এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক (মে.জে. মইনুল হোসেন)

যেভাবে উথান হল মেজর জিয়ার-মেজর জেনারেল (অব:) মইনুল হোসেন

[মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বেড়ে ওঠা এবং অভ্যন্তরীণ নানা ঘটনাপ্রবাহের সাথে তিনি ছিলেন সংশ্লিষ্ট। সাতই নভেম্বরের ঘটনার সময় তিনি ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ তিনি দিয়েছেন তার বই এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক। সাতই নভেম্বরের সেই চিত্র আমরা তার লেখা বই থেকে কিছুটা সংক্ষেপে তুলে ধরছি]

শেখ মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ছিল দ্বিধাগ্রস্ত এবং দেশ প্রতিদিন অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এ দিকে খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় এসেই আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও আবদুস সামাদ আজাদকে আটক করেন এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখেন। বাতাসে প্রতিনিয়ত নানা গুজব উড়ছিল ও সাধারণ নাগরিকরা ভয়ভীতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। সেনানিবাসেও অস্থিরতা বিরাজ করছিল এবং ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে, নিজেদের মধ্যে যেকোনো সময়ে সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে আর্মিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি ছিল। পদাতিক বাহিনীর মধ্যে, বিশেষ করে ঢাকা ব্রিগেডের প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা মেজর ফারুক, রশিদ ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছিল এবং আর্মির চেইন অব কমান্ড পুনঃস্থাপনের জন্য তৎকালীন ব্রিগেড অধিনায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তার অধীনস্থ অফিসার ও সৈন্যরাই তার সার্বিক কর্তৃত্ব উপেক্ষা করে শেখ মুজিব হত্যায় জড়িত ছিল। এ পরিস্থিতিতে সেনাসদরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের অনিয়ম ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির কথা বলে উত্তেজিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। কেননা, তিনি নিজেও জেনারেল জিয়ার অধীনে তার অবস্থান সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। সামরিক বাহিনীর এই অস্থির অবস্থার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্নেল শাফায়াত জামিল ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াকে দায়ী করতেন। সেনাপ্রধান জিয়া ও সেনাবাহিনীর অন্য অফিসাররা যদিও এ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হননি। কেননা জিয়া এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে নিজের অবস্থান ঠিক রেখে আর্মির অধিনায়কত্ব করে চলছিল
জিয়ার বন্দিত্ব
এরই মধ্যে চলে এলো ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। আমি তখনো অসুস্থ এবং লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করি। বাসায় আমার স্ত্রী ও দুই মাসের কন্যাসন্তান। ভোর সাড়ে ৪টা হবে তখন হঠাৎ আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে এবং অন্য প্রান্ত থেকে একজন মহিলা বলে ওঠেন, ‘‘ভাই, এখানে কী হচ্ছে? অফিসার ও সৈনিকরা আমার বেডরুম থেকে ‘ওকে’ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’’ এ বলেই তিনি ফোন রেখে দেন। আমি ঘুমের ঘোরে পুরো ব্যাপারটি আঁচ করতে পারিনি এবং বুঝতেও পারিনি তিনি কী বলতে চাচ্ছেন। একপর্যায়ে ভাবলাম, হয়তো বেগম রওশন এরশাদ, যিনি একাকী আর্মি হেডকোয়ার্টারের অফিসার মেসের পাশে থাকতেন, তিনিই হয়তো টেলিফোন করে থাকবেন কোনো ভীতির কারণে। কেননা তখন পর্যন্ত মেজর জেনারেল এরশাদ সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে ছিলেন। ঠিক ওই মুহূর্তে আবার টেলিফোন বেজে ওঠে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো ‘ভাই, জিয়াকে বেডরুম থেকে ধরে নিয়ে ড্রইংরুমে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।’ আমি তৎক্ষণাৎ সম্বিৎ ফিরে পাই এবং অপর প্রান্তে বেগম খালেদা জিয়াকে বলি যে, ‘আমি আপনার বাড়িতে আসতে চেষ্টা করব।’ এ বলেই আমি ফোন রেখে দিলাম।

আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে সামরিক পোশাক পরে বাইরে আসি। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে আমি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের ১৫ জন বিশ্বস্ত নন-কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিককে আমার বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত করি। ১৯৬৪ সালে এই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলেই আমার সামরিক জীবনের শুরু। তারপর স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং পরও আমি এই দ্বিতীয় বেঙ্গলেরই অধিনায়ক ছিলাম। বাইরে এসে আমার গার্ড কমান্ডার হাবিলদার জাকিরকে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে সে আমাকে বিস্তারিত জানায়। হাবিলদার জাকির পুরো ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে। সেনাপ্রধানের বাড়ি পাহারায় নিযুক্ত ছিল প্রথম বেঙ্গলের সৈনিকরা। আর ওই ইউনিটেরই অফিসাররা তার বাড়িতে প্রবেশ করেছে। সেনাপ্রধান জিয়াকে বাড়ির ভেতরে বন্দী করে রাখা হয়েছে বলে জাকিরকে তার (জিয়ার) নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকজন জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সে আমাকে সেনাপ্রধানের বাড়িতে একাকী প্রবেশ করতে নিষেধ করে এবং প্রয়োজনে যেন তাদের নিয়েই প্রবেশ করি এমন অনুরোধ করে। আমি তাকে বলি, আমি একাই যাবো এবং তারা যেন আমার বাড়ির ছাদ ও অন্যান্য স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করে।

ভোরের আলো তখন ফুটছিল। আমি লাঠিতে ভর করে সেনাপ্রধানের বাড়িতে প্রবেশ করি। হাবিলদার জাকির আমার সাথে গেট পর্যন্ত এসে আমার বাড়িতে ফেরত যায়। আমি সেনাপ্রধানের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন তাজ (বর্তমানে আওয়ামী লীগের এমপি) স্টেনগান হাতে পাঁয়চারি করছে। আমাকে দেখে সে সেখান থেকে সরে যায়। বাড়ির গেটে তালা ঝুলানো ছিল এবং প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের একজন জেসিও দাঁড়িয়ে ছিল। এ ছাড়া সেনাপ্রধানের এডিসি ক্যাপ্টেন জিল্লুর (পরে ব্রিগেডিয়ার অব:) বেসামরিক পোশাক পরে বাইরের গার্ডরুমে বসে আছে। উল্লেখ্য, ক্যাপ্টেন তাজ, ওই জেসিও এবং ক্যাপ্টেন জিল্লুরÑ তারা সবাই আমার অধীনে ছিল। এ ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমি তাদের ব্রিগেড অধিনায়ক ছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে তারা সবাই আমাকে চেনে। আমি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে জেসিওকে গেট খুলতে আদেশ করি। সাথে সাথে সে গার্ডরুম থেকে চাবি এনে গেট খুলে দেয়। আমি বাড়িতে প্রবেশ করি এবং ঘরে ঢুকেই দেখি বাম দিকে সেনাপ্রধানের বসার ঘরে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ (বর্তমানে ব্যবসায়ী) খুব সতর্কভাবে স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে জেনারেল জিয়া ইউনিফর্ম পরে স্থির হয়ে সোফায় বসা। আমাকে বাসার ভেতরে দেখে হাফিজউল্লাহ আঁৎকে ওঠে এবং জেনারেল জিয়াও হতভম্ব হয়ে যান। আমি কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে জিয়ার শোবার ঘরে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি খালেদা জিয়া তার দুই ছেলে পিনো (তারেক) ও কোকোকে (আরাফাত) নিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে তিনি অবাক হন। ফোন করলেও তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, এ রকম পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি হয়তো তার বাড়িতে যাবো না। যা হোক আমি তাকে ছেলেদের স্কুলে পাঠানোর জন্য রেডি করতে অনুরোধ করি এবং বেডরুম থেকে চলে আসি। আমার উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমেই জিয়ার দুই ছেলেকে বাড়ি থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দেয়া। আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, প্রহরীরা আমার এই কাজে বাধা দেয় কি না তা যাচাই করা।

ড্রইংরুমে এসে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাকে একইভাবে দেখি এবং রাগান্বিত স্বরে বলি সে যেন ড্রইংরুম থেকে সরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমার আদেশ অনুযায়ী সে ড্রইংরুম থেকে চলে যায়। এরপর আমি জেনারেল জিয়ার পাশে গিয়ে বসি। জেনারেল জিয়া আমার কাছে জানতে চাইলেন, কর্নেল শাফায়াত জামিল কোথায়? আমি কথা বলতে চাই। আমি তাকে বলি, কর্নেল শাফায়াত জামিলের আদেশেই তিনি এখন বন্দী এবং তার সাথে কথা বলে কী লাভ হবে। আমি প্রায় মিনিট দশেক তার সাথে আলাপ করি। এ পরিস্থিতিতে তাকে ধৈর্য ধরে এখানে থাকার জন্য বলি।
তিনি কর্নেল শাফায়াতকে ডেকে আনতে বললেন। আমি তাকে বললাম, আমি তো পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানি না। আপনার স্ত্রীর ফোন পেয়ে আমি সোজা আপনার বাসায় চলে এসেছি। তবে বাসায় ঢোকার সময় যা দেখলাম তাতে মনে হলো, কর্নেল শাফায়াতের ব্রিগেডের (৪৬ ব্রিগেড) অফিসার ও সৈন্যরা আপনাকে গৃহবন্দী করেছে। আপনি নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন।

তিনি আমার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন যার অর্থ হলো, এ পরিস্থিতিতে আমি কিভাবে তার বাড়িতে ঢুকলাম। আমি তাকে বললাম, আপনার ছেলেদের বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি। তিনি বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ সময় খালেদা জিয়া তার ছেলেদের নিয়ে ডাইনিংরুমে আসেন। আমি তাদের নাশতা করতে বললাম এবং নাশতা শেষ হলে ড্রাইভারকে ডেকে তাদের স্কুলে নিয়ে যেতে বললাম। এ সময় আমাকে কেউ কোনো বাধা দেয়নি।

জিয়া আমাকে বললেন, তুমি কি একা এসেছ? আমি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ। যদিও তিনি বেশ শান্ত ও ধীরস্থির ছিলেন, তবু তার বাড়িতে আমার তৎপরতা দেখে তিনি বিস্মিত হন। এরপর আমি বাইরে চলে আসি। এ সময় জিয়াকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়েছিল।

ঘরের বাইরে এসে দেখি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেখানে এসে উপস্থিত। সম্ভবত ক্যাপ্টেন তাজ আমাকে সেনাপ্রধানের বাড়িতে অনায়াসে প্রবেশ করতে দেখেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন। তিনি প্রথমে আমার পায়ের ক্ষত এবং অসুস্থতার খোঁজখবর নেন। তারপর বলেন, চেইন অব কমান্ড ঠিক করার জন্য এই অভ্যুত্থান জরুরি ছিল। আকাশে তখন মিগ ও হেলিকপ্টার উড়ছিল এবং সে দিকে তাকিয়ে খালেদ মোশাররফ আমাকে বললেন, চেইন অব কমান্ড ঠিক না করলে দেশ ও সেনাবাহিনী শেষ হয়ে যাবে, তাই এ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছি। আমি তখন উল্টো প্রশ্ন করলাম, চেইন অব কমান্ড ভেঙে সেনাপ্রধানকে বন্দী করে কি চেইন অব কমান্ড ঠিক করা যায়? তিনি উত্তরে কিছুই বললেন না।
আমরা দু’জনেই সেনাসদরে পিএসও (প্রধান উপদেষ্টা) তিনি সিজিএস আর আমি এজি। খালেদ মোশাররফ আমার এক র‌্যাংক সিনিয়র হলেও অ্যাপয়েন্টমেন্টের (পিএসও) দিক থেকে দু’জনেই একই পর্যায়ের। জেসিও ও অন্য সৈনিকরা সেনাপ্রধান জিয়ার বাড়ির ভেতরে আমার কার্যকলাপে কোনো বাধা না দেয়ায় তিনি চিন্তিত ছিলেন, যদিও তাদের ওপর নির্দেশ ছিল কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে অথবা বাড়ি থেকে বাইরে যেতে না দেয়ার। কিন্তু তারা নির্বিবাদে আমার আদেশ পালন করেছে। এতে একটি বিষয় আমার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সেনাপ্রধানের বাড়িতে নিয়োজিত এসব সৈনিক মনেপ্রাণে সেনাপ্রধানকে বন্দী করার পক্ষে ছিল না।

আমি সেনাপ্রধানের বাড়ি থেকে ধীরে ধীরে হেঁটে আমার নিজের বাড়িতে ফিরে আসি। এসে দেখি আমার বাড়ির সামরিক ও বেসামরিক টেলিফোন দুটোরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এ হাঁটাচলায় আমার পায়ের ক্ষতে ব্যথা হচ্ছিল। একজন প্রহরীকে পাঠিয়ে গাড়ি আনি। প্রহরীরা আমাকে জানায়, তারা খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে যে, অভ্যুত্থানকারীরা আমার বাড়ির সন্নিকটে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সমবেত হয়েছেন। আমি নাশতা সেরে ওদিকে রওনা দিলাম। প্রহরীদের সতর্ক থাকতে বললাম। আমার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় প্রহরীরা উত্তেজিত ছিল। তাদের আমি সান্ত্বনা দিই। আমার ভয় ছিল তারা যেকোনো সময়ে যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। কারণ তারাও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত ছিল।

চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলে অভ্যুত্থানকারীদের তৎপরতা

আমি সেখানে গিয়ে দেখি, চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেনাসদরের ও ৪৬ ব্রিগেডের বেশ কয়েকজন অফিসার বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে। তারা আলোচনায় রত। আমি পৌঁছার সাথে সাথে লে. কর্নেল মালেক (পরে ঢাকার মেয়র এবং জাতীয় পার্টি হয়ে বর্তমানে আওয়ামী লীগার) আমার কাছে এসে বললেন, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাকে বলেছেন আমাকে জানানোর জন্য যে, আজ ভোরে সেনাপ্রধান জিয়ার সাথে আমার যা যা আলাপ হয়েছে তা যেন কাউকে না বলি। আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলি, তিনি যেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে অবহিত করেন, আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কোনো আদেশ বা উপদেশ নিতে প্রস্তুত নই। তাকে আরো বললাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এখনো সেনাপ্রধান নন। আর যদি হয়েও থাকেন তাও আমার জানা নেই। এর একটু পরেই আমি চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসে অনাহূতের মতো প্রবেশ করি। সেখানে ব্রেগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ, মেজর গাফফার ও অন্যান্য অফিসার যারা এ অভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের বিভিন্ন আলাপচারিতায় দেখি। আমি একটি চেয়ার নিয়ে নিজেও বসে পড়ি। তখন সেখানে নানাবিধ আলোচনা চলছিল। বিভিন্ন স্থানে টেলিফোন করা হচ্ছে এবং সবাই উত্তেজিত।

কিছুক্ষণ পর বঙ্গভবন থেকে মেজর শরীফুল হক (ডালিম), মেজর নূর দু’জন এসে উপস্থিত হলো। তাদের উপস্থিতি দেখে আমি অবাক হলাম। পরে বুঝতে পারলাম, তারা মেজর রশিদ-ফারুকের বার্তা নিয়ে এখানে এসেছে দু’পক্ষের মধ্যে এ বিরোধের একটা সন্তোষজনক মীমাংসার জন্য, যাতে করে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো যায়। আলোচনায় বুঝতে পারলাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিল মেজর ফারুক, রশিদ ও তাদের সহযোগীদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ চায়। এ বার্তা নিয়ে মেজর নূর ও শরীফুল হক (ডালিম) বঙ্গভবনে রওয়ানা হয়। তাদের বলা হয়েছে, এই বার্তা রাষ্ট্রপতি মোশতাক, মেজর রশিদ ও ফারুককে দেয়ার জন্য এবং এর উত্তর স্বত্বর যেন দেয়া হয়। তারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। এরই মধ্যে জেনারেল ওসমানী বঙ্গভবন থেকে ফোন করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সাথে কথা বলেন। তিনি হুঁশিয়ার করে দেন যেন কেউ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়। কারণ এ পরিস্থিতিতে দেশে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তাকে উত্তরে জানান, যদিও তিনি বর্তমানে সেনাপ্রধান নন তবুও একটা মীমাংসার চেষ্টা করবেন। তিনি মেজর ফারুক-রশিদকে বুঝিয়ে আত্মসমর্পণ করানোর জন্য ওসমানীকে অনুরোধ করেন।

এর মধ্যে নানারকম হইচই হচ্ছিল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হলো মেজর জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করানো হবে এবং জেনারেল ওসমানী ও রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে জানানো হবে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে যেন সত্বর সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার কাছ থেকে ইস্তফাপত্র নেয়ার জন্য কে সেখানে যাবেন তা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছিল এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছিলেন না। এসব দেখে আমার বেশ কৌতূহল হলো। কারণ এসব আলোচনায় অভ্যুত্থানকারীরা বেশ সময় নষ্ট করছেন। এ থেকে বোঝা যায়, এ অভ্যুত্থানের কোনো বিশেষ পরিকল্পনা তাদের ছিল না এবং নেতৃত্বের সমস্যা ছিল। তাদের উদ্দেশ্য তাদের কাছেই পরিষ্কার ছিল না।

জিয়ার ইস্তফা আদায়

শেষ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার রউফ (যিনি ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ডিজিএফআই প্রধান ছিলেন এবং বর্তমানে মরহুম) ও লে. কর্নেল আনোয়ার (পরে মেজর জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমলে ডিজি, এনএসআই এবং রাষ্ট্রদূত অব:) এ দু’জনকে তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিয়ার বাড়িতে পাঠানো হলো ইস্তফাপত্রে স্বাক্ষর আনার জন্য। তারা সেনাপ্রধান জিয়ার বাড়িতে যান এবং ইস্তফাপত্রে স্বাক্ষর নিতে সক্ষম হন। এ দিকে অনেক আলোচনার পর ঠিক করা হয়, মেজর রফিদ-ফারুকসহ অন্য যারা ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল তারা রাতের বেলায় একটি বিশেষ বিমানযোগে তৃতীয় দেশের উদ্দেশে ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগ করবে।

আর্মি হেডকোয়ার্টারে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে আলাপ-আলোচনায় বুঝতে পারলাম জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার, নন-কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিকরা সেনাপ্রধান জিয়াকে বন্দী করার ঘোর বিরোধী ও মনঃক্ষুণ। এ অভ্যুত্থানে তাদের মোটেও সায় নেই। আমি দুপুরের দিকে বাড়িতে ফিরি। পথিমধ্যে কর্নেল শাফায়াতের সাথে দেখা। আমি তাকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, এ অভ্যুত্থানে কি বিভিন্ন পদবির সৈনিকদের সমর্থন আছে? উত্তরে তিনি হ্যাঁসূচক জবাব দেন। আমি আর কিছু না বলে বাড়িতে চলে গেলাম।

খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান

এ দিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জেনারেল জিয়ার ইস্তফার কারণে নতুন সেনাপ্রধান হলেন। তিনি রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হুদাকে (আগরতলা মামলার আসামি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন) এবং কর্নেল নওয়াজীশের অধীন ১০ ইস্ট বেঙ্গল যা তার অধীনে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে গঠিত হয়েছিল তাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। কর্নেল হুদাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল সম্ভবত আমার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য। কারণ আমি এসব অনাকাক্সিক্ষত উচ্ছৃঙ্খল ঘটনার বিরোধিতা করে আসছি। তাই খালেদ মোশাররফ আমার কার্যকলাপে বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন।

এ দিকে ৪ তারিখ সকালবেলা খবরে জানা যায়, ৩ তারিখ রাতেই জেলে আটককৃত নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান এ চার নেতাকে রাষ্ট্রপতি মোশতাক, মেজর রশিদ ও ফারুকের আদেশে জেলের ভেতরেই নৃশংসভাবে প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের ক’জন সৈনিক হত্যা করে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জেলখানায় সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের খবর ৩০ ঘণ্টা পর বাইরের লোকজনের কাছে প্রকাশ পায়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক ও ফারুক-রশিদরা যখন ৩ তারিখের অভ্যুত্থানের খবর পায় এবং তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দেয় তখনই তাদের ধারণা জন্মে যে, এ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেলে আটককৃত চার নেতাকে বের করে এনে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে সরিয়ে নতুন সরকার গঠনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলখানায় ওই জঘন্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ও শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি ঘটে।

বিচারপতি সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি

এ দিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চার নেতাকে জেলখানায় বন্দী অবস্থায় হত্যার পর ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রপতি মোশতাক এ ঘটনা চেপে রাখেন যতক্ষণ মেজর ফারুক-রশিদ ও তাদের সহযোগীরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশত্যাগ না করেন। ফলে যখন এ ঘটনা প্রকাশ পায়, তখন জনগণ ও আর্মি এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রপতি মোশতাক ও মেজর ফারুক-রশিদকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করে। তাই এ ঘটনার পর খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ফলে অভ্যুত্থানকারী অফিসাররা প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধের প্রেক্ষাপটে তিনি ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমিও আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলাম।

৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান

রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েমের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে আমি তাড়াতাড়ি আর্মি হেডকোয়ার্টারে চলে আসি। সেখানে এসে আমি আমার অধীনস্থ অফিসারদের সাথে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। বস্তুতপক্ষে ৩ থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কোনো সরকার ছিল না বললেই চলে। আর্মিতেও দৈনন্দিন কোনো কাজকর্ম চলছিল না। আর্মি হেডকোয়ার্টারে অচলাবস্থা বিরাজ করছিল। পুরো সেনানিবাসের পরিবেশ ছিল অস্বাভাবিক ও থমথমে। কেউ কোনো কাজকর্ম করছিল না। সবাই এখানে-সেখানে জটলা পাকিয়ে আলাপ-আলোচনা করেই সময় কাটায়। আলোচনা শেষে অফিস থেকে সবাই চলে যাওয়ার পর আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সহকারী সুবেদার আলিমুদ্দিন আমাকে একটা বাংলা প্রচারপত্র দেখান। ওই প্রচারপত্র সেনানিবাসে প্রচুর পরিমাণে বিলি করা হয়েছে বলেও আমাকে জানান। প্রচারপত্রটি ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র নামে ছাপানো হয় এবং উত্তেজক ভাষায় বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হয়। উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে ছিল, সেনাবাহিনীতে কোনো অফিসার থাকবে না। কেননা অফিসাররা সৈনিকদের তাদের নিজ ক্ষমতালাভের প্রয়াসে ব্যবহার করে। এ ছাড়া অফিসারদের জন্য ‘ব্যাটমেন’ প্রথা বন্ধ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রচারপত্রটি অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা বিলি করছে বলে আমাকে জানানো হয়।

জিয়ার মুক্তি

বিকেলে আমি বাসায় ফিরে আসি। শারীরিক দুর্বলতা ও ক্লান্তিবশত আমি আর বাড়ি থেকে বের হইনি। হঠাৎ মধ্যরাতের পর চার দিকে গোলাগুলির আওয়াজ শুনি। গোলাগুলি প্রথমে শুরু হয় বর্তমান এয়ারপোর্ট রোডের পাশে অবস্থিত অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে, এরপর গ্যারিসন মসজিদের পাশে অবস্থিত সিগন্যাল ইউনিট থেকে। আমি উঠে ইউনিফর্ম পরি এবং বাইরে যেতে চাইলে আমার গার্ডরা আমাকে রাতের অন্ধকারে গোলাগুলির মধ্যে বাইরে যেতে নিষেধ করে এবং বাসাতেই থাকতে অনুরোধ করে। এর মধ্যে হঠাৎ করে আমার বাসার টেলিফোন বেজে ওঠে যা গত কয়েক দিন যাবৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। সিগন্যাল সেন্টার থেকে ফোন করে আমাকে জানানো হয়, খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান আরম্ভ হয়েছে। এরপর আমি বাড়ির বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম কিছু কালো পোশাক, কিছু খাকি এবং বেসামরিক পোশাকে সজ্জিত শ’খানেকের মতো লোক ওপরের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে জেনারেল জিয়ার বাড়িতে ঢুকছে। জিয়াকে তার বাড়ির বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে পাশেই দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে নিয়ে যেতেও দেখলাম। জিয়া তখন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত ছিলেন।

একটু পর আবার আমার টেলিফোন বেজে ওঠে। এবার চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও লে. কর্নেল আমিনুল হক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার) আমাকে জানান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে। ৩ নভেম্বরের ক্যুর পর আমিনুল হককে চতুর্থ বেঙ্গলের অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে নিয়ে আর্মি হেডকোয়ার্টারে অ্যাটাচ করা হয়। এ দিকে অভ্যুত্থানের গতি-প্রকৃতি ভালোভাবে বুঝতে পারছিলাম না। কোথায় কী ঘটছে তাও জানা সম্ভব না। ভোরবেলায় বাড়িতে তিন/চারজন লোক প্রবেশ করতে চেষ্টা করে। প্রহরীরা তাদের গেটে বাধা দেয়। তারা বলেন, জিয়ার বাড়িসংলগ্ন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে আমাকে যাওয়ার জন্য জেনারেল জিয়া খবর পাঠিয়েছেন। এরপর বেসামরিক পোশাকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট মুনীর (মরহুম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের জামাতা, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল) আমার বাসায় আসে। সে আমাকে বিস্তারিত তথ্য জানায় এবং আমাকে বলে, জিয়া সত্বর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে যাওয়ার জন্য বলেছেন। সে আরো জানায়, ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলীকে নিয়ে আসার জন্য আর্মি ভিআইপি রুমেও লোক পাঠানো হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার শওকত যশোর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সম্প্রতি যে সভা আহ্বান করেছিলেন তাতে অংশ নেয়ার জন্য। পরে শুনেছি মীর শওকত যে ভিআইপি রুমে ছিলেন সেখানেও সৈনিকরা গুলি চালায়। তিনি সেখান থেকে বের হয়ে পাশেই তৎকালীন মেজর জেনারেল এরশাদের বাসায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে মেজর মহিউদ্দীন (মুজিব হত্যায় দণ্ডপ্রাপ্ত) তাকে নিয়ে আসে।

রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য তাহেরের অনুরোধ

আমি ইউনিফর্ম পরে লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে পৌঁছি। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ছিল আমার ও জিয়ার বাসা থেকে শ’দুয়েক গজ দূরে, বর্তমান শহীদ সরণির পাশে। সেখানে গিয়ে দেখি হুলস্থুল অবস্থা। অফিসের ছোট একটি কামরায় জিয়া বসে ছিলেন। কর্নেল আমিনুল হক ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের সুবেদার মেজর আনিস ও কয়েকজন অফিসার সেখানে ছিলেন। একটু পরে একটি বেসামরিক জিপে করে দুই-তিনজন লোকসহ অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল তাহের সেখানে এসে উপস্থিত হন। লে. কর্নেল তাহের মঞ্জুর ও জিয়াউদ্দিনের সাথে আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়ার অধীনে যোগদান করেন। পরে তিনি সেক্টর কমান্ডার হন এবং একপর্যায়ে যুদ্ধে আহত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন আর্মিতে ছিলেন এবং অবসর নেয়ার পর ওই সময় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থায় চাকরি করতেন। এসেই তিনি জিয়াকে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আমরা জিয়াকে রেডিও স্টেশনে যেতে বারণ করি। এ সময় লে. কর্নেল আমিনুল হক ও তাহেরের সাথে ঝগড়া বেধে যায়। একপর্যায়ে আমিনুল হক তাহেরকে বলে বসেন, ‘আপনারা (জাসদ) তো ভারতের বিটিম’। ফলে তাহের রাগান্বিত হয়ে সেখান থেকে চলে যান।

অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ

দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি থেকে বেরিয়ে জেনারেল জিয়া, আমি এবং ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আর্মি হেডকোয়ার্টারে যাই। আর্মি হেডকোয়ার্টারে আলাপ-আলোচনায় ঠিক করা হয়, অভ্যুত্থানকারীদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বক্তব্য রাখবেন। তবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেনাপ্রধান বক্তব্য রাখার আগে অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ পর্যায়ে সেনাপ্রধান এবং ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আমাকে বললেন, যেহেতু আমি অনেক দিন থেকে ঢাকায় আছি এবং ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলাম এবং বর্তমানে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল সেহেতু এ দায়িত্ব আমাকে দেয়া হচ্ছে তাদের সংগঠিত করার কাজে। তাদের সংগঠিত করার ব্যাপারে আমার মধ্যে অনেক সংশয় ও অনিশ্চয়তা ছিল। কারণ তারা হয়তো অনেক দাবি উত্থাপন করবে এবং তাদের বুঝিয়ে শান্ত করা কষ্টকর হবে।

যাহোক, আমি দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি, আর্মি এমপি ইউনিট ও আর্মি হেডকোয়ার্টারের সুবেদার মেজরদের খবর দিলাম যে, অপরাহ্নে সেনা মিলনায়তনে (বর্তমান গ্যারিসন সিনেমা হল) আমি সৈনিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে বক্তব্য রাখব। সে অনুযায়ী বিভিন্ন ইউনিটের জেসিও এবং এনসিওসহ তাদের প্রতিনিধিদের সেনা মিলনায়তনে উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা করতে বলি। তবে তখন বেশির ভাগ অফিসার সিপাহিদের অভ্যুত্থানের কারণে আর্মি হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত ছিলেন না। পরে মিলিটারি পুলিশ ইউনিটের ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক (বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত) যিনি একজন উদ্যোগী ও কর্তব্যপরায়ণ অফিসার, তাকে নিয়ে আমি সেনা মিলনায়তনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি কিছু সৈন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মিলনায়তনে উপস্থিত হয়েছে। আমি তাদের অস্ত্র বাইরে রেখে আসতে নির্দেশ দিই। এই নির্দেশের মাধ্যমে আমি মূলত তাদের পরীক্ষা করছিলাম যে, তারা আমার কথা আদৌ শুনবে কি না। জিয়া আমাকে সেখানে পাঠিয়েছেন তাদের মানসিক অবস্থা যাচাই ও শান্ত করার জন্য, যাতে পরে তিনি এসে বক্তৃতা দিতে পারেন। যাহোক, তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাইরে রেখে আসার পর আমি আমার বক্তব্য শুরু করি।

বিপ্লবীরা তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে। আমি তাদের জানাই, আর্মি শৃঙ্খলা, নিয়মকানুন ইত্যাদি তড়িঘড়ি করে বদলানো সম্ভব নয়। আমি আরো বলি, উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য দেশ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। যাহোক, আলোচনা শেষে আমি তাদের জানাই, কিছুক্ষণ পর সেনাপ্রধান জিয়া এসে তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, ৭ নভেম্বর সৈনিকদের সাথে বেসামরিক প্রশাসনের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কিছু সরকারি কর্মচারীও যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। তারাও বেসামরিক প্রশাসনে তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছিল। ফলে কিছু কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক তাদের সাথে সেনানিবাসের বাইরে চলেও গিয়েছিল। কিন্তু সেনানিবাসের পরিস্থিতি আয়ত্তে আসায় পরে বাইরে তারা আর তেমন কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা করার সাহস পায়নি। আজও ভাবলে গা শিউরে ওঠে যে, ঢাকা সেনানিবাসের সৈনিকদের যদি সেদিন নিয়ন্ত্রণে আনা না যেত তাহলে সারা দেশে সামরিক-বেসামরিক পর্যায়ে একটা ‘নেতৃত্বহীন ভয়াবহ উচ্ছৃঙ্খল শ্রেণী-সংগ্রাম’ শুরু হয়ে যেত। সৈনিকদের সে দিনের স্লোগানই ছিল ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই। সিপাহি জনতা ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’।

যাহোক, আর্মি হেডকোয়ার্টারে আমি খবর পাঠানোর পর জেনারেল জিয়া এসে উপস্থিত হন। তখনো পরিস্থিতি কিছুটা অশান্ত ছিল। জিয়া তাদের শান্ত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে তার কোমরের আর্মি বেল্ট খুলে মাটিতে ছুড়ে দেন এবং বলেন, এত দাবিদাওয়া ওঠালে আমি আর এ আর্মি চিফ থাকতে চাই না। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। বক্তৃতা শেষে আমরা সবাই আর্মির হেডকোয়ার্টারে ফেরত যাই। এরপর ঠিক করা হয়, ঢাকার বাইরে থেকে কিছু পদাতিক সৈন্য এনে ঢাকা সেনানিবাসে উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যদের আয়ত্তে আনা ও সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সে অনুযায়ী যশোর থেকে কিছু পদাতিক সৈন্য এনে বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তার কাজে মোতায়েন করা হয়।

৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে আর্টিলারি, ল্যান্সার, আর্মার, সিগন্যাল, অর্ডন্যান্স ও সাপ্লাই কোরের বেশির ভাগ সৈনিক জড়িত ছিল। ঢাকায় অবস্থিত পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা এ অভ্যুত্থানে তেমন সাড়া দেয়নি। আবার প্রতিরোধও করেনি। এর কারণ ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল জামিল ঢাকা ব্রিগেডের পদাতিক বাহিনীকে ব্যবহার করেন। কিন্তু সে অভ্যুত্থানে সৈনিকদের তেমন সমর্থন ছিল না। শুধু আদেশের কারণে বাধ্য হয়ে হয়তো তারা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিল যা আমি আগেও বর্ণনা করেছি। এখানে আরেকটি কথা বলতে হয়, অভ্যুত্থানের পরপরই রেডিওতে জিয়ার একটি রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করা হয়। এ ছাড়া তিনি কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে সাহসের সাথে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন