Header Ads Widget

Hadi24.com - আপনার হারনো বা প্রাপ্তির সংবাদ -জানান বা জানুন
BDData.org - বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংবাদ ও তথ্য

ইসলাম থেকে যারা বেরিয়ে গেছে - প্রথম যুগ

লেখক- আবু মারিয়াম।

প্রকাশ- ২১ নভেম্বর ২০২৫

প্রকাশক- হাদি২৪.কম


ইসলামের থেকে বেরা হয়ে যাওয়া প্রাথম যুগের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়সমূহ: জাবরিয়া, কাদরিয়া, খারেজি, মুতাজিলা, রাফেজি, কারামতি,  ইসমাইলি ও নুসাইরি।

ইসলামের ইতিহাসের প্রথম কয়েক শতাব্দী ছিল ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের এক উর্বর ভূমি। খিলাফতের উত্তরাধিকার, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বনাম আল্লাহর নিয়তি, পাপের সংজ্ঞা এবং মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব—এইসব মৌলিক প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দল ও মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল। এই সম্প্রদায়গুলো শুধু ধর্মতাত্ত্বিক ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবও ছিল সুদূরপ্রসারী। নিচে জাবরিয়া, কাদরিয়া, খারেজি, মুতাজিলা, রাফেজি ও কারামতি—এই প্রধান সম্প্রদায়গুলোর পরিচিতি ও তাদের মূল বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

১. জাবরিয়া (Jabbariyya)

  • উৎপত্তি ও অর্থ: "জাবরিয়া" শব্দটি আরবি "জাবর" (جبر) থেকে এসেছে, যার অর্থ বাধ্যবাধকতা বা জবরদস্তি। এই মতবাদটি বিশ্বাস করত যে মানুষ তার কর্মে সম্পূর্ণরূপে বাধ্য এবং তার কোনো স্বাধীন ইচ্ছা নেই। মানুষের সমস্ত ক্রিয়া-কলাপ আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত এবং মানুষের তাতে কোনো ভূমিকা নেই।

  • মূল বিশ্বাস:

    • পূর্বনির্ধারণবাদ (Predeterminism): জাবরিয়াদের মতে, মানুষের সমস্ত ভালো-মন্দ কাজ, বিশ্বাস এবং এমনকি চিন্তাভাবনা আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্পূর্ণরূপে নির্ধারিত। মানুষ শুধু সেই নির্ধারিত পথে চলতে বাধ্য একটি যন্ত্রের মতো।

    • স্বাধীন ইচ্ছার অভাব: তারা মানুষের জন্য কোনো স্বাধীন ইচ্ছার অস্তিত্ব অস্বীকার করত। তাদের যুক্তি ছিল, যদি মানুষ স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী হতো, তবে তা আল্লাহর সর্বশক্তিমানতার সাথে সাংঘর্ষিক হতো।

    • দায়বদ্ধতার প্রশ্ন: এই মতবাদ অনুসারে, যেহেতু মানুষ তার কাজের জন্য দায়ী নয়, তাই পরকালে পুরস্কার ও শাস্তির ধারণার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে জাবরিয়ারা সাধারণত স্বীকার করত যে আল্লাহ মানুষের ইচ্ছার সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি তার জ্ঞান অনুযায়ী বিচার করবেন, যদিও মানুষ নিজের ইচ্ছায় কিছু করে না।

  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: উমাইয়া খিলাফতের শেষ দিকে এবং আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম দিকে এই মতবাদের উদ্ভব হয়। অনেক সময় রাজনৈতিক শাসকরা তাদের অত্যাচারী শাসনকে আল্লাহর ইচ্ছার ফল হিসেবে দেখাতে এই মতবাদকে ব্যবহার করত।

  • প্রধান প্রবক্তা: জাহম ইবনে সাফওয়ানকে (মৃত্যু ৭৪৫ খ্রি.) জাবরিয়া মতবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয়। এই কারণে এই মতবাদকে "জাহমিয়া" নামেও অভিহিত করা হয়।

  • প্রভাব ও পরিণতি: জাবরিয়া মতবাদটি সুন্নি ইসলামে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছিল কারণ এটি আল্লাহর ন্যায়বিচার ও মানুষের নৈতিক দায়বদ্ধতার ধারণাকে দুর্বল করে দেয় বলে মনে করা হতো। পরবর্তীতে এই মতবাদ স্বতন্ত্রভাবে টিকে থাকেনি, তবে নিয়তি সম্পর্কিত আলোচনায় এর প্রভাব দেখা যায়।

২. কাদরিয়া (Qadariyya)

  • উৎপত্তি ও অর্থ: "কাদরিয়া" শব্দটি আরবি "ক্বদর" (قدر) থেকে এসেছে, যার অর্থ ক্ষমতা, শক্তি, বা ঐশ্বরিক ফয়সালা। এই মতবাদটি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা এবং তার কর্মের জন্য দায়বদ্ধতার উপর জোর দিত।

  • মূল বিশ্বাস:

    • স্বাধীন ইচ্ছা (Free Will): কাদরিয়ারা বিশ্বাস করত যে মানুষ তার কর্মের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তার ভালো-মন্দ কাজের জন্য সে নিজেই দায়ী। আল্লাহ মানুষকে কাজ করার ক্ষমতা ও ইচ্ছা দিয়েছেন, এবং সেই ইচ্ছার প্রয়োগ মানুষ নিজেই করে।

    • আল্লাহর জ্ঞান বনাম মানুষের কর্ম: তারা মনে করত যে আল্লাহ সবকিছু জানেন (আল্লাহর সর্বজ্ঞতা), কিন্তু তাঁর জ্ঞান মানুষের ইচ্ছাকে পূর্বনির্ধারিত করে না। আল্লাহ জানেন মানুষ কী করবে, কিন্তু এই জ্ঞান মানুষকে কাজটি করতে বাধ্য করে না।

    • মানুষের দায়বদ্ধতা: যেহেতু মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী, তাই সে তার প্রতিটি কর্মের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তি তার নিজস্ব নির্বাচনের ফল।

  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরাকের বসরায় এই মতবাদের উদ্ভব হয়। উমাইয়া শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতা এবং জুলুমকে "আল্লাহর ফয়সালা" বলে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয়। কাদরিয়ারা শাসকদের অন্যায় কাজের জন্য তাদেরকেই দায়ী করত।

  • প্রধান প্রবক্তা: মা'বাদ আল-জুহানি এবং গায়লান আল-দিমাশকিকে এই মতবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

  • প্রভাব ও পরিণতি: কাদরিয়া মতবাদ পরবর্তীতে মু'তাজিলা মতবাদকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। মু'তাজিলারাও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাসী ছিল এবং যুক্তি, ন্যায়বিচার ও একত্ববাদের উপর গুরুত্বারোপ করত। সুন্নি আলেমদের সমালোচনার কারণে এটি স্বতন্ত্রভাবে টিকে থাকেনি, তবে এর মূল ধারণাগুলো পরবর্তী ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৩. খারেজি (Khawarij)

  • উৎপত্তি ও অর্থ: "খারেজি" শব্দটি আরবি "খারাজা" (خرج) থেকে এসেছে, যার অর্থ বেরিয়ে যাওয়া বা বিদ্রোহ করা। ইসলামের ইতিহাসে এই দলটি প্রথম দিকে আলী (রা.) এবং মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে সিফফিনের সালিশি প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছিল এবং উভয় পক্ষকেই কাফির ঘোষণা করেছিল।

  • মূল বিশ্বাস:

    • উচ্চ নৈতিকতা ও কঠোরতা: খারেজিরা ইসলামের আক্ষরিক ও কঠোর ব্যাখ্যার জন্য পরিচিত ছিল। তারা মনে করত, একটি ছোট পাপও মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় (কাফির করে)।

    • পাপীর কুফর: তাদের সবচেয়ে বিতর্কিত ধারণা ছিল যে, কোনো মুসলিম যদি বড় পাপ (কাবিরা গুনাহ) করে, তবে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায় এবং কাফির হয়ে যায়। এ ধরনের কাফিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েজ বলে তারা মনে করত।

    • নেতৃত্বের প্রশ্ন: তাদের মতে, মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব (খিলাফত) এমন যে কোনো সৎ, যোগ্য ও ধার্মিক মুসলিমের জন্য উন্মুক্ত, তা সে যে গোত্রেরই হোক না কেন। ইমাম বা খলিফা যদি অন্যায় করে বা পথচ্যুত হয়, তবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা বৈধ।

    • তাকফির (Takfir): তারা খুব সহজে অন্য মুসলমানদের কাফির ঘোষণা করত, বিশেষ করে যারা তাদের মতবাদের সাথে একমত ছিল না।

  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.)-এর শাহাদাত এবং আলী (রা.)-এর খিলাফতকালে রাজনৈতিক কোন্দলের মধ্যে এদের উদ্ভব। সিফফিনের যুদ্ধের পর আলী (রা.) যখন মুয়াবিয়া (রা.)-এর প্রস্তাবিত সালিশি মেনে নেন, তখন একদল সৈনিক এর বিরোধিতা করে আলী (রা.)-এর দল থেকে বেরিয়ে যায় এবং "খারেজি" নামে পরিচিত হয়।

  • প্রভাব ও পরিণতি: খারেজিরা ইসলামের ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ ও সহিংসতার জন্য পরিচিত। তারা তাদের বিরোধী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধা করত না। যদিও মূলধারার সুন্নি ও শিয়া ইসলামে তাদের কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়, তাদের কিছু কট্টরপন্থা ও তাকফিরের প্রবণতার প্রভাব পরবর্তীতে কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা গেছে। সময়ের সাথে সাথে তারা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের প্রভাব হ্রাস পায়।

৪. মু'তাজিলা (Mu'tazila)

  • উৎপত্তি ও অর্থ: "মু'তাজিলা" শব্দটি আরবি "ই'তাজালা" (اعتزل) থেকে এসেছে, যার অর্থ আলাদা হওয়া বা সরে যাওয়া। অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে ওয়াসিল ইবনে আতা (মৃত্যু ৭৪৮ খ্রি.) তার শিক্ষক হাসান আল-বসরীর (মৃত্যু ৭২৮ খ্রি.) মজলিস থেকে "বড় পাপকারী মুসলিমের অবস্থান" নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে আলাদা হয়ে যান।
  • মূল বিশ্বাস (পঞ্চনীতি বা উসুল আল-খামসা): মু'তাজিলাদের ধর্মতত্ত্ব ৫টি মূল নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল:
    • তাওহীদ (আল্লাহর একত্ব): তারা আল্লাহর গুণাবলীকে আল্লাহর সত্তা থেকে পৃথক মনে করত না। তাদের মতে, আল্লাহর গুণাবলী যদি তার সত্তা থেকে পৃথক হয়, তবে তা একাধিক আদি সত্তার ধারণার জন্ম দেবে, যা তাওহীদের পরিপন্থী। তাই তারা কুরআনকে সৃষ্ট (খলক আল-কুরআন) বলে মনে করত, যাতে আল্লাহর কালামকে আল্লাহর সত্তার অংশ না বলা হয়।
  • আদল (আল্লাহর ন্যায়বিচার): তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে আল্লাহ সম্পূর্ণরূপে ন্যায়পরায়ণ। এই কারণে তারা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাস করত (কাদরিয়াদের মতো), কারণ তাদের মতে, যদি মানুষ তার কর্মে স্বাধীন না হয়, তবে পুরস্কার ও শাস্তি আল্লাহর ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হবে।
  • আল-মানযিলা বাইনাল মানযিলাতাইন (দুই অবস্থানের মধ্যবর্তী অবস্থান): এই নীতিটি ওয়াসিল ইবনে আতার মূল মতবাদ ছিল। তাদের মতে, যে ব্যক্তি বড় পাপ করে, সে পুরোপুরি কাফিরও নয় আবার পুরোপুরি মু'মিনও নয়, বরং সে "ফাসিক" (পাপী)। তার অবস্থান ঈমান ও কুফরের মধ্যবর্তী।
  • আল-ওয়া'দ ওয়াল-ওয়া'ইদ (প্রতিশ্রুতি ও হুমকি): তারা বিশ্বাস করত যে আল্লাহ ভালো কাজের জন্য পুরস্কারের এবং মন্দ কাজের জন্য শাস্তির যে প্রতিশ্রুতি (ওয়া'দ) ও হুমকি (ওয়া'ইদ) দিয়েছেন, তা তিনি অবশ্যই পূর্ণ করবেন। তাই একজন পাপী মুসলিম যদি তওবা না করে মারা যায়, তবে সে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে।
  • আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার (সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ): এই নীতিতে তারা অত্যন্ত সক্রিয় ছিল এবং এটিকে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ন্যায্যতা প্রমাণ করতেও ব্যবহার করত, যদি সরকার ইসলাম বিরোধী কাজ করে বলে তারা মনে করত।
  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: আব্বাসীয় খিলাফতের প্রথম দিকে (মামুনের শাসনামল) মু'তাজিলা মতবাদ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল এবং ইসলামী দর্শনে এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিল। তারা যুক্তি ও গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

  • প্রভাব ও পরিণতি: মু'তাজিলারা মুসলিম বিশ্বের যুক্তি ও দর্শনের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে তাদের "খলক আল-কুরআন" (কুরআন সৃষ্ট) মতবাদ এবং অন্যান্য কিছু কঠোর ব্যাখ্যার কারণে তারা ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়, বিশেষ করে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের মতো আলেমদের কাছ থেকে। পরবর্তীতে মু'তাজিলাদের প্রভাব হ্রাস পায় এবং সুন্নি ধর্মতত্ত্ব (আশ'আরী ও মাতুরিদী) প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

৫. রাফেজি (Rafidah/Rafizi)

  • উৎপত্তি ও অর্থ: "রাফেজি" শব্দটি "রাফাদা" (رفض) থেকে এসেছে, যার অর্থ প্রত্যাখ্যান করা বা পরিত্যাগ করা। এই শব্দটি শিয়াদের একটি অংশকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যারা জায়েদ ইবনে আলী ইবনে হুসাইন-এর ইমামত প্রত্যাখ্যান করেছিল, কারণ তিনি প্রথম দুই খলিফা আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-কে বৈধ শাসক হিসেবে মেনে নিতে রাজি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই শব্দটি সাধারণভাবে সেই শিয়াদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে যারা প্রথম তিন খলিফাকে (আবু বকর, উমর, উসমান) এবং তাদের খিলাফতকে অস্বীকার করে।
  • মূল বিশ্বাস:

    • ইমামতের ধারণা: রাফেজিরা বিশ্বাস করে যে নেতৃত্ব (ইমামত) আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এবং এটি শুধুমাত্র নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশধরদের (আহলে বাইত) মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের মতে, আলী (রা.) ছিলেন নবীজির (সা.) প্রত্যক্ষ ও মনোনীত উত্তরাধিকারী এবং তিনিই প্রথম বৈধ ইমাম।
    • আবু বকর, উমর ও উসমানের অবৈধতা: তারা প্রথম তিন খলিফার খিলাফতকে অবৈধ বলে মনে করে এবং দাবি করে যে তারা আলী (রা.)-এর ন্যায্য অধিকার হরণ করেছেন। এই কারণে তাদের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করা হয়।
    • তাবাররা (Tabarra): রাফেজিদের মধ্যে 'তাবাররা' নামক একটি বিশ্বাস প্রচলিত, যার অর্থ হল নবীর (সা.) শত্রু এবং আহলে বাইতের উপর অত্যাচারকারীদের প্রতি ঘৃণা ও সম্পর্কচ্ছেদ। এর মধ্যে প্রথম তিন খলিফাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন।
    • মাসুম (নিষ্পাপ) ইমাম: তারা তাদের ইমামদেরকে নিষ্পাপ (মাসুম) বলে বিশ্বাস করে এবং মনে করে যে ইমামরা ভুল বা পাপ থেকে মুক্ত।
  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: কারবালার ঘটনার পর এবং বিশেষ করে জায়েদ ইবনে আলীর বিদ্রোহের সময় শিয়াদের মধ্যে বিভাজন থেকে এই গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। যারা জায়েদের মতবাদ (যাকে জায়েদিয়া শিয়া বলা হয়) প্রত্যাখ্যান করে, তারাই রাফেজি নামে পরিচিতি লাভ করে।

  • প্রভাব ও পরিণতি: রাফেজিরা মূলত আধুনিক ইসনা আশারিয়া (দ্বাদশ ইমামি) শিয়াদের পূর্বসূরী বা একটি অংশ। তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি প্রভাবশালী ধারা তৈরি করেছে, বিশেষ করে ইরান, ইরাক, লেবানন এবং অন্যান্য শিয়া-প্রধান অঞ্চলে। সুন্নি আলেমদের দ্বারা তাদের এই বিশ্বাসগুলোর জন্য তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে, বিশেষ করে সাহাবায়ে কেরামের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির জন্য।

  • যাইদি শিয়াঃ ইয়ামানি শিয়াদের অনেকেই আহলে সুন্নাহর অনেক নিকটবর্তী। যদিও এরা এখন রাফেজি ইরানের প্রভাবে অনেক মুসলিম বিরোধী হয়ে গেছে। তবু তাদের শিকড় হকের দিকেই বা নিকটবর্তী।

৬. কারামতি (Qarmatians/Carmathians)

  • উৎপত্তি ও অর্থ: "কারামতি" বা "কারমেশিয়ান" হলো ইসমাইলি শিয়া ইসলামের একটি শাখা যা নবম শতাব্দীর শেষ দিকে ইরাকে হামদান কারমাত নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে উদ্ভব হয়েছিল। এটি একটি রহস্যময় এবং বিপ্লবী ধর্মীয়-রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল।

  • মূল বিশ্বাস:

    • ইসমাইলি শিয়া ধারণা: কারামতিরা ইসমাইলি শিয়াদের বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত ছিল, যারা মনে করত যে ইসমাইল ইবনে জাফর আস-সাদিক (যাকে ইমাম জাফর আস-সাদিকের পুত্র) ছিলেন সপ্তম এবং শেষ ইমাম।

    • ব্যাতেনী (Esoteric) ব্যাখ্যা: তারা কুরআনের ব্যাতেনী বা গুপ্ত ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী ছিল, যার অর্থ হলো শরীয়তের আক্ষরিক অর্থ নয়, বরং এর অভ্যন্তরীণ ও প্রতীকী অর্থ গুরুত্বপূর্ণ।

    • সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতা: কারামতিরা সমাজে গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে চেয়েছিল। তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ, সম্পদের সুষম বণ্টন এবং একটি সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখত। এটি ছিল একটি বিপ্লবী আন্দোলন যা সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত অংশকে আকর্ষণ করেছিল।

    • গুপ্ত সংগঠন ও সামরিক শক্তি: তারা একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত, গুপ্ত সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি ছিল। তাদের একটি নিজস্ব শাসনব্যবস্থা ছিল এবং তারা ব্যাপক সামরিক অভিযান পরিচালনা করত।

  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: নবম ও দশম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খিলাফতের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এবং সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদে কারামতি আন্দোলন মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

  • উল্লেখযোগ্য ঘটনা:

    • বাহরাইন রাষ্ট্র: কারামতিরা নবম শতাব্দীর শেষ দিকে বাহরাইনে একটি শক্তিশালী স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, যা ১৭৫ বছর ধরে টিকে ছিল।

    • মক্কা আক্রমণ: সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা ছিল ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তাদের মক্কা আক্রমণ। তারা পবিত্র কাবা লুট করে এবং হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) নিয়ে বাহরাইনে চলে যায়, যা ২২ বছর তাদের দখলে ছিল। এই ঘটনা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়।

  • প্রভাব ও পরিণতি: কারামতি আন্দোলন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাদের চরমপন্থী কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক বিপ্লবের চেষ্টা তৎকালীন মুসলিম সমাজের রীতিনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সময়ের সাথে সাথে তাদের প্রভাব হ্রাস পায়, বিশেষ করে বাহরাইনের কারামতি রাষ্ট্র একাদশ শতাব্দীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর। তবে তাদের কিছু ধারণা এবং গুপ্ত সংগঠনের পদ্ধতি পরবর্তীকালে কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা গেছে।

৭. ইসমাইলি শিয়া (Isma'ili Shia)

ইসমাইলি শিয়া হলো ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিয়া সম্প্রদায়, যা ইসনা আশারিয়া (দ্বাদশ ইমামি) শিয়াদের পরেই অবস্থান করে। তাদের নাম এসেছে ইমাম জাফর আস-সাদিকের পুত্র ইসমাইল ইবনে জাফর (মৃত্যু ৭৬২ খ্রি.) থেকে। ইসমাইলিরা বিশ্বাস করে যে ইসমাইল ছিলেন ইমাম জাফর আস-সাদিকের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এবং পরবর্তী ইমাম।

মূল বিশ্বাস ও ধর্মতত্ত্ব:

  • ইমামত: ইসমাইলিদের ধর্মতত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো ইমামতের ধারণা। তারা বিশ্বাস করে যে আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত একজন ইমাম সর্বদাই পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকেন, যিনি আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক উভয় ক্ষেত্রেই উম্মাহর পথপ্রদর্শক। এই ইমামগণ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশধর এবং তারা নিষ্পাপ (মাসুম)।

  • সপ্তম ইমামের গুরুত্ব: ইসনা আশারিয়াদের থেকে তাদের প্রধান পার্থক্য হলো ইমামদের ধারাবাহিকতা নিয়ে। ইসনা আশারিয়ারা ইমাম মুসা আল-কাজিমকে সপ্তম ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে, যেখানে ইসমাইলিরা ইসমাইল ইবনে জাফরকে সপ্তম ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাদের জন্য ইসমাইলই ছিলেন শেষ 'প্রাপ্য' ইমাম, যার পরে ইমামত তার বংশধরদের মধ্যে চলতে থাকে।

  • গুপ্ত ও প্রকাশ্য ইমামত (Imamate of Concealment and Manifestation): ইসমাইলি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো 'ইমামত আল-সাতর' (Imamate of Concealment) বা গুপ্ত ইমামত। কিছু সময়ের জন্য, তাদের ইমামরা জনসমক্ষে প্রকাশ না পেয়ে আত্মগোপনে থাকতেন এবং তাদের দাওয়া (প্রচার) গোপনে পরিচালিত হতো।

  • বা-তেন (Batin) এবং জাহির (Zahir): ইসমাইলিরা কুরআনের ব্যাতেনী (গুপ্ত, অভ্যন্তরীণ) এবং জাহিরী (প্রকাশ্য, আক্ষরিক) উভয় অর্থের উপর জোর দেয়। তাদের মতে, জাহিরী শরীয়ত বা আক্ষরিক অর্থ শুধু একটি বাহ্যিক আবরণ মাত্র, এবং প্রকৃত জ্ঞান নিহিত আছে ব্যাতেনী অর্থে, যা শুধুমাত্র ইমামের মাধ্যমেই উপলব্ধ।

  • চক্রের ধারণা (Cycles of Prophecy and Imamate): তারা নবুওয়াত এবং ইমামতের চক্রাকার ধারণায় বিশ্বাস করে। তাদের মতে, আল্লাহ প্রেরিত নবীরা একটি নতুন শরীয়ত (জাহির) নিয়ে আসেন, এবং তাদের পরে ইমামরা সেই শরীয়তের বাতেনী অর্থ প্রকাশ করেন।

  • দাওয়াহ (Da'wah): ইসমাইলিদের একটি সুসংগঠিত দাওয়াহ বা ধর্মপ্রচার পদ্ধতি ছিল, যা অত্যন্ত গোপনীয় ছিল এবং বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত ছিল। এর মাধ্যমে তারা অনুসারীদের ধর্মতত্ত্বের গভীরে নিয়ে যেত।

  • নবীদের ধারাবাহিকতা: তারা আদম, নূহ, ইব্রাহিম, মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ (সা.)-কে 'নাতিক' (বাচনকারী নবী) হিসেবে গ্রহণ করে, যারা নতুন শরীয়ত এনেছেন। প্রতিটি নাতিকের একজন 'সামিত' (নীরব) বা 'আসাস' (ভিত্তি) থাকে, যিনি নতুন নবীর পূর্বেকার নবীর স্থলাভিষিক্ত ইমাম, যিনি বাতেনী অর্থ প্রকাশ করেন।

ঐতিহাসিক বিকাশ ও শাখা:

ইসমাইলিরা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছে এবং বেশ কয়েকটি শক্তিশালী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে।

  • ফাতেমীয় খিলাফত (909-1171 খ্রি.): এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে একমাত্র ইসমাইলি শিয়া খিলাফত, যা উত্তর আফ্রিকা, মিশর এবং সিরিয়ার অংশবিশেষ শাসন করেছিল। কায়রো শহর তাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

  • কারামতি (Qarmatians): ইসমাইলিদের একটি চরমপন্থী শাখা, যারা নবম শতাব্দীতে বাহরাইনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা আক্রমণ করে হাজরে আসওয়াদ লুট করেছিল।

  • নিজারি ইসমাইলি (Nizari Isma'ili): এটি বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম ইসমাইলি শাখা। তাদের বর্তমান ইমাম হলেন আগা খান চতুর্থ (শাহ করিম আল-হুসাইনি)। নিজারি ইসমাইলিরা তাদের বর্তমান ইমামকে 'হাযির ইমাম' (বর্তমান ইমাম) হিসেবে বিশ্বাস করে এবং তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ইমামের ধারাবাহিকতা কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।

  • মোস্তাফিজী/তাইয়েবি ইসমাইলি (Musta'li/Tayyibi Isma'ili): ফাতেমীয় খিলাফতের পতনের পর ইমামতের উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদের কারণে মোস্তাফিজী ইসমাইলিরা নিজারিদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। এই শাখার মধ্যে ভারতের বোহরা সম্প্রদায় (দাউদী বোহরা, সুলায়মানী বোহরা ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত। তাদের ইমামরা 'সাতর' বা গুপ্ত অবস্থায় আছেন বলে তারা বিশ্বাস করে এবং তাদের 'দা'য়ী আল-মুতলাক' (সর্বোচ্চ ধর্মপ্রচারক) ইমামের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।

প্রভাব:

ইসমাইলিরা ইসলামী দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা এবং চিকিৎসাশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তাদের ফাতেমীয় খিলাফত একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল এবং কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে ইসমাইলি কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।


৮. নুসাইরি শিয়া / আলাউইট (Nusayri Shia / Alawites)

নুসাইরি শিয়া, যা সাধারণত আলাউইট (Alawites) নামে পরিচিত, হলো একটি গুহ্য (Esoteric) শিয়া সম্প্রদায় যা মূলত সিরিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের বিশ্বাস ইসনা আশারিয়া বা ইসমাইলি শিয়াদের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন এবং এর মধ্যে খ্রিস্টান ও প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্মের কিছু প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। এই সম্প্রদায়ের ধর্মতত্ত্ব অত্যন্ত গোপনীয় এবং সাধারণত অ-সদস্যদের কাছে প্রকাশ করা হয় না।

নামকরণ:

  • নুসাইরি: এই নামটি এসেছে ইবন নুসাইর (মৃত্যু আনু. ৯৫০ খ্রি.) থেকে, যিনি এই সম্প্রদায়ের প্রারম্ভিক প্রবক্তাদের একজন ছিলেন।

  • আলাউইট: "আলাউইট" নামটি আলী ইবনে আবি তালিবের প্রতি তাদের ভক্তি নির্দেশ করে। আধুনিক সিরিয়ায় রাজনৈতিক কারণে এই নামটি বেশি ব্যবহৃত হয়।

মূল বিশ্বাস ও ধর্মতত্ত্ব:

নুসাইরিদের বিশ্বাস অত্যন্ত জটিল এবং বিভিন্ন উপাদান দ্বারা গঠিত। তাদের কিছু মূল ধারণা হলো:

  • ঐশ্বরিক ত্রিত্ব (Divine Trinity): তাদের সবচেয়ে বিতর্কিত বিশ্বাস হলো একটি ত্রিত্বের ধারণা, যা 'আইন-মিম-সীন' (ع-م-س) নামে পরিচিত।

    • আইন ('Ayn): এটি আলীর প্রতীক, যাকে তারা ঈশ্বরের প্রকাশ বা অবতার মনে করে।

    • মিম (Mim): এটি মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতীক, যাকে তারা আলীর সৃষ্টিকারী বা 'হিজাব' (পর্দা) মনে করে।

    • সীন (Sin): এটি সালমান আল-ফারসীর প্রতীক, যাকে তারা মুহাম্মাদের সৃষ্টিকারী বা 'বাব' (দ্বার) মনে করে। তারা বিশ্বাস করে যে এই ত্রিত্বের মাধ্যমে ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেন।

  • আলীর ঐশ্বরিকতা: তারা আলী (রা.)-কে আল্লাহর অবতার বা ঈশ্বরের একটি দিক বলে বিশ্বাস করে। তাদের মতে, আলী ছিলেন স্বর্গীয় সত্তা, যিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে এসেছেন।

  • আত্মার রূপান্তর (Metempsychosis/Transmigration of Souls): নুসাইরিরা আত্মার পুনর্জন্ম বা রূপান্তরের ধারণায় বিশ্বাস করে। তাদের মতে, মৃত্যুর পর আত্মা একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে নতুন দেহে প্রবেশ করে, যা একজন ব্যক্তির জীবনযাপন এবং পাপ-পুণ্যের উপর নির্ভর করে। ভালো মুসলমানের আত্মা তারকারাজিতে ফিরে যায়, আর খারাপদের আত্মা পশু বা বিধর্মীর দেহে প্রবেশ করে।

  • ইসলামী স্তম্ভের প্রতীকী ব্যাখ্যা: তারা ইসলামের স্তম্ভগুলো (যেমন সালাত, সাওম, হজ) আক্ষরিক অর্থে পালন না করে প্রতীকী অর্থে ব্যাখ্যা করে। যেমন, তারা দিনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাতকে নির্দিষ্ট মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ব্যাখ্যা করে, যার মধ্যে আলী (রা.) অন্যতম।

  • উৎসব ও রীতি: তাদের নিজস্ব কিছু উৎসব রয়েছে, যার মধ্যে খ্রিস্টানদের ক্রিসমাস, ইস্টার এবং কিছু স্থানীয় পেগান উৎসবের প্রভাব দেখা যায়। তারা নির্দিষ্ট কিছু ওয়াইন পান করে, যা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়।

  • গোপন ধর্ম: তাদের ধর্ম অত্যন্ত গোপনীয় এবং শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু দীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। নারীরা সাধারণত তাদের ধর্মতত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না।

  • আহলে বাইতের প্রতি ভক্তি: শিয়াদের অন্যান্য শাখার মতো তারাও আহলে বাইতের প্রতি গভীর ভক্তি পোষণ করে, তবে তাদের ভক্তির ধরন অনেকটাই ভিন্ন।

ঐতিহাসিক বিকাশ:

  • নবম শতাব্দীর শেষ দিকে এবং দশম শতাব্দীর প্রথম দিকে ইবন নুসাইর ও তার অনুসারীদের দ্বারা এই সম্প্রদায়ের ভিত্তি স্থাপিত হয়।

  • তারা উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে এবং পরে ফরাসি ম্যান্ডেটের সময় সিরিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রাখে।

  • বিংশ শতাব্দীতে সিরিয়ার রাজনীতিতে আলাউইটদের প্রভাব বেড়ে যায়। সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ এবং তার পরিবার (আসাদ পরিবার) আলাউইট সম্প্রদায়ভুক্ত।

প্রভাব:

আলাউইটদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও, সিরিয়ার রাজনীতিতে তাদের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। তাদের গুহ্য প্রকৃতি এবং ধর্মতত্ত্বের কারণে, অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায় (সুন্নি ও অন্যান্য শিয়া গোষ্ঠী) প্রায়শই তাদের 'গালি' (চরমপন্থী) বা এমনকি অ-মুসলিম হিসেবে দেখে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ