রাইয়ান বিন লুৎফুর রহমান
সেদিন গাজীপুর থেকে এক মসজিদের ইমাম ছাহেব ফোন করে জানালেন,তাঁর এলাকায় গত কয়েকদিন আগে এক ব্যক্তির ইন্তেকাল হয়। ঘটনাক্রমে সেই সময় তিনি এবং এলাকার অন্যান্য ইমাম উপস্থিত না থাকায় এক গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধু জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। নামায শেষে তিনি এলাকার মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন ‘এতদিন যত জানাযার নামায পড়েছেন কোনোটাই হয়নি। কেননা জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ফরয। যেহেতু এতদিন এই ফরযের উপর আমল হয়নি তাই কোনো জানাযার নামাযই সহীহ হয়নি। তার এই বক্তব্যে সেই এলাকায় ব্যাপক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ফরয হওয়া তো অনেক দুরের বিষয় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন এ মর্মে কোনো সহীহ হাদীস আছে বলে আমাদের জানা নেই। এ প্রসঙ্গে হাফেয ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়, যাকে আমাদের ঐ বন্ধুরাও নিজেদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করে থাকেন। তিনি বলেছেন:
ويذكر عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه أمر أن يقرأ على الجنازة بفاتحة الكتاب ولا يصح إسناده
অর্থ: নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-থেকে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর সনদ সহীহ নয়। -যাদুল মা‘আদ ১/৪৮৬
মূলত জানাযার নামায সাহাবায়ে কেরাম মৌখিক বর্ণনার পরিবর্তে প্রায়োগিক পদ্ধতিতেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বেশি হাসিল করেছেন। পরবর্তীতে তা‘আমুল এবং তাওয়ারুছের মাধ্যমে তাবেয়ীগণ সাহাবাদের থেকে তা হাসিল করেছেন। আর সাহাবা-তাবেয়ীগণ এবং খাইরুল কুরূনের ব্যাপক কর্মধারা সামনে রাখলে বুঝা যায় যে, তাঁদের অধিকাংশই জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না। আমরা প্রথমে সাহাবীদের তারপর তাবেয়ীদের কিছু আছার নিচে উল্লেখ করছি।
(১) খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর আমল
قال ابن أبي شيبة : حدثنا محمد بن فضيل عن العلاء بن المسيب عن أبيه عن علي أنه كان إذا صلى على ميت يبدأ يحمد الله ويصلى على النبي صلى الله عليه وسلم ثم يقول : اللهم اغفر لأحيائنا و أمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا .
অর্থ: হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোনো মায়্যেতের জানাযার নামায পড়তেন তখন প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করতেন তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়তেন অতপর এই বলে দুআ করতেন :
اللهم اغفر لأحيائنا وأمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا.
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৪৯৪
এই বর্ণনার রাবীগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য। এই আছর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, হযরত আলী রা. জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না।
(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর আমল
مالك عن نافع أن عبد الله بن عمر كان لا يقرأ في الصلاة على الجنازة
অর্থ: নাফে রাহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়তেন না। -মুয়াত্তা মালিক, হাদীস ৫২৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৫২২
এই আছরটিও বিশুদ্ধতম সনদে বর্ণিত। এখানেও স্পষ্টভাবে বলা হল, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জানাযার নামাযে কুরআন পড়তেন না।
(৩) হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর আমল এবং তালীম
ما لك عن سعيد بن أبي سعيد المقبري عن أبيه أنه سأل أبا هريرة كيف تصلي على الجنازة؟ فقال أبو هريرة أنا لعمر الله أخبرك أتبعها من أهلها فإذا وضعت كبرت وحمدت الله وصليت على نبيه ثم أقول اللهم إنه عبدك وابن عبدك وابن أمتك كان يشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا عبدك ورسولك وأنت أعلم به اللهم إن كان محسنا فزد في إحسانه وان كان مسيئا فتجاوز عن سيئاته اللهم لا تحرمنا أجره ولا تفتـنا بعده.
অর্থ: আবু সাঈদ মাকবুরী থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আবু হুরায়রা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কীভাবে জানাযার নামায পড়েন? আবু হুরাইরা রা. বললেন, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি তোমাকে বলব। আমি মায়্যেতের (ঘর থেকে) পরিবারের সাথে আসি। অতপর যখন মায়্যেতকে রাখা হয় আমি তাকবীর দেই এবং আল্লাহর প্রশংসা করি। তারপর নবীর উপর দরূদ পড়ি। অতপর এই দুআ করি... اللهم।
-মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ৫২১; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৪৯৫
এই আছরেরও সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। এখান থেকেও বোঝা গেল, হযরত আবু হুরায়রা রা. জানাযার নামাযে কুরআন পড়তেন না।
(৪) উবাদা ইবনে ছামিত রা.-এর ফরমান
عن أبي هريرة أنه سأل عبادة بن الصامت عن الصلاة على الميت فقال أنا والله أخبرك تبدأ فتكبر ثم تصلي على النبي صلى الله عليه وسلم، وتقول اللهم إن عبدك فلانا كان لا يشرك بك شيئا، أنت أعلم به، إن كان محسنا فزد في إحسانه وإن كان مسيئا فتجاوز عنه، اللهم لا تحرمنا أجره ولا تضلنا بعده.
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি উবাদা ইবনে ছামিত রা.-কে জানাযার নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি তোমাকে বলব, তুমি সর্বপ্রথম তাকবীর দিয়ে নামায শুরু করবে। অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়বে এবং এই দুআ পড়বে ... اللهم
-সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪/৪০
উল্লেখ্য : জানাযার নামাযে ফাতিহা পাঠ প্রমাণ করার জন্য গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুগণ হযরত উবাদা ইবনে ছামিত রা.-এর সূত্রে বর্ণিত এ প্রসিদ্ধ হাদীস উদ্ধৃত করে থাকেন-
لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب.
‘যে ফাতিহাতুল কিতাব পড়েনি তার নামায নেই।’-সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫৬
অথচ উপরোক্ত বর্ণনায় পাওয়া গেল যে, স্বয়ং উবাদা ইবনুস সামিত রা.-ই জানাযার নামায ফাতিহা ছাড়া পড়ার নিয়ম জানতেন ও মানতেন। সাহাবী আবু হুরায়রা রা.-এর প্রশ্নের উত্তরে তিনি এই নিয়মেরই উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা রা.-ও এ নিয়ম জানতেন ও মানতেন। ইতিপূর্বে তাঁর বিবরণও উল্লেখিত হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকেও সহীহ মুসলিমে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে-
لا صلاة إلا بقراءة
(কুরআন) পড়া ছাড়া নামায নেই। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯৬
এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, তাঁরা ‘সালাতুল জানাযা’কে এই হাদীসের বিধানের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না। বরং এ পর্যন্ত উল্লেখিত বড় বড় মনীষী সাহাবীর কর্ম ও সিদ্ধান্ত এবং মুসলিম জাহানের বড় বড় কেন্দ্রগুলোর প্রতিষ্ঠিত কর্মধারাও একথাই প্রমাণ করে যে, ‘সালাতুল জানাযা’ উপরোক্ত হাদীসের নির্দেশনার আওতাভুক্ত নয়। সুতরাং এ হাদীসকে সালাতুল জানাযার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা শুধু দলীলহীন প্রয়োগ নয়; দলীলবিরোধী প্রয়োগ বটে।
সালাতুল জানাযার হাকীকত হচ্ছে এটি দুআ। মাইয়েতের জন্য দুআ। একারণে দুআর ভূমিকা হিসেবে ‘ছানা’ (আল্লাহর প্রশংসা) ও ‘সালাত’ (দরূদ) পাঠ করা হয়। ইমাম মালিক রাহ. বলেছেন-
إنما هو الدعاء
‘এ তো দুআ’-আল মুদাওওয়ানা ১ : ২৫১
আর সালাতুল জানাযা যে সাধারাণ সালাতের মতো নয় এ তো বলাই বাহুল্য। এতে রুকু-সিজদা নেই, কা’দা-তাশাহহুদ নেই। সুতরাং একে সাধারণ সালাতের মধ্যে কীভাবে শামিল করা যায়? এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত তাবেয়ী আবুল আলিয়া রাহ.-এর একটি বাণী মনোযোগের দাবিদার। আবুল মিনহাল বলেন-
سَأَلْتُ أَبَا الْعَالِيَةِ عَنِ الْقِرَاءَةِ فِي الصَّلَاةِ عَلَى الْجِنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَقَالَ: “مَا كُنْتُ أَحْسَبُ أَنَّ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ تُقْرَأُ إِلَّا فِي صَلَاةٍ فِيهَا رُكُوعٌ وَسُجُودٌ”
আমি আবুল আলিয়া রাহ.-কে সালাতুল জানাযায় ফাতিহা পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি (আশ্চর্য হয়ে) বললেন, আমার তো ধারণাও ছিল না যে, ফাতিহাতুল কিতাব রুকু-সিজদা বিশিষ্ট সালাত ছাড়া অন্য কোনো সালাতে পড়া হবে?! -আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৪
আবুল আলিয়া রাহ. প্রথম সারির তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত। বিশুদ্ধ মত অনুসারে ৯৩ হিজরীতে তাঁর ইন্তিকাল। (তাহযীবুল কামাল ও তাহযীবুত তাহযীব)
বিখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা কাসানী রাহ. (মৃত্যু ৫৮৭ হি.) এ বাস্তবতা এভাবে বর্ণনা করেছেন-
وَقَوْلُهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ “لَا صَلَاةَ إلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ” وَلَا صَلَاةَ إلَّا بِقِرَاءَةٍ لَا يَتَنَاوَلُ صَلَاةَ الْجِنَازَةِ؛ لِأَنَّهَا لَيْسَتْ بِصَلَاةٍ حَقِيقَةً إنَّمَا هِيَ دُعَاءٌ وَاسْتِغْفَارٌ لِلْمَيِّتِ، أَلَا تَرَى أَنَّهُ لَيْسَ فِيهَا الْأَرْكَانُ الَّتِي تَتَرَكَّبُ مِنْهَا الصَّلَاةُ مِنْ الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ إلَّا أَنَّهَا تُسَمَّى صَلَاةً لِمَا فِيهَا مِنْ الدُّعَاءِ، وَاشْتِرَاطُ الطَّهَارَةِ، وَاسْتِقْبَالُ الْقِبْلَةِ فِيهَا لَا يَدُلُّ عَلَى كَوْنِهَا صَلَاةً حَقِيقِيَّةً كَسَجْدَةِ التِّلَاوَةِ؛
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ‘লা সালাতা ইল্লা বিফাতিহাতিল কিতাব’ ও‘লা সালাতা ইল্লা বি কিরাআ’ সালাতুল জানাযাকে শামিল করে না। কারণ মূলত তা ‘সালাত’ নয়। মাইয়েতের জন্য দুআ ও ইস্তিগফার। লক্ষ করুন, যে সকল ‘রোকন’ দ্বারা সালাত যেমন রুকু-সিজদা, তা-ই তো এতে নেই। একে ‘সালাত’ বলা হয় কারণ তা দুআ। আর পবিত্রতা ও কিবলামুখী হওয়া জরুরি হওয়ার দ্বারা তা হাকীকী সালাত হওয়া প্রমাণ হয় না। কারণ ওগুলো তো তিলাওয়াতের সিজদাতেও জরুরি। -বাদায়েউস সানায়ে ১ : ৩১৪
উপরের আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকজন সাহাবীর আছার উল্লেখ করলাম যারা জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না। এটিই ছিল সাহাবা-যুগের সাধারণ আমল। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর একটি বক্তব্য সম্পর্কেও কিছু আলোচনা করা দরকার, যা গায়রে মুকাল্লিদ বন্ধুরা তাদের ‘দলীল’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আছরটি এই-
عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَوْفٍ، قَالَ: صَلَّيْتُ خَلْفَ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الكِتَابِ قَالَ: لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ
ত্বলহা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আওফ রাহ. বলেন- আমি ইবনে আব্বাস রা.-এর পেছনে জানাযার নামায আদায় করেছি। নামাযে তিনি সূরা ফাতিহা পড়েছেন। (নামায শেষে) বলেছেন, (আমি ফাতিহা পড়েছি) যাতে লোকেরা জানতে পারে যে, এটা সুন্নাহ। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৩৫
এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা এই যে, স্বয়ং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে ফাতিহা ছাড়া সালাতুল জানাযার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ী আবু হামযা রাহ. বলেন-
قلت له : كيف أصلي في الكعبة؟
আমি তাঁকে (ইবনে আব্বাস রা.- কে) জিজ্ঞাসা করলাম, কা‘বার ভিতরে নামায কীভাবে পড়ব? তিনি উত্তরে বললেন-
كما تصلي في الجنازة تسبح وتكبر ولا تركع ولا تسجد ثم عند أركان البيت سبح وكبر وتضرع واستغفر، ولا تركع ولا تسجد
যেভাবে সালাতুল জানাযা পড়; তাসবীহ পড়বে, তাকবীর দিবে, তবে রুকু-সিজদা করবে না। এরপর বাইতের রোকনগুলোর কাছে তাসবীহ করবে, তাকবীর দিবে, রোনাযারি করবে ও ইস্তিগফার করবে। তবে রুকু করবে না ও সিজদা করবে না। -ফতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী ৩ : ৪৬৯
এ বর্ণনার সনদ সহীহ।
লক্ষ্য করুন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কুরআন তিলাওয়াতের উল্লেখ করেননি। এখানে মনে রাখতে হবে যে, ইবনে আব্বাস রা. কা‘বার ভিতরে নামায পড়াকে মাকরূহ মনে করতেন। তিনি মনে করতেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কা‘বার ভিতরে নামায পড়া বিষয়ে যে বর্ণনাগুলো আছে তাতে ‘সালাত’ অর্থ দুআ, নামায নয়।
দ্বিতীয় কথা এই যে, ইতিপূর্বে উল্লেখিত সহীহ রেওয়ায়েতসমূহ থেকে জানা যায় যে, জানাযার নামাযে আল্লাহর হামদ-ছানা ও দুআ করা কর্তব্য। তবে এর জন্য কোনো দুআ-কালাম নির্ধারিত করে দেওয়া হয়নি। সুতরাং কেউ যদি সূরা ফাতিহার দ্বারা আল্লাহর হামদ ও দুআ করেন একে বিদআত বলার সুযোগ নেই। সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো থেকে বর্ণিত ফাতিহা-পাঠের এ ব্যাখ্যাও হতে পারে। তাহলে সালাফের যুগ থেকে চলে আসা মুসলিম জাহানের সাধারণ কর্ম-ধারা ও বড় বড় মনীষী সাহাবীর কর্ম ও সিদ্ধান্তের সাথে তাদের কর্মের কোনো সংঘাত থাকে না। ইমাম তাহাবী রাহ. বলেছেন-
لعل قراءة من قرأ الفاتحة من الصحابة كان على وجه الدعاء لا على وجه التلاوة.
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ যে ফাতিহা পাঠ করেছেন বলে পাওয়া যায় সম্ভবত সেটি ছিল দুআ হিসেবে, কুরআন তিলাওয়াত হিসেবে নয়। -উমদাতুল ক্বারী ৮/১৪১
আল্লামা ইবনে বাত্তাল রাহ. বলেন-
وَمِمَّنْ كَانَ لَا يقْرَأ فِي الصَّلَاة على الْجِنَازَة وينكر: عمر بن الْخطاب وَعلي بن أبي طَالب وَابْن عمر وَأَبُو هُرَيْرَة، وَمن التَّابِعين: عَطاء وطاووس وَسَعِيد بن الْمسيب وَابْن سِيرِين وَسَعِيد بن جُبَير وَالشعْبِيّ وَالْحكم، وَقَالَ ابْن الْمُنْذر: وَبِه قَالَ مُجَاهِد وَحَمَّاد وَالثَّوْري، وَقَالَ مَالك: قِرَاءَة الْفَاتِحَة لَيست مَعْمُولا بهَا فِي بلدنا فِي صَلَاة الْجِنَازَة،
যাঁরা জানাযায় ফাতিহা পড়তেন না, বরং ইনকার করতেন, তাঁদের কয়েকজন হলেন- ওমর ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবি তালিব, ইবনে ওমর, আবু হুরাইরা রা.। আর তাবেঈগণের মাঝে তাঁদের কয়েকজন হলেন- আত্বা, তা‘উস, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, ইবনে সিরীন, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, শা‘বী, হাকাম রহ. প্রমুখ। ইবনুল মুনযির রাহ. বলেছেন, একই মত পোষণ করেছেন মুজাহিদ, হাম্মাদ ও সুফইয়ান ছাওরী রাহ.। ইমাম মালেক রাহ. বলেছেন, জানাযায় ফাতিহা পড়ার ওপর আমাদের শহরে (মদীনা) আমল করা হয় না। (উমদাতুল কারী, ৮ : ১৩৯)
এমনকি প্রায় প্রত্যেক ইসলামী শহরের বড় বড় তাবেয়ী মনীষীও জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার প্রবক্তা ছিলেন না।
(১) মদীনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-কে জিজ্ঞাসা করা হল, জানাযার নামাযে কি (কুরআন) পড়া আছে? তিনি বললেন, ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া নেই।’ -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫৩২
(২) মক্কা মুকাররমার বিখ্যাত তাবেয়ী প্রায় দুশো সাহাবীর সাহচর্যধন্য মুহাদ্দিস আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. জানাযার নামাযে কুরআন পড়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৯
(৩) কুফা নগরীর বিখ্যাত তাবেয়ী প্রায় পাঁচশ সাহাবীর সাক্ষাতধন্য প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদ ইমাম আমের ইবনে শারাহীল আশশা‘বী রাহ. বলেন, ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া নেই’। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৮
শা‘বী রাহ. আরো বলেন, ‘জানাযার নামাযের প্রথম তাকবীরে আল্লাহর প্রশংসা করবে, দ্বিতীয় তাকবীরের পরে দরূদ পড়বে, তৃতীয় তাকবীরের পরে মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করবে, চতুর্থ তাকবীর দিয়ে সালাম ফিরাবে’। -মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৪৯৬
কুফা-নগরীর আরেক তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. থেকেও এ নিয়ম বর্ণিত হয়েছে-
قَالَ مُحَمَّدٌ وَأَخْبَرَنَا سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ، عَنْ أَبِي هَاشِمٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ النَّخَعِيِّ، قَالَ: الْأُولَى: الثَّنَاءُ عَلَى اللَّهِ، وَالثَّانِيَةُ: صَلَاةٌ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَالثَّالِثَةُ: دُعَاءٌ لِلْمَيِّتِ، وَالرَّابِعَةُ: سَلَامٌ تُسَلِّمُ. قَالَ مُحَمَّدٌ: وَبِهِ نَأْخُذُ. وَهُوَ قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ.
ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. সুফইয়ান ছাওরী হতে, তিনি আবু হাশেম হতে, তিনি ইব্রাহীম নাখাঈ রাহ. হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, প্রথম: আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা (ছানা পড়া)। দ্বিতীয়: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাআহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পড়া। তৃতীয়: মায়্যেতের জন্য দু‘আ করা। চতুর্থ: সালাম (ফিরিয়ে শেষ করা)। ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. বলেন, আমরা এটাই গ্রহণ করি। আর এটাই ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মত। (ইমাম মুহাম্মাদ রাহ., আল-আছার, ২৩৮)
(৪) বসরা নগরীর বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়তেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪৩২
(৫) ইয়ামানের বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাউস রাহ.-ও জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৯
উল্লেখ্য, ইসলামী উলূমের দুই মারকায মাদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে জানাযার নামাযে কুরআন পড়ার কোনো প্রচলন ছিল না।
মাদীনাবাসীর আমল
ইমাম মালিক রাহ. বলেন,
ليس ذلك بمعمول به ببلدنا إنما هو الدعاء، أدركت أهل بلدنا على ذلك.
অর্থ: জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়ার কোনো প্রচলন আমাদের এ শহরে (মাদীনায়) নেই। জানাযা হল দুআ করা। আমি আমার শহরের অধিবাসীদের এর উপরেই পেয়েছি। -আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা ১/১৬৭
কুফাবাসীর আমল
ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন,
وقال بعض أهل العلم : لا يقرأ في الصلاة على الجنازة إنما هو الثناء على الله والصلاة على نبيه صلى الله عليه وسلم والدعاء للميت وهو قول الثوري وغير واحد من أهل الكوفة.
অর্থ: আর কতক আহলে ইলম বলেন : ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া হবে না এ তো শুধু আল্লাহর প্রশংসা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ এবং মাইয়েতের জন্য দুআ। এটা সুফিয়ান ছাওরী রাহ. এবং কুফার একাধিক মনীষীর কওল-অভিমত। -জামে তিরমিযী ১০১১ নং হাদীসের অধীনে
উপরের আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকজন সাহাবী ও তাবেয়ীর আছর উল্লেখ করলাম যারা কেউই জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার প্রবক্তা নন। সেই সাথে এটাও জানতে পারলাম যে, ইসলামের দুই কেন্দ্রভ‚মি মদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার কোনো প্রচলন ছিল না। এতদসত্তে¡ও আমাদের গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের এই কথা বলা যে, ‘সূরা ফাতিহা ছাড়া জানাযার নামায হয় না’- বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়।
এটা ঠিক যে, ইবনে আব্বাস রা.সহ দু’একজন সাহাবী জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়েছেন। কিন্তু ‘সূরা ফাতিহা না পড়লে জানাযার নামায হয় না’ এমন কোনো ফাতোয়া তাঁরা দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই।
ঐ বন্ধুদের ব্যাপারে আমাদের অনুযোগ এটিই যে, তাঁরা সাহাবা-যুগ থেকে চলে আসা একাধিক পদ্ধতি সম্বলিত বিষয়গুলোতে একটি পদ্ধতিকে গ্রহণ করেন এবং অন্য পদ্ধতিকে বাতিল, ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। অথচ জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা না পড়ার নিয়ম খাইরুল কুরূন তথা সাহাবা-তাবেয়ীযুগে ব্যাপকভাবে চর্চিত ও অনুসৃত ছিল। মদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে সূরা ফাতিহা পড়ার কোনো প্রচলনই ছিল না। এতে বোঝা যায় জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা না পড়ার নিয়মটিই অধিক শক্তিশালী।
[টীকা : মাশাআল্লাহ জানাযায় সূরা ফাতিহা বিষয়ে আমাদের কাছে দুটি প্রবন্ধ এসেছে। আলহামদুলিল্লাহ উভয় প্রবন্ধই ভাল। একটি মাওলানা আবু উমার রুহুল্লাহ নোমানীর অপরটি মাওলানা রাইয়ানের। যেহেতু দ্বিতীয় প্রবন্ধটি বেশি সহজ ও সাবলীল ছিল তাই দ্বিতীয়টি প্রকাশ করা হল এবং অপরটি থেকে কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় এই প্রবন্ধে অন্তর্ভুক্ত করা হল। আল্লাহ তাআলা উভয় লেখককে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আমাদেরকে তাদের লেখা থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন। -সম্পাদক]
http://www.alkawsar.com/article/1310
সেদিন গাজীপুর থেকে এক মসজিদের ইমাম ছাহেব ফোন করে জানালেন,তাঁর এলাকায় গত কয়েকদিন আগে এক ব্যক্তির ইন্তেকাল হয়। ঘটনাক্রমে সেই সময় তিনি এবং এলাকার অন্যান্য ইমাম উপস্থিত না থাকায় এক গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধু জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। নামায শেষে তিনি এলাকার মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন ‘এতদিন যত জানাযার নামায পড়েছেন কোনোটাই হয়নি। কেননা জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ফরয। যেহেতু এতদিন এই ফরযের উপর আমল হয়নি তাই কোনো জানাযার নামাযই সহীহ হয়নি। তার এই বক্তব্যে সেই এলাকায় ব্যাপক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।
অথচ জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ফরয হওয়া তো অনেক দুরের বিষয় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন এ মর্মে কোনো সহীহ হাদীস আছে বলে আমাদের জানা নেই। এ প্রসঙ্গে হাফেয ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়, যাকে আমাদের ঐ বন্ধুরাও নিজেদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করে থাকেন। তিনি বলেছেন:
ويذكر عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه أمر أن يقرأ على الجنازة بفاتحة الكتاب ولا يصح إسناده
অর্থ: নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-থেকে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর সনদ সহীহ নয়। -যাদুল মা‘আদ ১/৪৮৬
মূলত জানাযার নামায সাহাবায়ে কেরাম মৌখিক বর্ণনার পরিবর্তে প্রায়োগিক পদ্ধতিতেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বেশি হাসিল করেছেন। পরবর্তীতে তা‘আমুল এবং তাওয়ারুছের মাধ্যমে তাবেয়ীগণ সাহাবাদের থেকে তা হাসিল করেছেন। আর সাহাবা-তাবেয়ীগণ এবং খাইরুল কুরূনের ব্যাপক কর্মধারা সামনে রাখলে বুঝা যায় যে, তাঁদের অধিকাংশই জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না। আমরা প্রথমে সাহাবীদের তারপর তাবেয়ীদের কিছু আছার নিচে উল্লেখ করছি।
(১) খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর আমল
قال ابن أبي شيبة : حدثنا محمد بن فضيل عن العلاء بن المسيب عن أبيه عن علي أنه كان إذا صلى على ميت يبدأ يحمد الله ويصلى على النبي صلى الله عليه وسلم ثم يقول : اللهم اغفر لأحيائنا و أمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا .
অর্থ: হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোনো মায়্যেতের জানাযার নামায পড়তেন তখন প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করতেন তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়তেন অতপর এই বলে দুআ করতেন :
اللهم اغفر لأحيائنا وأمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا.
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৪৯৪
এই বর্ণনার রাবীগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য। এই আছর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, হযরত আলী রা. জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না।
(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর আমল
مالك عن نافع أن عبد الله بن عمر كان لا يقرأ في الصلاة على الجنازة
অর্থ: নাফে রাহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়তেন না। -মুয়াত্তা মালিক, হাদীস ৫২৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৫২২
এই আছরটিও বিশুদ্ধতম সনদে বর্ণিত। এখানেও স্পষ্টভাবে বলা হল, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জানাযার নামাযে কুরআন পড়তেন না।
(৩) হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর আমল এবং তালীম
ما لك عن سعيد بن أبي سعيد المقبري عن أبيه أنه سأل أبا هريرة كيف تصلي على الجنازة؟ فقال أبو هريرة أنا لعمر الله أخبرك أتبعها من أهلها فإذا وضعت كبرت وحمدت الله وصليت على نبيه ثم أقول اللهم إنه عبدك وابن عبدك وابن أمتك كان يشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا عبدك ورسولك وأنت أعلم به اللهم إن كان محسنا فزد في إحسانه وان كان مسيئا فتجاوز عن سيئاته اللهم لا تحرمنا أجره ولا تفتـنا بعده.
অর্থ: আবু সাঈদ মাকবুরী থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আবু হুরায়রা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কীভাবে জানাযার নামায পড়েন? আবু হুরাইরা রা. বললেন, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি তোমাকে বলব। আমি মায়্যেতের (ঘর থেকে) পরিবারের সাথে আসি। অতপর যখন মায়্যেতকে রাখা হয় আমি তাকবীর দেই এবং আল্লাহর প্রশংসা করি। তারপর নবীর উপর দরূদ পড়ি। অতপর এই দুআ করি... اللهم।
-মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ৫২১; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৪৯৫
এই আছরেরও সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। এখান থেকেও বোঝা গেল, হযরত আবু হুরায়রা রা. জানাযার নামাযে কুরআন পড়তেন না।
(৪) উবাদা ইবনে ছামিত রা.-এর ফরমান
عن أبي هريرة أنه سأل عبادة بن الصامت عن الصلاة على الميت فقال أنا والله أخبرك تبدأ فتكبر ثم تصلي على النبي صلى الله عليه وسلم، وتقول اللهم إن عبدك فلانا كان لا يشرك بك شيئا، أنت أعلم به، إن كان محسنا فزد في إحسانه وإن كان مسيئا فتجاوز عنه، اللهم لا تحرمنا أجره ولا تضلنا بعده.
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি উবাদা ইবনে ছামিত রা.-কে জানাযার নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি তোমাকে বলব, তুমি সর্বপ্রথম তাকবীর দিয়ে নামায শুরু করবে। অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়বে এবং এই দুআ পড়বে ... اللهم
-সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪/৪০
উল্লেখ্য : জানাযার নামাযে ফাতিহা পাঠ প্রমাণ করার জন্য গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুগণ হযরত উবাদা ইবনে ছামিত রা.-এর সূত্রে বর্ণিত এ প্রসিদ্ধ হাদীস উদ্ধৃত করে থাকেন-
لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب.
‘যে ফাতিহাতুল কিতাব পড়েনি তার নামায নেই।’-সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫৬
অথচ উপরোক্ত বর্ণনায় পাওয়া গেল যে, স্বয়ং উবাদা ইবনুস সামিত রা.-ই জানাযার নামায ফাতিহা ছাড়া পড়ার নিয়ম জানতেন ও মানতেন। সাহাবী আবু হুরায়রা রা.-এর প্রশ্নের উত্তরে তিনি এই নিয়মেরই উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা রা.-ও এ নিয়ম জানতেন ও মানতেন। ইতিপূর্বে তাঁর বিবরণও উল্লেখিত হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকেও সহীহ মুসলিমে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে-
لا صلاة إلا بقراءة
(কুরআন) পড়া ছাড়া নামায নেই। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯৬
এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, তাঁরা ‘সালাতুল জানাযা’কে এই হাদীসের বিধানের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না। বরং এ পর্যন্ত উল্লেখিত বড় বড় মনীষী সাহাবীর কর্ম ও সিদ্ধান্ত এবং মুসলিম জাহানের বড় বড় কেন্দ্রগুলোর প্রতিষ্ঠিত কর্মধারাও একথাই প্রমাণ করে যে, ‘সালাতুল জানাযা’ উপরোক্ত হাদীসের নির্দেশনার আওতাভুক্ত নয়। সুতরাং এ হাদীসকে সালাতুল জানাযার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা শুধু দলীলহীন প্রয়োগ নয়; দলীলবিরোধী প্রয়োগ বটে।
সালাতুল জানাযার হাকীকত হচ্ছে এটি দুআ। মাইয়েতের জন্য দুআ। একারণে দুআর ভূমিকা হিসেবে ‘ছানা’ (আল্লাহর প্রশংসা) ও ‘সালাত’ (দরূদ) পাঠ করা হয়। ইমাম মালিক রাহ. বলেছেন-
إنما هو الدعاء
‘এ তো দুআ’-আল মুদাওওয়ানা ১ : ২৫১
আর সালাতুল জানাযা যে সাধারাণ সালাতের মতো নয় এ তো বলাই বাহুল্য। এতে রুকু-সিজদা নেই, কা’দা-তাশাহহুদ নেই। সুতরাং একে সাধারণ সালাতের মধ্যে কীভাবে শামিল করা যায়? এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত তাবেয়ী আবুল আলিয়া রাহ.-এর একটি বাণী মনোযোগের দাবিদার। আবুল মিনহাল বলেন-
سَأَلْتُ أَبَا الْعَالِيَةِ عَنِ الْقِرَاءَةِ فِي الصَّلَاةِ عَلَى الْجِنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَقَالَ: “مَا كُنْتُ أَحْسَبُ أَنَّ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ تُقْرَأُ إِلَّا فِي صَلَاةٍ فِيهَا رُكُوعٌ وَسُجُودٌ”
আমি আবুল আলিয়া রাহ.-কে সালাতুল জানাযায় ফাতিহা পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি (আশ্চর্য হয়ে) বললেন, আমার তো ধারণাও ছিল না যে, ফাতিহাতুল কিতাব রুকু-সিজদা বিশিষ্ট সালাত ছাড়া অন্য কোনো সালাতে পড়া হবে?! -আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৪
আবুল আলিয়া রাহ. প্রথম সারির তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত। বিশুদ্ধ মত অনুসারে ৯৩ হিজরীতে তাঁর ইন্তিকাল। (তাহযীবুল কামাল ও তাহযীবুত তাহযীব)
বিখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা কাসানী রাহ. (মৃত্যু ৫৮৭ হি.) এ বাস্তবতা এভাবে বর্ণনা করেছেন-
وَقَوْلُهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ “لَا صَلَاةَ إلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ” وَلَا صَلَاةَ إلَّا بِقِرَاءَةٍ لَا يَتَنَاوَلُ صَلَاةَ الْجِنَازَةِ؛ لِأَنَّهَا لَيْسَتْ بِصَلَاةٍ حَقِيقَةً إنَّمَا هِيَ دُعَاءٌ وَاسْتِغْفَارٌ لِلْمَيِّتِ، أَلَا تَرَى أَنَّهُ لَيْسَ فِيهَا الْأَرْكَانُ الَّتِي تَتَرَكَّبُ مِنْهَا الصَّلَاةُ مِنْ الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ إلَّا أَنَّهَا تُسَمَّى صَلَاةً لِمَا فِيهَا مِنْ الدُّعَاءِ، وَاشْتِرَاطُ الطَّهَارَةِ، وَاسْتِقْبَالُ الْقِبْلَةِ فِيهَا لَا يَدُلُّ عَلَى كَوْنِهَا صَلَاةً حَقِيقِيَّةً كَسَجْدَةِ التِّلَاوَةِ؛
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ‘লা সালাতা ইল্লা বিফাতিহাতিল কিতাব’ ও‘লা সালাতা ইল্লা বি কিরাআ’ সালাতুল জানাযাকে শামিল করে না। কারণ মূলত তা ‘সালাত’ নয়। মাইয়েতের জন্য দুআ ও ইস্তিগফার। লক্ষ করুন, যে সকল ‘রোকন’ দ্বারা সালাত যেমন রুকু-সিজদা, তা-ই তো এতে নেই। একে ‘সালাত’ বলা হয় কারণ তা দুআ। আর পবিত্রতা ও কিবলামুখী হওয়া জরুরি হওয়ার দ্বারা তা হাকীকী সালাত হওয়া প্রমাণ হয় না। কারণ ওগুলো তো তিলাওয়াতের সিজদাতেও জরুরি। -বাদায়েউস সানায়ে ১ : ৩১৪
উপরের আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকজন সাহাবীর আছার উল্লেখ করলাম যারা জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না। এটিই ছিল সাহাবা-যুগের সাধারণ আমল। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর একটি বক্তব্য সম্পর্কেও কিছু আলোচনা করা দরকার, যা গায়রে মুকাল্লিদ বন্ধুরা তাদের ‘দলীল’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আছরটি এই-
عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَوْفٍ، قَالَ: صَلَّيْتُ خَلْفَ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الكِتَابِ قَالَ: لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ
ত্বলহা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আওফ রাহ. বলেন- আমি ইবনে আব্বাস রা.-এর পেছনে জানাযার নামায আদায় করেছি। নামাযে তিনি সূরা ফাতিহা পড়েছেন। (নামায শেষে) বলেছেন, (আমি ফাতিহা পড়েছি) যাতে লোকেরা জানতে পারে যে, এটা সুন্নাহ। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৩৫
এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা এই যে, স্বয়ং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে ফাতিহা ছাড়া সালাতুল জানাযার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ী আবু হামযা রাহ. বলেন-
قلت له : كيف أصلي في الكعبة؟
আমি তাঁকে (ইবনে আব্বাস রা.- কে) জিজ্ঞাসা করলাম, কা‘বার ভিতরে নামায কীভাবে পড়ব? তিনি উত্তরে বললেন-
كما تصلي في الجنازة تسبح وتكبر ولا تركع ولا تسجد ثم عند أركان البيت سبح وكبر وتضرع واستغفر، ولا تركع ولا تسجد
যেভাবে সালাতুল জানাযা পড়; তাসবীহ পড়বে, তাকবীর দিবে, তবে রুকু-সিজদা করবে না। এরপর বাইতের রোকনগুলোর কাছে তাসবীহ করবে, তাকবীর দিবে, রোনাযারি করবে ও ইস্তিগফার করবে। তবে রুকু করবে না ও সিজদা করবে না। -ফতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী ৩ : ৪৬৯
এ বর্ণনার সনদ সহীহ।
লক্ষ্য করুন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কুরআন তিলাওয়াতের উল্লেখ করেননি। এখানে মনে রাখতে হবে যে, ইবনে আব্বাস রা. কা‘বার ভিতরে নামায পড়াকে মাকরূহ মনে করতেন। তিনি মনে করতেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কা‘বার ভিতরে নামায পড়া বিষয়ে যে বর্ণনাগুলো আছে তাতে ‘সালাত’ অর্থ দুআ, নামায নয়।
দ্বিতীয় কথা এই যে, ইতিপূর্বে উল্লেখিত সহীহ রেওয়ায়েতসমূহ থেকে জানা যায় যে, জানাযার নামাযে আল্লাহর হামদ-ছানা ও দুআ করা কর্তব্য। তবে এর জন্য কোনো দুআ-কালাম নির্ধারিত করে দেওয়া হয়নি। সুতরাং কেউ যদি সূরা ফাতিহার দ্বারা আল্লাহর হামদ ও দুআ করেন একে বিদআত বলার সুযোগ নেই। সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো থেকে বর্ণিত ফাতিহা-পাঠের এ ব্যাখ্যাও হতে পারে। তাহলে সালাফের যুগ থেকে চলে আসা মুসলিম জাহানের সাধারণ কর্ম-ধারা ও বড় বড় মনীষী সাহাবীর কর্ম ও সিদ্ধান্তের সাথে তাদের কর্মের কোনো সংঘাত থাকে না। ইমাম তাহাবী রাহ. বলেছেন-
لعل قراءة من قرأ الفاتحة من الصحابة كان على وجه الدعاء لا على وجه التلاوة.
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ যে ফাতিহা পাঠ করেছেন বলে পাওয়া যায় সম্ভবত সেটি ছিল দুআ হিসেবে, কুরআন তিলাওয়াত হিসেবে নয়। -উমদাতুল ক্বারী ৮/১৪১
আল্লামা ইবনে বাত্তাল রাহ. বলেন-
وَمِمَّنْ كَانَ لَا يقْرَأ فِي الصَّلَاة على الْجِنَازَة وينكر: عمر بن الْخطاب وَعلي بن أبي طَالب وَابْن عمر وَأَبُو هُرَيْرَة، وَمن التَّابِعين: عَطاء وطاووس وَسَعِيد بن الْمسيب وَابْن سِيرِين وَسَعِيد بن جُبَير وَالشعْبِيّ وَالْحكم، وَقَالَ ابْن الْمُنْذر: وَبِه قَالَ مُجَاهِد وَحَمَّاد وَالثَّوْري، وَقَالَ مَالك: قِرَاءَة الْفَاتِحَة لَيست مَعْمُولا بهَا فِي بلدنا فِي صَلَاة الْجِنَازَة،
যাঁরা জানাযায় ফাতিহা পড়তেন না, বরং ইনকার করতেন, তাঁদের কয়েকজন হলেন- ওমর ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবি তালিব, ইবনে ওমর, আবু হুরাইরা রা.। আর তাবেঈগণের মাঝে তাঁদের কয়েকজন হলেন- আত্বা, তা‘উস, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, ইবনে সিরীন, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, শা‘বী, হাকাম রহ. প্রমুখ। ইবনুল মুনযির রাহ. বলেছেন, একই মত পোষণ করেছেন মুজাহিদ, হাম্মাদ ও সুফইয়ান ছাওরী রাহ.। ইমাম মালেক রাহ. বলেছেন, জানাযায় ফাতিহা পড়ার ওপর আমাদের শহরে (মদীনা) আমল করা হয় না। (উমদাতুল কারী, ৮ : ১৩৯)
এমনকি প্রায় প্রত্যেক ইসলামী শহরের বড় বড় তাবেয়ী মনীষীও জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার প্রবক্তা ছিলেন না।
(১) মদীনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-কে জিজ্ঞাসা করা হল, জানাযার নামাযে কি (কুরআন) পড়া আছে? তিনি বললেন, ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া নেই।’ -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫৩২
(২) মক্কা মুকাররমার বিখ্যাত তাবেয়ী প্রায় দুশো সাহাবীর সাহচর্যধন্য মুহাদ্দিস আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. জানাযার নামাযে কুরআন পড়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৯
(৩) কুফা নগরীর বিখ্যাত তাবেয়ী প্রায় পাঁচশ সাহাবীর সাক্ষাতধন্য প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদ ইমাম আমের ইবনে শারাহীল আশশা‘বী রাহ. বলেন, ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া নেই’। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৮
শা‘বী রাহ. আরো বলেন, ‘জানাযার নামাযের প্রথম তাকবীরে আল্লাহর প্রশংসা করবে, দ্বিতীয় তাকবীরের পরে দরূদ পড়বে, তৃতীয় তাকবীরের পরে মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করবে, চতুর্থ তাকবীর দিয়ে সালাম ফিরাবে’। -মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৪৯৬
কুফা-নগরীর আরেক তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. থেকেও এ নিয়ম বর্ণিত হয়েছে-
قَالَ مُحَمَّدٌ وَأَخْبَرَنَا سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ، عَنْ أَبِي هَاشِمٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ النَّخَعِيِّ، قَالَ: الْأُولَى: الثَّنَاءُ عَلَى اللَّهِ، وَالثَّانِيَةُ: صَلَاةٌ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَالثَّالِثَةُ: دُعَاءٌ لِلْمَيِّتِ، وَالرَّابِعَةُ: سَلَامٌ تُسَلِّمُ. قَالَ مُحَمَّدٌ: وَبِهِ نَأْخُذُ. وَهُوَ قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ.
ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. সুফইয়ান ছাওরী হতে, তিনি আবু হাশেম হতে, তিনি ইব্রাহীম নাখাঈ রাহ. হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, প্রথম: আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা (ছানা পড়া)। দ্বিতীয়: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাআহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পড়া। তৃতীয়: মায়্যেতের জন্য দু‘আ করা। চতুর্থ: সালাম (ফিরিয়ে শেষ করা)। ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. বলেন, আমরা এটাই গ্রহণ করি। আর এটাই ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মত। (ইমাম মুহাম্মাদ রাহ., আল-আছার, ২৩৮)
(৪) বসরা নগরীর বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়তেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪৩২
(৫) ইয়ামানের বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাউস রাহ.-ও জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৯
উল্লেখ্য, ইসলামী উলূমের দুই মারকায মাদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে জানাযার নামাযে কুরআন পড়ার কোনো প্রচলন ছিল না।
মাদীনাবাসীর আমল
ইমাম মালিক রাহ. বলেন,
ليس ذلك بمعمول به ببلدنا إنما هو الدعاء، أدركت أهل بلدنا على ذلك.
অর্থ: জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়ার কোনো প্রচলন আমাদের এ শহরে (মাদীনায়) নেই। জানাযা হল দুআ করা। আমি আমার শহরের অধিবাসীদের এর উপরেই পেয়েছি। -আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা ১/১৬৭
কুফাবাসীর আমল
ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন,
وقال بعض أهل العلم : لا يقرأ في الصلاة على الجنازة إنما هو الثناء على الله والصلاة على نبيه صلى الله عليه وسلم والدعاء للميت وهو قول الثوري وغير واحد من أهل الكوفة.
অর্থ: আর কতক আহলে ইলম বলেন : ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া হবে না এ তো শুধু আল্লাহর প্রশংসা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ এবং মাইয়েতের জন্য দুআ। এটা সুফিয়ান ছাওরী রাহ. এবং কুফার একাধিক মনীষীর কওল-অভিমত। -জামে তিরমিযী ১০১১ নং হাদীসের অধীনে
উপরের আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকজন সাহাবী ও তাবেয়ীর আছর উল্লেখ করলাম যারা কেউই জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার প্রবক্তা নন। সেই সাথে এটাও জানতে পারলাম যে, ইসলামের দুই কেন্দ্রভ‚মি মদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার কোনো প্রচলন ছিল না। এতদসত্তে¡ও আমাদের গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের এই কথা বলা যে, ‘সূরা ফাতিহা ছাড়া জানাযার নামায হয় না’- বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়।
এটা ঠিক যে, ইবনে আব্বাস রা.সহ দু’একজন সাহাবী জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়েছেন। কিন্তু ‘সূরা ফাতিহা না পড়লে জানাযার নামায হয় না’ এমন কোনো ফাতোয়া তাঁরা দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই।
ঐ বন্ধুদের ব্যাপারে আমাদের অনুযোগ এটিই যে, তাঁরা সাহাবা-যুগ থেকে চলে আসা একাধিক পদ্ধতি সম্বলিত বিষয়গুলোতে একটি পদ্ধতিকে গ্রহণ করেন এবং অন্য পদ্ধতিকে বাতিল, ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। অথচ জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা না পড়ার নিয়ম খাইরুল কুরূন তথা সাহাবা-তাবেয়ীযুগে ব্যাপকভাবে চর্চিত ও অনুসৃত ছিল। মদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে সূরা ফাতিহা পড়ার কোনো প্রচলনই ছিল না। এতে বোঝা যায় জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা না পড়ার নিয়মটিই অধিক শক্তিশালী।
[টীকা : মাশাআল্লাহ জানাযায় সূরা ফাতিহা বিষয়ে আমাদের কাছে দুটি প্রবন্ধ এসেছে। আলহামদুলিল্লাহ উভয় প্রবন্ধই ভাল। একটি মাওলানা আবু উমার রুহুল্লাহ নোমানীর অপরটি মাওলানা রাইয়ানের। যেহেতু দ্বিতীয় প্রবন্ধটি বেশি সহজ ও সাবলীল ছিল তাই দ্বিতীয়টি প্রকাশ করা হল এবং অপরটি থেকে কিছু প্রয়োজনীয় বিষয় এই প্রবন্ধে অন্তর্ভুক্ত করা হল। আল্লাহ তাআলা উভয় লেখককে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আমাদেরকে তাদের লেখা থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন। -সম্পাদক]
http://www.alkawsar.com/article/1310