মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান
এ কথাটি সহীহ মুসলিমে হযরত আবু মূসা আশআরী রা. কর্তৃক বর্ণিত
একটি দীর্ঘ হাদীসের অংশ। পুরো হাদীসটি ইমাম মুসলিমের সনদে নিম্নরূপ:
حدثنا سعيد بن منصور ، وقتيبة بن سعيد ، وأبو كامل
الجحدري ، ومحمد بن عبد الملك الأموي ، اللفظ لأبي كامل قالوا: حدثنا أبو عوانة ، عن
قتادة ، عن يونس بن جبير ، عن حطان بن عبد الله الرقاشي قال: صليت مع أبي موسى الأشعري صلاة ...فقال أبو موسى
...إن رسول الله صلى الله عليه وسلم خطبنا فبين لنا سنتنا وعلمنا صلاتنا ، فقال إذا
صليتم فأقيموا صفوفكم ، ثم ليؤمكم أحدكم ، فإذا كبر فكبروا ، وإذا قال غير المغضوب عليهم ولا الضالين فقولوا آمين ، يجبكم الله ...وإذا قال سمع الله
لمن حمده فقولوا اللهم ربنا لك الحمد، يسمع الله لكم...
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِى شَيْبَةَ ،
حَدَّثَنَا أَبُو أُسَامَةَ، حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ أَبِى عَرُوبَةَ ، ح وَحَدَّثَنَا
أَبُو غَسَّانَ الْمِسْمَعِىُّ ، حَدَّثَنَا مُعَاذُ بْنُ هِشَامٍ ، حَدَّثَنَا أَبِى
، ح وَحَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ ، أَخْبَرَنَا جَرِيرٌ ، عَنْ سُلَيْمَانَ
التَّيْمِىِّ ،كُلُّ هَؤُلاَءِ عَنْ قَتَادَةَ فِى هَذَا الإِسْنَادِ بِمِثْلِهِ.
"وَفِى حَدِيثِ جَرِيرٍ عَنْ سُلَيْمَانَ ، عَنْ قَتَادَةَ ، مِنَ الزِّيَادَةِ: "وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا "
অর্থাৎ আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের খেতাব করলেন এবং আমাদের দ্বীনের তরীকা ও নামাযের নিয়ম শেখালেন।
তিনি বললেন, যখন তোমরা নামায পড়তে শুরু
কর তখন (প্রথমে) কাতারগুলো সোজা কর। এরপর তোমাদের একজন ইমাম হবে। সে যখন তাকবীর দেয়
তখন তোমরা তাকবীর দিবে। আর সে যখন পড়ে তখন তোমরা চুপ থাকবে। সে যখন غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ বলে তখন তোমরা আমীন বলবে। আল্লাহ তোমাদের দুআ কবুল করবেন...।
সে যখন سمع الله لمن حمده বলে তখন তোমরা
اللهم ربنا لك الحمد বলবে। আল্লাহ তোমাদের প্রশংসা শুনবেন...। -সহীহ মুসলিম,
হাদীস ৪০৪
সনদের প্রাসঙ্গিক আলোচনা
সহীহ মুসলিম থেকে সনদের যে আরবী পাঠ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে,
তাতে দেখা যাচ্ছে, ইমাম মুসলিম এ হাদীসটি একাধিক নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণনা করেছেন।
আর আলোচিত বাক্যটিও এ হাদীসের অংশ এবং যে সনদে তা আছে তা-ও ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
আর তা বর্ণনা করেছেন এভাবে-
"وَفِى حَدِيثِ جَرِيرٍ عَنْ سُلَيْمَانَ ، عَنْ
قَتَادَةَ ، مِنَ الزِّيَادَةِ : وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا "
অর্থাৎ (এ হাদীসে) কাতাদা থেকে সুলায়মান তাইমীর বর্ণনায়,
যা বর্ণনা করেছেন জারীর, এ কথাও রয়েছে- وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا “(ইমাম) যখন পড়ে তোমরা তখন
চুপ থাকবে”।
ইমাম মুসলিমের মতে তা সহীহও বটে। একারণেই তিনি তা তাঁর ‘সহীহ’ তে এনেছেন। উপরন্তু
একজনের প্রশ্নের উত্তরে তা স্পষ্ট ভাষায় বলেও দিয়েছেন। সেই কথোপকথনটিও সহীহ মুসলিমে
আছে। আর তা এই-
قَالَ أَبُو إِسْحَاقَ : قَالَ أَبُو بَكْرِ ابْنُ
أُخْتِ أَبِى النَّضْرِ فِى هَذَا الْحَدِيثِ ، فَقَالَ مُسْلِمٌ : تُرِيدُ أَحْفَظَ
مِنْ سُلَيْمَانَ؟!...
অর্থাৎ আবু ইসহাক বলেন, আবু নাযরের ভাগ্নে আবু বকর এ হাদীস সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে (ইমাম)
মুসলিম বলেন, “তুমি কি সুলায়মান (তাইমীর)
চেয়েও বড় হাফেয চাও?!... (সহীহ মুসলিম,
হাদীস : ৪০৪-এর আলোচনায়)
সুতরাং দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, ইমাম মুসলিম (২৬১হি.)-এর বিচারে এ হাদীস অর্থাৎ ‘ইমাম যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ থাক’ সহীহ।
ইমাম আহমদ রাহ.-এর সিদ্ধান্ত
আবু বকর আছরাম বলেন, আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (২৪১ হি.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, "وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا" (সে যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ
থাক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে কে বর্ণনা করে?
উত্তরে বললেন, ...জারীরের হাদীস, যা তিনি সুলায়মান তাইমী থেকে বর্ণনা করেছেন। তাদের ধারণা সুলায়মান তাইমী থেকে
এটি মুতামিরও বর্ণনা করেছেন। বললাম, জ্বী, মুতামিরও বর্ণনা করেছেন। তিনি
বললেন, তাহলে আর কী চাও?
-আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ১১/৩৪
আবু তালেব বলেন, আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা বলে, আবু খালেদ এখানে ভুল
করেছেন? উত্তরে বললেন, এটি সুলায়মান তাইমীর সূত্রে আবু মূসা আশআরী. রা. থেকে বর্ণিত
হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলাম, তারা বলে,
তাইমী এখানে ভুল করেছেন? বললেন, এ কথা যে বলে সে তার
উপর অপবাদ আরোপ করে!
من قال هذا فقد بهته! (শরহে মুগলাতায় ৩/৪০৯)
আরো মনীষীদের মতামত
ইবনে আবদুল বার রহ. (৪৬৩হি.) বলেন, কেউ যদি এ প্রশ্ন করে যে, এটি (ইমাম যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ থাকবে) আবু হুরায়রা রা.-এর
হাদীসে ইবনে আজলান ছাড়া আর আবু মূসা আশআরী.-এর হাদীসে সুলায়মান তাইমী ছাড়া আর কেউ
বর্ণনা করেনি, তাহলে তাকে বলা হবে যে,
এঁদের চেয়ে বড় হাফেয কেউ এঁদের বিরোধিতা করেননি।
সুতরাং এঁদের বর্ণনা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। ইমাম আহমদ উভয় হাদীসকে সহীহ বলেছেন...।
(আততামহীদ ১১/৩৪)
আবু মূসা আশআরী রা.-এর হাদীস এবং তাতে ইমাম দারাকুতনীর আপত্তি
উদ্ধৃত করে মুনযিরী রাহ. (৬৫৬হি.) বলেন, সুলায়মান তাইমী ছিকা ও হাফেযে হাদীস হওয়ায় তাঁর একক বর্ণনা ইমাম মুসলিমের কাছে
কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। তাই তিনি একে সহীহ বলেছেন...। -মুখতাসারে সুনানে আবু
দাউদ ১/৩১৩
...ولم يؤثر عند مسلم تفرد سليمان بذلك، لثقته وحفظه
، وصحح هذه الزيادة...
ইবনে তাইমিয়া রহ. (৭২৮হি.) লেখেন, আবু মূসা আশআরী রা.-এর হাদীসে বর্ণিত ‘ইমাম যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ থাক’ কথাটিকে ইমাম আহমদ, ইসহাক (২৩৮হি.) ও মুসলিম ইবনে হজ্জাজ প্রমুখ সহীহ বলেছেন। আর বুখারী এর এ ইল্লত
বের করেছেন যে, এতে রাবীদের ইখতিলাফ হয়েছে!
অথচ তা বর্ণনাটির বিশুদ্ধতায় বিঘœ সৃষ্টি করে না। -মাজমূ
ফাতাওয়া ২২/৩৪০
ইমাম ইবনুল মুনযির (৩১৮হি.), ইবনুত তুরকুমানী (৭৪৫হি.), ইবনুল হুমাম (৮৬১হি.), ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২হি.) ও বদরুদ্দীন আইনী (৮৫৫হি.) প্রমুখও
একই মত পোষণ করেছেন। দেখুন : আলজাওহারুন নাকী, ইবনুত তুরকুমানী ২/১৫৫-১৫৬ (আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী’র সাথে মুদ্রিত);
ফাতহুল কাদীর, ইবনুল হুমাম ১/৩৪১; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/২৮৩;
উমদাতুল কারী ৬/১৫; ফাছলুল খিতাব ফী মাসআলাতি উম্মিল কিতাব পৃ. ৪২-৪৩
কোনো কোনো ইমামের ভিন্নমত
এখন আমরা আরো কিছু ইজতিহাদী মতামত নিয়ে আলোচনা করব। ইমাম বুখারীসহ
কোনো কোনো ইমামের ভিন্নমতও এখানে আছে। তাঁরা বলেন, আলোচিত বাক্যটি ‘সহীহ’ নয়। তাঁদের যুক্তি,
কাতাদা থেকে হাদীসটি সায়ীদ ইবনে আবী আরুবা,
হিশাম দাস্তওয়ায়ী, হাম্মাম ইবনে ইয়াহইয়া ও আবান ইবনে ইয়াযিদ প্রমুখও বর্ণনা
করেছেন। তাদের বর্ণনায় ‘সে যখন পড়ে তোমরা
তখন চুপ থাক’ কথাটি নেই। শুধু সুলায়মান
তাইমী তা বর্ণনা করেন। সুতরাং ওঁদের বর্ণনাই সঠিক, সুলায়মান তাইমী এটা হয়ত ভুলে বাড়িয়ে দিয়েছেন!
দ্রষ্টব্য: আলকেরাত খালফাল ইমাম, বুখারী পৃ. ৫৮; সুনানে দারাকুতনী ২/১২১; আলইলাল, দারাকুতনী ৭/২৫৪; আলকেরাত খালফাল ইমাম, বায়হাকী পৃ. ১২৮-১৩১
পক্ষান্তরে অনেক ইমামের মতে এ কথাটি সহীহ এবং এ হাদীসের অংশ।
যেমনটা ইমাম আহমাদ ও ইমাম মুসলিমের বক্তব্যে আমরা পেলাম। এবং সার্বিকভাবে এ মতটিই অধিকতর
সঙ্গত। কারণ সুলায়মান তাইমী অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তাছাড়া এ বর্ণনায় তিনি একা নন,
তাঁর একাধিক মুতাবি (সমর্থনকারীও) রয়েছে।
সুলায়মান তাইমী সম্পর্কে ইমামদের মতামত
সুফিয়ান ছাওরী রাহ. বলেন, বসরার হাফেযে হাদীস ছিলেন তিনজন- সুলায়মান তাইমী, আসেম আহওয়াল ও দাউদ ইবনে আবী হিন্দ।
মুয়াল্লা ইবনে মনসূর বলেন, আমি ইসমাইল ইবনে উলাইয়্যাকে বসরার হাফেযে হাদীসদের সম্পর্কে
জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাদের মধ্যে সুলায়মান তাইমীর নাম উল্লেখ করেন।
ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আলকাত্তান বলেন, তাইমী আমাদের কাছে ‘আহলে হাদীসে’র অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন ও আহমদ ইবনে হাম্বল বলেন, তিনি ‘ছিকা’। -আলজারহু ওয়াততাদীল ৪/১২৪-১২৫; তারীখে ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন, উসমান ইবনে সায়ীদ দারিমী পৃ. ৪৯
সুলায়মান তাইমী কি এ বর্ণনায় একা?
এধরনের হাফেযে হাদীসদের একক বর্ণনা ইমামগণ অনেক ক্ষেত্রেই কবুল
করেন। অথচ আগেই বলেছি, এ বর্ণনায় তাঁর দু’জন সমর্থনকারীও রয়েছে।
এক. উমর ইবনে আমের।
বর্ণনাটি এই-
-মুসনাদে বায্যার ৬/৬৬, হাদীস ৩০৬০
দুই. আবু উবায়দা (মুজ্জাআ ইবনে যুবাইর)।
বর্ণনাটি এই-
قال أبو عوانة : حَدَّثَنَا سَهْلُ بْنُ بَحْرٍ
الْجُنْدَيْسَابُورِيُّ ، قَالَ: حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ رُشَيْدٍ ، قَالَ:
حَدَّثَنَا أَبُو عُبَيْدَة َ، عَنْ قَتَادَةَ ، عَنْ يُونُسَ بْنِ جُبَيْرٍ، عَنْ
حِطَّانَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الرَّقَاشِيِّ ، عَنْ أَبِي مُوسَى الأَشْعَرِيِّ ، قَالَ:
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم -: إِذَا قَرَأَ الإِمَامُ فَأَنْصِتُوا،
وَإِذَا قَالَ: {غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلا الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِين .
-সহীহ আবু আওয়ানা ২/১৩৩
উভয় বর্ণনার সনদ সমর্থক বর্ণনা হিসেবে খুবই গ্রহণযোগ্য। প্রথমটির
সনদ হাসান পর্যায়ের আর দ্বিতীয়টি তো ইমাম আবু আওয়ানা তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থেই এনেছেন।
ইমাম বুখারী আরেক আপত্তি করেছেন। সুলায়মান তাইমী কাতাদা থেকে
আর কাতাদা ইউনুস ইবনে জুবাইর থেকে শুনেছেন কি না, তা এ বর্ণনায় অনুল্লেখিত। -আলকেরাত খালফাল ইমাম, বুখারী পৃ. ৫৮
বাস্তবে এটিও কোনো প্রভাবক ত্রুটি নয়। কারণ সুলায়মান তাইমী
কাতাদা থেকে আর কাতাদা ইউনুস ইবনে জুবাইর থেকে শুনেছেন। মুতামির ইবনে সুলায়মানের বর্ণনায়
সহীহ সনদে তার উল্লেখ রয়েছে।
বর্ণনাটি এই-
قال الامام أبو داود : حَدَّثَنَا عَاصِمُ بْنُ
النَّضْرِ، حَدَّثَنَا الْمُعْتَمِرُ قَالَ: سَمِعْتُ أَبِى حَدَّثَنَا قَتَادَةُ عَنْ
أَبِى غَلاَّبٍ يُحَدِّثُهُ عَنْ حِطَّانَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الرَّقَاشِىِّ بِهَذَا
الْحَدِيثِ زَادَ فَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا .
-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৯৭৩
আরো দ্রষ্টব্য : আলআওসাত, ইবনুল মুনযির ৩/২৬০
সারকথা এই যে, আলোচিত হাদীসটি আবু মূসা আশআরী রা.-এর সূত্রে সহীহ ও প্রমাণিত। এ প্রসঙ্গে কোনো
কোনো ইমামের যে ভিন্নমত রয়েছে তার চেয়ে এ সিদ্ধান্তই অগ্রগণ্য। কারণ এ হাদীসের বর্ণনাকারী
সুলায়মান তাইমী অতি উঁচু পর্যায়ের ছিকা ও হাফিযুল হাদীস, যাদের একক বর্ণনাও ইমামগণ কবুল করেন, তদুপরি এ বর্ণনায় তিনি একা নন, অন্তত দু’জন সমর্থনকারী রাবী
তাঁর রয়েছে।
অন্য সাহাবীর সূত্রে
আলোচ্য হাদীসটি আলাদা সনদে অন্য সাহাবী থেকেও বর্ণিত হয়েছে।
এটি হযরত আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসেরও অংশ। সনদসহ পুরো হাদীসটির
আরবী পাঠ এই-
قال ابن أبي شيبة : حَدَّثَنَا أَبُو خَالِدٍ الأَحْمَرِِ
، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ عَجْلاَنَ ، عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ ، عْن أَبِي صَالِحٍ
، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : إنَّمَا
جُعِلَ الإِمَام لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا ، وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا
، وَإذَا قَالَ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ ، وَلاَ الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ
، وَإِذَا رَكَعَ فَارْكَعُوا ، وَإذَا قَالَ سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ فَقُولُوا
اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ ، وَإِذَا سَجَدَ فَاسْجُدُوا ، وَإِذَا صَلَّى
جَالِسًا فَصَلُّوا جُلُوسًا.
অর্থাৎ আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইমাম হল অনুসরণের জন্য। সুতরাং সে যখন তাকবীর দেয় তখন তোমরা তাকবীর দিবে। আর সে যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ থাকবে। সে যখন غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ পড়ে তখন তোমরা আমীন বলবে। সে যখন রুকূ করে তখন তোমরা রুকূ করবে।
সে যখন سمع الله لمن حمده বলে তখন তোমরা اللهم ربنا لك الحمد বলবে। সে যখন সেজদা করে তখন তোমরা সেজদা করবে। সে যখন বসে নামায পড়ে তখন তোমরা বসে নামায পড়বে।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৭২১৪)
আরো দেখুন : মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৯৪৩; সুনানে আবু দাউদ,
হাদীস ৬০৪; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৯২১
সনদের প্রাসঙ্গিক আলোচনা
এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম ‘সহীহ’ গ্রন্থে না-আনলেও
এটি তাঁর মতে সহীহ। সহীহ মুসলিমে উল্লেখিত ইমাম মুসলিম ও আবু নাযরের ভাগ্নে আবু বকরের
মধ্যকার কথোপকথনটিতে তা স্পষ্টভাবে আছে।
... আবু বকর জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে আবু হুরায়রা রা.-এর হাদীস (অর্থাৎ এটি কি আপনার মতে সহীহ)?
বললেন, আমার মতে এটি সহীহ। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে ‘সহীহ’ গ্রন্থে কেন আনেননি? বললেন, আমার মতে যা সহীহ
তার সব তো এখানে আনিনি। এখানে এনেছি কেবল এমন হাদীস যাতে তাঁরা ঐকমত্য পোষণ করেছেন”
। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০৪-এর আলোচনায়)
তাঁদের কথোপকথনটির আরবী পাঠ এই-
ৃفَقَالَ لَهُ أَبُو بَكْرٍ: فَحَدِيثُ أَبِى
هُرَيْرَةَ؟ فَقَالَ هُوَ صَحِيحٌ يَعْنِى وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا. فَقَالَ: هُوَ
عِنْدِى صَحِيحٌ. فَقَالَ: لِمَ لَمْ تَضَعْهُ هَا هُنَا؟ قَالَ: لَيْسَ كُلُّ شَىْءٍ
عِنْدِى صَحِيحٍ وَضَعْتُهُ هَا هُنَا ، إِنَّمَا وَضَعْتُ هَا هُنَا مَا أَجْمَعُوا
عَلَيْهِ.
এ থেকে স্পষ্ট যে, ইমাম মুসলিমের মতে আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রে বর্ণিত এ হাদীস অর্থাৎ ‘ইমাম যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ থাক’ সহীহ।
আবু বকর আছরাম বলেন, আমি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলকে জিজ্ঞাসা করলাম, "وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا" (সে যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ থাক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ
সূত্রে কে বর্ণনা করেন? উত্তরে বললেন,
ইবনে আজলানের হাদীস, যা তাঁর থেকে আবু খালেদ বর্ণনা করেছেন...। (আততামহীদ,
ইবনে আবদুল বার ১১/৩৪)
তবে ইমাম বুখারীসহ আরো
কোনো কোনো ইমামের ভিন্নমতও এখানে আছে। ইমাম আবু দাউদ বলেন, ‘ইমাম যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ থাকবে’ কথাটি সঠিক নয়। আমার মতে এ ভুলটি হয়েছে আবু খালেদ (সুলায়মান
ইবনে হাইয়্যান) থেকে।
ইমাম আবু দাউদ-এর এ বক্তব্য উদ্ধৃত করে মুনযিরী রাহ. লিখেছেন,
“তাতে আপত্তি আছে। কারণ সুলায়মান ইবনে হাইয়্যান
আহমার ছিকা রাবীদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের হাদীস ইমাম
বুখারী ও মুসলিম সহীহ গ্রন্থে দলীলস্বরূপ এনেছেন। তাছাড়া এ বর্ণনায় তিনি একা নন,
মুহাম্মাদ ইবনে সা‘দ তাঁর সমর্থন করেছেন। আর তিনি (মুহাম্মাদ ইবনে সা‘দ) ছিকা...। ইমাম নাসায়ী উভয় হাদীস তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে এনেছেন...।”
মুখতাসারে সুনানে আবু দাউদ ১/৩১৩
ইমাম ইবনে আবদুল বার, ইবনে হাযম (৪৫৬হি.), ইবনুত তুরকুমানী ও বদরুদ্দীন আইনী প্রমুখও একই মত পোষণ করেছেন।
দেখুন: আলমুহাল্লা, ইবনে হাযম ৩/২০১; আলজাওহারুন নাকী ২/১৫৬-১৫৮; উমদাতুল কারী ৬/১৫; ফাছলুল খিতাব ফী মাসআলাতি উম্মিল কিতাব পৃ. ৪৩-৪৪
এবং সার্বিক বিচারে এ মতটিই অধিকতর সঙ্গত। কারণ আবু খালেদ নিভর্রযোগ্য।
তাছাড়া এ বর্ণনায় তিনি একা নন, তাঁর মুতাবি (সমর্থনকারীও)
রয়েছে।
এ বর্ণনায় তাঁর সমর্থন করেছেন মুহাম্মদ ইবনে সা’দ।
বর্ণনাটি এই-
قال النَّسَائي: أخبرنا محمد بن عبد الله بن المبارك
، قال: حدثنا محمد بن سعد الأنصاري قال: حدثني محمد بن عجلان عن زيد بن أسلم ، عن أبي
صالح ، عن أبي هريرة قال: قال رسول الله صلى الله عليه و سلم: إنما الإمام ليؤتم به
، فإذا كبر فكبروا ، وإذا قرأ فأنصتوا.
قال أبو عبد الرحمن : كان المخرمي يقول : هو ثقة
يعني محمد بن سعد الأنصاري
-সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৯২২
মুহাম্মদ ইবনে সা‘দ ছিকা। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক আলমুর্খারিমী ও নাসায়ী তাকে ‘ছিকা’ বলেছেন এবং ইবনে হিব্বান
‘ছিকাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। দেখুন : তারীখে বাগদাদ ৫/৩২১; আছছিকাত ৯/৪১; সুনানে দারাকুতনী ২/১১৮
বাকি রইল মুহাম্মদ ইবনে আজলানের একা বর্ণনা করা, যেটাকে বুখারী ও আবু হাতেম রাহ. এখানে ইল্লত মনে করেছেন। আসলে
এটিও কোনো প্রভাবক ত্রুটি নয়। কারণ তিনি ছিকা। তাছাড়া তার বর্ণনায় অন্যান্য রাবীদের
বর্ণনার বিরোধী কিছু নেই। বরং ব্যাপারটি এখানে এরকম যে, তাঁর বর্ণনায় একটি বিষয় উল্লেখিত হয়েছে; যা অন্যদের বর্ণনায় উল্লেখিত হয়নি। এটি মূলত ‘যিয়াদাতুছ ছিকা’র অধীনে আসে।
মুহাম্মাদ ইবনে আজলান শুধু উঁচু পর্যায়ের ছিকা বা হাদীস বর্ণনায় বিশ্বস্ত ও ইমামগণের
আস্থাভাজন রাবীই নন, তিনি ফিকহ ও ফতোয়ারও ইমাম।
ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন, ইজলী, আবু হাতেম ও আবু যুরআ তাঁকে ছিকা বলেছেন।
ইমাম ইবনে উয়াইনা তো হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর উঁচু মানের প্রশংসাও
করেছেন। -দেখুন: তারীখে ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন, দূরী ১/১৪৫, ১৬৬, ১৬৭; আলইলাল ওয়ামারিফাতুর
রিজাল ১/১৯৮, ২/১৯, ১৫৪; আলজারহু ওয়াততাদীল
৮/৪৯-৫০; আলমারিফাতু ওয়াততারীখ ১/৬৯৮;
মারিফাতুছ ছিকাত ২/২৪৮; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৩১৮
এমন বর্ণনাকারীর ‘যিয়াদাহ’ গ্রহণ করা সালাফের ফিকহ ও
ইজতিহাদের ইমামগণ তো বটেই; জরহ-তাদীল ও ইলালের
অনেক ইমামেরও মাযহাব। তাই ইবনে আজলানের এ রেওয়ায়েত সম্পর্কে করা উপরোক্ত আপত্তি সঠিক
নয়। আর এজন্যই ইমাম আহমাদ, ইমাম মুসলিমসহ পূর্ববর্তী
ও পরবর্তী অনেক হাদীসের ইমাম এটিকে সহীহ বলেছেন। যেমনটি আমরা একটু আগে দেখে এসেছি।
লক্ষণীয়, আবু হুরায়রা রা.
থেকে হাদীসটি আবু সালামা, কায়স ইবনে আবী হাযেম,
আবুয যিনাদ, আবু ইউনুস, আবু আওয়ানা প্রমুখ
বর্ণনা করেছেন। প্রায় সবার বর্ণনায় শব্দ-বাক্যের কমবেশি রয়েছে। (দেখুন : সহীহ বুখারী,
হাদীস ৭২২, ৭৩৪; সহীহ মুসলিম,
হাদীস ৪১৪-১১৭; মুসান্নফে আবদুর রায্যাক, হাদীস ৪০৮৩; মুসনাদে আহমদ,
হাদীস ৭১৪৪, ৮১৫৬, ৮৫০২, ৯০১৫)
অথচ কারো বর্ণনাকে ভুল আখ্যায়িত করা হয়নি। কারণ তাঁরা সবাই
ছিকা এবং বর্ণনাগুলো পারস্পরিক সাংঘর্ষিক নয়। সুতরাং মুহাম্মদ ইবনে আজলান (এমনিভাবে
সুলায়মান তাইমী ও আবু খালেদ)-এর ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য হবে।
সারকথা এই যে, আবু হুরায়রা রা.-এর সূত্রেও আলোচিত হাদীসটি সহীহ। এ প্রসঙ্গে কোনো কোনো ইমামের
যে ভিন্নমত রয়েছে তার চেয়ে বর্ণনাটি সহীহ হওয়ার সিদ্ধান্তই অগ্রগণ্য। কারণ এ হাদীসের
বর্ণনাকারী আবু খালেদ নির্ভরযোগ্য, উপরন্তু এ বর্ণনায়
তিনি একা নন, তাঁর ছিকা সমর্থনকারী রয়েছে। আর মুহাম্মদ ইবনে আজলানও ছিকা রাবী।
আরো দেখুন: জামিউল বায়ান ফী তাবীলি আয়ীল কুরআন, ইবনে জারীর ১০/৬৬৭; আলমুনতাকা শরহুল মুয়াত্তা, আবুল ওলীদ বাজী ১/৩৫৪;
শরহুল মুয়াত্তা, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল বাকী আয্যুরকানী ১/২৫২
এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, ‘ইমাম যখন পড়ে তোমরা তখন চুপ থাক’ কথাটি দুই সাহাবী- হযরত আবু মূসা আশআরী ও আবু হুরায়রা রা.-এর
সূত্রে সহীহ ও প্রমাণিত। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ ও মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ একে সহীহ বলেছেন।
এবং ইবনে জারীর তবারী (৩১০হি.), ইবনুল মুনযির,
ইবনে হাযম, ইবনে আবদুল বার, মুনযিরী, ইবনে তাইমিয়া, ইবনুত তুরকুমানী, ইবনে হাজার আসকালানী ও ইবনুল হুমাম প্রমুখ এ মতই পোষণ করেছেন।
সর্বশেষ কথা এই যে, এখানে নির্ধারিত বর্ণনার উপর সনদগত আলোচনা উপস্থাপিত হল। অন্যথায় মূল বিষয়টি
কুরআন মাজীদের আয়াত ও অনেক সাহাবী-তাবেয়ীর ফতোয়া ও আমল দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত,
যা মৌখিক সাধারণ বর্ণনা-সূত্রের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
ইবনে তাইমিয়া রাহ. বড় সুন্দরভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন।
তিনি সহীহ মুসলিমের বিভিন্ন হাদীসের অংশ-বিশেষকে বিভিন্ন মুহাদ্দিস কর্তৃক যে যয়ীফ
বলা হয়েছে, সে বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে
বলেছেন, এসব জায়গায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
মুসলিমের সিন্ধান্ত সঠিক। যেমন আবু মূসা আশআরী রা.-এর হাদীসে وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا অংশটি- একে ইমাম মুসলিম সহীহ বলেছেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ও অন্যরা
তা গ্রহণ করেছেন। পক্ষান্তরে বুখারী একে যঈফ গণ্য করেছেন। অথচ এ কথাটি কুরআন মাজীদের
বক্তব্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এ বিষয়ে যদি কোনো সহীহ হাদীস নাও থাকত তবু কুরআন অনুযায়ী
আমল করা তো জরুরি। আল্লাহর বাণী-
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُواৃ
(যখন কুরআন পড়া হয় তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক)-এর
ব্যাপারে সকলের ঐকমত্য রয়েছে যে, এটি সালাত সম্পর্কে
অবতীর্ণ হয়েছে এবং সালাতের কেরাতকে তাতে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। (মাজমূ ফাতাওয়া,
ইবনে তাইমিয়া ১৮/২০)
এ বিষয়ে তিনি ‘মাজমূ ফাতাওয়া’ ২৩/২৭২-২৭৩-তে আরো দীর্ঘ আলোচনা
করেছেন। আগ্রহী পাঠক তা দেখে নিতে পারেন।
http://www.alkawsar.com/article/1350