেষভাবে আল-মাবসূত একটি বিশাল এনসাইক্লোপেডিয়া যা হানাফী মাযহাবের মূল পদ্ধতির প্রকাশ।
🧠 ‘যাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বা ৬ কিতাব –এর গুরুত্ব
🔹 পরবর্তী হানাফী আলেমগণ এই ছয়টি কিতাবকে ভিত্তি ধরে ফতোয়া ও ফিকহ ব্যাখ্যা করেছেন।
🔹 আল-কাসানী, মারগীনানী, তাহতাবী, হাসকাফী প্রমুখ এই কিতাবগুলোকে হানাফী মাযহাবের মূল রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
📘 আল-কাফী ফি ফুরূঈল হানাফিয়্যাহ ঃ ৬ কিতাবের সংক্ষেপ
ইমাম মুহাম্মদের ৬ টি কিতাব বা যাহিরুর রিওয়ায়াহ এর সম্মিলিত রুপ 'আল-কাফী' (الكافي في فروع الحنفية)। যা আল-মাবসূত, জামে কাবীর ইত্যাদি কিতাবের সারাংশ ও সংক্ষিপ্ত রূপ।
✒️ রচয়িতা:
ইবনুল হুমাম (রহঃ) — পুরো নাম: কামাল উদ্দীন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল ওয়াহিদ ইবনুল হুমাম আল-হানাফী
-
জন্ম: ৭৯০ হিজরী, মৃত্যু: ৮৬১ হিজরী, দেশ: মিসর, মাযহাব: হানাফী।
📚 কিতাবের বিষয়বস্তু:
“আল-কাফী” একটি উচ্চমানের ফিকহী কিতাব, যেখানে হানাফী মাযহাবের ফুরূঈ (শাখাগত) মাসআলাগুলো বিস্তারিতভাবে সংকলিত হয়েছে।
🔹 এতে ইমাম মুহাম্মদ (রহঃ)-এর “যাহিরুর রিওয়ায়াহ” গ্রন্থসমূহের মূল বিষয়বস্তু গুছিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে।
🔹 কিতাবটি যুক্তিপূর্ণ ও দলিলভিত্তিক উপস্থাপনায় প্রসিদ্ধ।
🔹 এটি ইখতিলাফ (বিভিন্ন মতামত) সাপেক্ষে হানাফী মাজহাবের মুতাম্মাদ (প্রাধান্যপ্রাপ্ত) মতগুলো নির্ধারণ করে।
🛠️ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য:
✅ হানাফী ফিকহের বাছাইকৃত গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা এতে স্থান পেয়েছে।
✅ মাসআলাগুলোর মূল দলিল ও ব্যাখ্যা সংক্ষেপে দেয়া হয়েছে।
✅ সহজভাষায় নয়, বরং উচ্চ পর্যায়ের আলেমদের জন্য উপযোগী ভাষায় লেখা।
✅ মূলত এটি আল-মাবসূত, জামে কাবীর ইত্যাদি কিতাবের সারাংশ ও সংক্ষিপ্ত রূপ।
🧠 যারা হানাফী মাযহাবে গভীর গবেষণা করতে চান, তাদের জন্য “আল-কাফী” একটি মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।
📚 পরবর্তীকালে রচিত হানাফী ফিকহের মূল গ্রন্থসমূহ
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মৃত্যুর পর তাঁর মতামত ও ইজতিহাদসমূহ পরবর্তী আলেমরা সংকলন ও শ্রেণীবদ্ধ করেন। এর মধ্যে প্রধান প্রধান হানাফী ফিকহের গ্রন্থগুলো হলো:
গ্রন্থের নাম 📖 | রচয়িতা ✒️ | সংকলনকাল 🗓️ |
---|---|---|
কুদূরী | আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বাগদাদী | ৫ম শতাব্দী হিঃ |
হেদায়াহ | বুরহানুদ্দীন মারগীনানী | ৬ষ্ঠ শতাব্দী হিঃ |
কানযুদ দাকায়েক্ব | হাফেযুদ্দীন নাসাফী | ৮ম শতাব্দী হিঃ |
শরহ বেকায়াহ | ওবায়দুল্লাহ বিন মাসঊদ | ৮ম শতাব্দী হিঃ |
দুররে মুখতার | আলাউদ্দীন হাসকাফী | ১১শ শতাব্দী হিঃ |
ফাতাওয়া আলমগীরী | পাঁচ শত আলেম | ১১১৮ হিঃ |
মা লা বুদ্দা মিনহু | কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী | ১৩শ শতাব্দী হিঃ |
🕌 এ গ্রন্থগুলো উপমহাদেশে বিশেষভাবে প্রচলিত এবং আজও হানাফী মাযহাব চর্চায় ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
📘 অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
- বাদায়ে‘উস সানায়ে‘ – আলাউদ্দীন কাসানী (মৃঃ ৫৮৭ হিঃ)
- ই‘লাউস সুনান – যাফর ইবন আহমাদ ইবন লতীফ উছমানী (মৃঃ ১৩৯৪ হিঃ)
📌 তবে মনে রাখতে হবে, এই সব কিতাবসমূহ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর অনেক পরে রচিত, এবং তিনি সরাসরি এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।
⚠️ প্রাসঙ্গিক মন্তব্য
📚 হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ-তে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) হানাফী ফিকহের পরবর্তী রচনাগুলোকে ইমাম আবু হানীফার নামে সংযুক্ত করা সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করেছেন (১/১৬০)।
🌟 উপসংহার
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) ছিলেন এমন একজন ইমাম, যিনি যুক্তি, কুরআন, হাদীস, কিয়াস ও ইজমার মাধ্যমে ইসলামী আইন ব্যাখ্যায় বিপ্লব এনেছিলেন। তাঁর ফিকহের ভিত্তি ছিল গভীর চিন্তা ও যুক্তিনির্ভর ইজতিহাদ। যদিও তিনি সরাসরি অনেক কিতাব রচনা করেননি, তাঁর রেখে যাওয়া জ্ঞান আজো লাখো মুসলমানের জীবন ও সমাজে আলো ছড়াচ্ছে।