আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন বতুতা এর ভ্রমন কাহিনী
প্রথম মুসলিম পর্যটক যিনি তার সফর এর ঘটনা গুলো লিখে গিয়েছেন। যদিও সাহাবা (রাঃ) এর দ্বীনী দাওয়াতী সফর এর থেকেও অনেক বেশি ও দীর্ঘ ছিল
ব্যাক্তিগত জীবন
নামঃ ইবন বতুতা / Ibn Battuta/ أبو عبد الله محمد بن عبد الله اللواتي الطنجي بن بطوطة
জন্মঃ ১৩০৪ খ্রীঃ
মৃত্যুঃ ১৩৬৯ খ্রী
আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন বতুতা হলেন একজন ধর্মতাত্ত্বিক মানুষ ।ইবন বতুতা ১৩০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী মরোক্কোর তাঞ্জিয়ারে জন্মগ্রহন করেন। ইবন বতুতা চীন সহ পৃথিবীর অনেক দেশে ও স্থানে তিনি শামস-উদ-দীন নামেও পরিচীত ছিলেন এবং আছেন। ইবন বতুতা সারা জীবন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেরিয়েছেন। পৃথিবী ভ্রমণের জন্যই তিনি মূলত বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি একুশ বছর থেকে শুরু করে জীবনের পরবর্তী ৩০ বছরে প্রায় ৭৫০০০ মাইল ১২০০০০কিঃমিঃ অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছেন। তিনিই একমাত্র পরিব্রাজক যিনি তার সময়কার সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন এবং এর সুলতানদের সাথে স্বাক্ষাত করেছেন। অর্থাৎ বর্তমান পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুরু করে মিশর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং চীনও ভ্রমণ করেছিলেন। তার কিছুকাল পূর্বে এমন দীর্ঘ ভ্রমণ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ভেনিসের ব্যবসায়ী এবং পরিব্রাজক মার্কো পোলো। কিন্তু তিনি মার্কো পোলোর চেয়েও তিনগুন বেশি পথ সফর করেছিলেন। ভ্রমণকালে তিনি এই উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সুফি, সুলতান, কাজি এবং আলেমদের সাক্ষাত লাভ করেন। ৩০ বছরে প্রায় ৪০ টি দেশ ভ্রমণ করে নিজ দেশ মরোক্কোতে ফেরার পর মরোক্কোর সুলতান আবু ইনান ফারিস তার ভ্রমণকাহিনীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার জন্য একজন সচিব নিয়োগ করেন। এই ভ্রমণকহিনীর নাম "রিহলা"। এটি ১৪শ শতকের পূর্ব মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইবন বতুতা এর প্রথম জীবন
ইবন বতুতা তার গ্রন্থে নিজের সম্পর্কে যতটুকু লিখেছেন তার চেয়ে বেশি আর কিছু জানা সম্ভব হয় নি। তিনি ১৩০৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী মরোক্কোর তাঞ্জিয়ারে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।তার পিতা ছিলেন একজন কাজী। তার ধারনা মতে তার পরিবার পশ্চিম আফ্রিকার লাওয়াতা যাযাবর জাতীদের উত্তরশুরী। তার পরিবার সুন্নি মতবাদের অনুসারী হওয়ায় কিশোর বয়স থেকেই তিনি ইসলাম ধর্মের উপর শিক্ষা লাভ করেন। ১৩২৫ সালে তার বয়স যখন ২১ বছর হয় তখন তিনি হজ্জ্বব্রত পালনের লক্ষে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সে সময় সাধারনত মরোক্কো থেকে হজ্জ্ব করে ফিরতে হাজীদের ১৫ থেকে ১৬ মাস সময় লাগতো কিন্তু এই মহান পরিব্রাজক অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে তিনবার হজ্জ করে তার জন্মভূমিতে ফিরেছিলেন চব্বিশ বছর পর।
হজ্জ্ব পালন এবং মোহাম্মাদ (সাঃ) এর রওজা মোবারক জিয়ারতের আকাঙ্খা নিয়ে আমি যেদিন জন্মভূমি তাঞ্জিয়ার ছেড়ে মক্কার পথে যাত্রা করলাম সেদিন ছিল হিজরি ৭২৫ সালের ২রা রজব ১৪ই জুন ১৩২৫, বৃহস্পতিবার। সেই হিসাব মতে তখন আমার বয়স ২২ বছর ২১ বছর ৪ মাস। পথে সঙ্গী হিসাবে কাউকে না পেয়ে বা কোন কাফেলার খোঁজ না পেয়ে আমি একাই বেরিয়ে পড়ি। তখন আমার মা বাবা বেঁচে ছিলেন। তাদের ছেড়ে আসার পর্বটা খুব কঠিন ছিল বিদায়ের সময় ভীষন কষ্ট হচ্ছিল আমাদের সবার।
ইবন বতুতা এর মক্কায় প্রথম হজ্জ্ব
১৩২৫ সালের ১৪ ই জুন তারিখে ইবন বতুতার বয়স ছিল ২১ বছর ৪ মাস। এ সময় তিনি মক্কা নগরীতে গিয়ে হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি ত্যাগ করেন। সে হিসেবে তার যাত্রার সূচনা হয় ১৩২৫ সালের ১৪ জুন মরক্কোর তানজিয়ার থেকে।
হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে তিনি উত্তর আফ্রিকার সমূদ্র তীর ঘেঁষে পায়ে হেটে মক্কার উদ্ধেশে রওনা হন। সেই পথে তিনি আব্দ আল ওয়াদিদ এবং হাফসিদ সম্রাজ্য, তিমসান, বিজাইরা এবং তিউনিস হয়ে মক্কায় পৌছান। যাত্রা পথে তিনি তিউনিসে দুই মাস আবস্থান করেছেন। আরব বেদুইনদের থেকে নিরাপদ থাকতে এবং অন্যান্য সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কাফেলার সাথে এই পথ অতিক্রম করেন তিনি। তখন তিউনিসের সুলতান ছিলেন আবু ইয়াহিয়া। ১৩২৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে উপকূলীয় পথে সাফাক্স হয়ে কাবিস শহরে পৌছান। এই কাবিস শহরে তিনি তিউনিসের এক উকিলের মেয়েকে চুক্তিতে বিয়ে করেন। কিন্তু পরবর্তিতে ত্রিপলি আসতে আসতে উকিলের সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ায় এই বিয়ে বেশিদিন টেকে নি। অবশ্য ত্রিপলির পরবর্তি শহর ফেজে এসে তিনি এক ছাত্রের মেয়েকে বিয়ে করেন। ১৩২৬ সালের ৫ই এপ্রিল ইবন বতুতা তৎকালিন বাহরি মামলুক সালতানাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেক্সান্দ্রিয়া পৌছান। আলেক্সান্দ্রিয়ায় তিনি ২জন ধার্মিক তপস্বীর সাথে স্বাক্ষাত করেন। তাদের একজন হলেন শেখ বোরহানউদ্দিন তিনি ইবনে বতুতাকে তার বিশ্ব ভ্রমণ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবানী করেন যে আমার মনে হচ্ছে তুমি বিদেশ ভ্রমন পছন্দ করো। তুমি ভারতে আমার ভাই ফরিদউদ্দিন সিন্ধু প্রদেশ রুকনউদ্দিন এবং চীনে বুরহানউদ্দিনের সাথে দেখা করবে এবং আমার শুভেচ্ছা পৌছে দেবে। অপর ব্যক্তি হলেন শেখ মুর্শিদি যিনি ইবনে বতুতার একটি স্বপ্লের অর্থ ব্যাখ্যা করেন। এই দুই ব্যক্তির সাথে স্বাক্ষাতের পূর্বে তার এতো দূর দেশ ভ্রমনের পরিকল্পনা ছিলো না কিন্তু তাদের অনুপ্রেরণায় তিনি তার বিশ্ব ভ্রমনের পরিধি আরও বিস্তার করেন। এক সপ্তাহ সেখানে থাকার পর তিনি মামলুক সালতানাতের রাজধানী কায়রো অভিমুখে যাত্রা করেন। সেই সময় কায়রো ওই এলাকার এটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিলো। কায়রোতে প্রায় ১ মাসের মত অবস্থান করার পর তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। মক্কা যাওয়ার অন্যতম পথগুলো রেখে তিনি একটি অল্প পরিচিত পথে যাবার সিদ্ধান্ত নেন যেটা নীল নদ পার হয়ে আইদাব বন্দর দিয়ে যেতে হয়। বন্দরে পৌছার পর স্থানিয় গোষ্ঠিরা তাকে কায়রো ফেরৎ যেতে বাধ্য করে। পূনরায় কায়রো পৌছে তিনি একজন সুফির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তার নাম শেখ আবুল হাসান আল সাদিদি। তিনি ইবনে বতুতাকে বলেন যে মক্কা যাওয়ার সবচেয়ে ভাল পথ হল সিরিয়া হয়ে যাওয়া কারন এই পথ ধরে গেলে হিব্রু বেথেলহেম এবং জেরুসালেম পাওয়া যায় কিন্তু দুঃখের বিষয় হল মামলুক সম্রাজ্য এই পথ ভ্রমণকারীদের ডাকাত এবং লুটেরাদের থেকে সুরক্ষিত রাখার কোন ব্যবস্থাই করে নি।রমজান মাস দামেস্কে কাটিয়ে তিনি মদিনাগামী একটি কাফেলার সাথে যোগ দেন। মদিনায় হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করে চার দিন পর তিনি মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মক্কা পৌছে হজ্জ্ব পালন করে তিনি তাঞ্জিয়ার ফিরে যাওয়ার বদলে মধ্য এশিয়ার দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
ইরাক এবং পারস্য
মক্কায় এক মাস কাটানোর পর ১৭ নভেম্বর ১৩২৬ তারিখে ইবন বতুতা আরব উপসাগর হয়ে ইরাক গামী এক কাফেলার সাথে যোগ দেন। এই দলটি মদীনার অভিমুখে যাচ্ছিলো এবং কাফেলা তাকে নাজাফ শহর পর্যন্ত নিয়ে যায় যেখানে হযরত আলী (রাঃ) এর মাজার রয়েছে। হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা। মাজার জিয়ারত শেষে তার কাফেলা ইরাকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে তিনি কাফেলার সাথে ইরাক না গিয়ে দক্ষিণ দিকে টাইগ্রিস নদী পার হয়ে বসরা শহরের দিকে রওনা হলেন। বসরা থেকে তিনি পারস্যের সবচেয়ে বিখ্যাত শহর ইস্পাহানের দিকে যাত্রা করেন। ইস্পাহান থেকে তিনি শিরাজ শহরে যান। এই শিরাজ শহরটি মোঙ্গল আক্রমণে বিপর্যস্ত ছিল। সেখান থেকে তিনি বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং ১৩২৭ সালের জুন মাসে বাগদাদ পৌছান। বাগদাদ শহরটিতে তখনও চেঙ্গিজ খানের নাতি হালাকু খানের সৈন্যবাহিনীর ১২৫৮ সালের আক্রমনের ছবি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল।বাগদাদে তিনি শেষ মোঙ্গল সম্রাট আবু সাঈদের সাথে দেখা করেন। তার উপদেশে তিনি রাজকীয় কাফেলায় যোগ দিয়ে উত্তর দিকে সিল্ক রোড হয়ে তাবরিজ শহরে যান। তৎকালিন সময়ে তাবরিজ শহর ছিল উত্তর দিক দিয়ে মোঙ্গল সাম্রাজ্যে প্রবেশের প্রধান পথ এবং অন্যতম ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র। সম্ভবত জুলাই মাসে ইবনে বতুতা পুনরায় বাগদাদের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। পথে তিনি মসুল ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি ইলখানাতে গভর্ণরের অতিথি ছিলেন এবং তিনি সিজরা জাজিরা ইবনে ওমর এবং মারদিন শহরগুলো ভ্রমন করেন। সিনজারের কাছের একটি আশ্রমে তিনি একদল কুর্দির স্বাক্ষাত পান । যাদের কাছ থেকে তিনি কিছু রূপার মুদ্রা পেয়েছিলেন।এখান থেকে তিনি আরেকটি কাফেলার সাথে যোগ দিয়ে পুনরায় আরব উপদ্বীপ হয়ে মক্কা এসে দ্বিতীয়বারের মত হজ্জ্ব করেন এবং পরবর্তী ৩ বছর মক্কাতেই তিনি অবস্থান করেন।ইবন বতুতা পরবর্তী তিন বছরের জন্য মক্কায় অবস্থান করে ১৩৩০ সালের হজ্জ্ব করেন। তবে ভ্রমনের বর্ণনায় অসঙ্গতির কারণে এই সময়কাল নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে ১৩২৮ সালের কোন সময় তিনি হজ্জ্ব পালন করেন।তারপর তিনি জেদ্দা থেকে লোহিত সাগরের তীরের দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে একটি ছোট নৌকার সাহায্যে ইয়েমেন পৌছেন। ইয়েমেনের তৎকালীন সূলতান ছিলেন নূর উদ্দীন। ইয়েমেনের তাঈজ শহরে সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ করার পর চারদিন অবস্থান করেন। তার ভ্রমণ বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে এরপর তিনি এককালীন রাজধানী সানার দিকে যাত্রা করেন । তবে সেখানকার বিস্তারিত কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি।ধারণা করা হয় ১৩২৯ থেকে ১৩৩১ এর মধ্যবর্তী কোনো সময়ে তিনি তাঈহ থেকে রওনা হয় এবং সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এডেনে আসেন।
সোমালিয়া ও সাওয়াহিলি তীর
এডেন বন্দর থেকে জাহাজে চারদিনের যাত্রা করে তিনি সোমালিয়ার তীরবর্তী জায়লা বর্তমানে বারবারাহ আরবি শব্দ বারবারাহ অর্থ আফ্রিকার শিং শহরে পৌছান। জায়লা থেকে পনেরো দিনের যাত্রা করে অবশেষে ম্যাকদ্যাশ’অ মোগাদিশু পৌছান।তার বর্ণনা মতে তখকার সময় মোগাদিসু ছিল ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র। বিভিন্ন এলাকা থেকে বণিকেরা মোগাদিসু বন্দরে গিয়ে ব্যবসা করতেন। তখন মোগাদিসু ভাল মানের একপ্রকার সূতি কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং তারা এই কাপড় মিসর সিরিয়া সহ অন্যান্য জায়গায় রফতানি করা হত। ম্যাকদ্যাশঅর তৎকালীন সুলতান ছিলেন আবু বকর।সুলতানের আতিথেয়তায় মোগাদিসুতে তিনি মোট চারদিন ছিলেন। মোগাদিশু ছেড়ে তিনি সাওয়াহিলি রওনা দেন। আরবি শব্দ আস সাওয়াহিল অর্থ উপকূলীয় এলাকা সাওয়াহি’লি তৎকালীন সময়ে “বিলদ-আল-যাঞ্জ” নামে পরিচীত ছিল যার অর্থ হল যাঞ্জদের ভূমি। যাঞ্জ শব্দটা কোন ভাষা থেকে এসেছে তা জানা যায় না তবে মধ্যযুগে আরবরা পূর্ব আফ্রিকার নিগ্রোদের এই নামে ডাকত। তার সাওয়াহিলি আসার অন্যতম কারণ ছিল কুলওয়া বর্তমানে কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ার উপকূলের কিছু অংশের নাম শহর পরিদর্শন করা। ইবন বতুতা এই শহরকে অত্যন্ত সুন্দর শহর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তার ভ্রমণের সময় এখানকার সুলতান ছিলেন আবুল মুজাফফর হাসান। তিনি ইসলামী কায়দায় সাম্রাজ্য চালানোর জন্য এবং তার দান দাখ্যিন্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার ভাই দাউদ তার বংশের সেই সুনাম রাখেন নি। আফ্রিকার এই অঞ্চলটিতে খুব ভাল জাতের ঘোড়া পাওয়া যেত। এখান থেকে প্রশিক্ষিত ঘোড়া ভারতে রফতানি হত। মৌসুমি বায়ুতে পরিবর্তন আসতে থাকলে ১৩৩০ সালে তিনি ওমান ও হরমুজ প্রণালী হয়ে পুনরায় হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশে মক্কার দিকে রওনা দেন।
কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট আন্দ্রোনিকাস তৃতীয়
মক্কায় আরো এক বছর কাটিয়ে তিনি ভারতবর্ষের সম্রাট মোহাম্মদ বিন তুঘলকের অধীনে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৩৩০ সালে তিনি গাইড এবং কাফেলার খোজে আনাতোলিয়ার বর্তমানের তুরষ্কের পূর্ব দিকে দিকে যাত্রা করেন যেখান থেকে বণিকেরা ভারতবর্ষে যেয়ে ব্যাবসা করে। সিরিয়ার লাতাকিয়া বন্দর থেকে একটি জাহাযে করে তুরস্কের দক্ষিণ দিকে আলানা পৌছান। তারপর পায়ে হেটে কুনিয়া হয়ে কৃষ্ণ সাগরের তীরে পৌছান।সিনোপ হয়ে আজাক Azaq পরবর্তীতে Azov শহরে পৌছে সেখানকার খানদের আমিরেরের সাথে দেখা করেন। আজাকে পৌছে দেখলেন যে আমীর উজবেক খানের রাজধনী সারা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই দেখে ইবন বতুতা তার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে আমীর তাকেও সাথে নেন।
উজবেক খানের রাজত্বকালে গোল্ডেন হোর্ডের পতাকা
ত্রোয়োদশ শতাব্দিতে প্রতিষ্ঠিত খান সম্রাজ্য পরে ব্লু হোর্ড ও হোয়াইট হোর্ড নামে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ব্লু হোর্ড এলাকা ছিল কিয়েভ বর্তমানে ইউক্রেনের রাজধানী থেকে ককেশাস আরাল সাগর এবং খিবা পর্যন্ত। সুলতান মোহাম্মদ উজবেক খান ছিলেন ব্লু হোর্ড খানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী।যাত্রা পথে আস্ত্রখানে সুলতানের মহল্লার ভ্রাম্যমান গ্রাম এর দেখা পাওয়া যায়। সেই মহল্লাতেই সুলতান তুঘলক খানের সাথে ইবন বতুতার প্রথম আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই সাথে তিনি সুলতানের স্ত্রীদের সাথেও সাক্ষাৎ করেন এবং অনেক উপহার সামগ্রী পান। সুলতানের তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন কনস্টান্টিনোপোলের দোর্দোন্ডপ্রতাপ সম্রাট আন্দ্রোনিকার তৃতীয় এর মেয়ে বায়লূন। বায়লূন সেই সময় আন্তঃস্বত্বা ছিলেন এবং সুলতানের কাছে তার বাবার বাড়িতে সন্তান প্রসব করার ইচ্ছা পোষন করলে সুলতান তাকে অনুমতি দেন। সেই সাথে ইবন বতুতাকেও খাতুনের মহল্লার সাথে কনস্টান্টিনোপল যাওয়ার অনুমতি দেন। তিনি ১৩৩৪ সালের শেষের দিকে কনস্টান্টিনোপোল পৌছান। এটিই ছিল ইসলামী সম্রাজ্যের বাইরে ইবন বতুতার প্রথম সফর। কনস্টান্টিনোপল সম্পর্কে বর্ননা দিতে গিয়ে ইবন বতুতা তার বই রিহলা তে বলেনঃ
শহরটা আকারের দিক দিয়ে ব্যাপক বিস্তৃত এবং মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া গোল্ডেন হর্ন নদীর জন্য শহরটি দুভাগে বিভক্ত। নদীতে নিয়মিত জোয়ার ভাটা হয় । অতীতে নদী পারাপারের জন্য সেতু ছিল কিন্তু সেটা ভেঙে যাওয়ায় এখন নৌকায় করে পার হতে হয়। এ নদীর পূব পাড়ের অংশের নাম ইস্তাম্বুল। এপাড়েই আছে সম্রাটের প্রাসাদ এবং গন্যমান্যদের বাস। এ শহরের বাজার ও রাস্তাঘাট অনেক প্রসস্ত এবং পাথর দিয়ে বাধানো। প্রতিটা বাজারে প্রবেশের জন্য বড় বড় ফটক আছে, রাতে সেগুলো বন্ধ থাকে।
তিনি শহরের অনেক প্রশিদ্ধ জায়গার বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে আয়া হেলেনা Aya Helena এবং পরবর্তীতে Sent Helena গির্জা। এই গির্জার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে শোনা যায় যে এটি নির্মান করেছিলেন আসাফ বেরেচিয়াহর ছেলে যিনি হযরত সুলায়মান (আঃ) এর ভাতিজা ছিলেন। গ্রীকদের যত গির্জা আছে সেন্ট হেলেনা তাদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা। দেয়াল দিয়ে চারিদিক ঘেরা গির্জাটিকে একটি শহরের মত হনে হয়। কিছুদিন থাকার পর কনস্টান্টিনোপল থেকে অস্ত্রখানে ফিরে তিনি জানতে পারেন যে সূলতান তুঘলক তার রাজধানীতে ফিরে গেছেন। তার রাজধানী সারায় যেয়ে সুলতানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারত এবং চায়নার উদ্দেশে রওনা দেন।
সম্ভবত এই মসজিদেই ইবন বতুতা প্রায় ছয় বছর কাজী হিসেবে কাজ করেছেন |
মোহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসন আমলের মসজিদ যেখানে ইবন বতুতা প্রায় ছয় বছর কাজী হিসেবে কাজ করেছেন
সারা থেকে প্রায় তিন মাস ধরে যাত্রা করে খাওয়ারিজম হয়ে হিন্দুকুশ পার হয়ে তিনি গজনি পৌছান। এর মাঝে তিনি তৎকালীন প্রশিদ্ধ শহর সমরখন্দ এওং খুরাশানে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অবস্থান করেন। তারপর ১৩৩৩ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর আরবি ৭৩৪ সালের পহেলা মহররমে সিন্ধের পাঞ্জাব পৌছান। পাঞ্জাব শহরে পৌছার সাথে সাথে ইবন বতুতার আগমন বার্তা সিন্ধের রাজধানী মুলতানের গভর্নরের কাছে এবং দিল্লির বাদশা সুলতান মোহাম্মদ শাহ এর কাছে পাঠানো হয়। সিন্ধ থেকে দিল্লি ডাক পৌছাতে স্বাভাবিকভাবে প্রায় পঞ্চাশ দিন লাগার কথা কিন্তু বাদশাহর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ডাক দিল্লিতে মাত্র পাঁচ দিনেই পৌছে যায়। বহিরাগত যেই হোক সুলতানের তরফ থেকে তাকে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হবে কি না হলেও কোন শ্রেনীর মর্যাদা দেওয়া হবে সে ব্যাপারে দিল্লি থেকে সরকারি নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে সিন্ধের রাজধানী মুলতানে অপেক্ষা করতে হয়। ইবন বতুতাকেও অপেক্ষা করতে হল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে আজিজ সম্মানিত পদবি দেওয়া হল।পাঞ্জাব পার হয়ে নলখাগড়ার জংগলের মধ্য দিয়ে জননী শহর হয়ে সিওয়াসিতান পৌঁছান। সেই শহরেই খুরাশানের নামকরা ডাক্তার আলা আল মুককের সাথে তার দেখা হয়। এই ডাক্তারের সাথেই তিনি পরবর্তীতে লাহোর তৎকালীন লাহারি পৌছান। সেখানে গভর্নরের সাথে পাঁচদিন থেকে আবোহার হয়ে ভারতে পৌছান। আবোহার ছিল বর্তমান ভারতের মূল ভূখন্ডের প্রথম শহর। ভারতে ইবন বতুতা প্রায় সাত বছর অবস্থান করেন। সুলতান তাকে দুটি ছোট গ্রাম দিয়ে দেন যাতে করে এর থেকে সংগৃহীত রাজস্ব উত্তোলন করে তিনি তার খরচ চালাতে পারেন এবং এই সময়টা তিনি মালিকি সম্প্রদায়ের কাজী হিসেবে সুলতান কতৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কাজী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার অন্যতম কারন ছিল তার পিতাও কাজী ছিলেন। কাজীর দায়িত্ব পালনকালীন ইবন বতুতা অনেক বেহিসেবি খরচ করেন যা সুলতানের দৃষ্টিগোচর হয়। অপরদিকে ইবন বতুতাও সুলতানের রহস্যময় আচরনে ত্যাক্ত হয়ে ভারত থেকে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। অবশেষে সুলতান তাকে চীনে মোঙ্গল সম্রাট মোহাম্মদ ইবন তুঘলকের কাছে দূত হিসেবে প্রেরন করার ইচ্ছা পোষন করলে তিনি রাজি হয়ে যান। সুলতান তার ভ্রমনের জন্য ২ টি জাহাজ কর্মচারী এবং ক্রীতদাশের ব্যাবস্থা করলেন।চীন যাওয়ার উদ্দেশ্যে সমুদ্র তীরের দিকে যাওয়ার সময় রাস্তায় তিনি একদল ডাকাত দ্বাড়া আক্রান্ত হন। এই আক্রমনে তিনি সবকিছু হারান কিন্তু কোনরকমে প্রানে বেঁচে যান। প্রায় দশদিন পর তিনি পুনরায় তার সংগিদের সাথে মিলিত হন এবং বর্তমান ভারতের গুজরাটের দিকে রওনা হন। গুজরাটে তিনি সুলতানের মূল্যবান উপটৌকোন গুলোর সুরক্ষার জন্য প্রায় পঞ্চাশ জন আবিসিনিয়ান হাবসি যোদ্ধা ভাড়া করলেন এবং কয়েকদিন যাত্রা করে অবশেষে কালিকোট বন্দরে পৌছান যেখান থেকে তার চীন যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। ইবন বতুতা কালিকোট বন্দরে পৌছানোরও প্রায় দুইশত বছর পরে পর্তুগীজ পরিব্রাজক ভাস্কো দা গামা এই বন্দরে এসে পৌছান। তিনি যখন কালিকোটের মসজিদসমূহের পরিদর্শনে ব্যাস্ত ছিলেন তখন এক আচমকা ঝড় এসে সুলতানের মূল্যবান উপটৌকোন সহ তার একটি জাহায ডুবিয়ে দেয়। এতে করে ঐ জাহাযের সব নাবিক মৃত্যুবরন করে। সুলতানের প্রেরিত সমস্ত উপহার হারিয়ে ফেলে তার আর দিল্লি ফেরৎ যাওয়ার কোন উপায় ছিল না। তাই তিনি তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশের শাসনকর্তা জামাল-উদ-দীনের নিরাপত্তায় কিছুদিন থাকলেন। চীনের সম্রাটের কাছে ভারতের সুলতানের পাঠানো উপহারসামগ্রী হারিয়ে ফেলার পর ভারত ছেড়ে যাওয়া ছাড়া ইবন বতুতার আর কোন উপায় অন্তর ছিল না কিন্তু তিনি তার চীন যাওয়ার ইচ্ছার প্রতি অনড় ছিলেন। তাই তিনি অবশেষে মালদ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।
মালদ্বীপের অনেকগুলো দ্বীপের মধ্যে এটাও একটি দ্বীপ
যদিও ইবন বতুতা খুব অল্প সময়ের জন্য মালদ্বীপ আসার পরিকল্পনা করেন, তিনি এই দ্বীপে প্রায় নয় মাস অবস্থান করেন। মালদ্বীপ একসময় বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা থাকায় এখানে খুব একটা দক্ষ্য কাজী ছিল না। তাই ইবন বতুতাকে মালদ্বীপেও কজী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মালদ্বীপে অবস্থানকালীন সময়কালীন তিনি মোট চারটি বিয়ে করেন এর মধ্যে একটি করেন রাজপরিবারে। তার বই রিহলা তে মলদ্বীপ সম্পর্কে বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে এখানকার মানুষেরা অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসে এবং খালি পায়ে হাটে। মেয়েদের ব্যাপারে বর্ননা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে এখানকার মেয়েরা শরিরের নিম্নাংশ সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে কিন্তু উর্ধাংশ অনাবৃত রাখে। তিনি কাজী থাকা অবস্থায় অনেক কড়া ইসলামিক নিয়ম কানুন চালু করতে সমর্থ হলেও মেয়েদের পোষাক পরিবর্তনের ব্যাপারে তিনি তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারেন নি। মালদ্বীপে অবস্থানের শেষের দিকে ইবন বতুতার সাথে এখানকার উজিরের মনমালিন্য দেখা দিলে তিনি সিলন (বর্তমান শ্রীলংকা) হয়ে চীন যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন এবং অবশেষে একটি জাহাজে চড়ে শ্রীলংকা চলে যান।
শ্রীলংকা ভ্রমন
শ্রীলংকার মা বার মাদুরি উপকূলে যাওয়ার সময় প্রচন্ড এক ঝড়ের ধাক্কায় তার জাহাজ প্রায় ডুবে গিয়েছিল। ডুবন্ত জাহাজের পেছনের পাটাতনে প্রায় সমস্ত রাত কাটানোর পর একদল হিন্দু এসে তাকে উদ্ধার করেন এবং সুলতানের দরবারে পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করে দেন। তখনকার দামাঘানের সুলতান ছিলেন গিয়াসউদ্দিন যিনি ছিলেন ভারতের সূলতান মোহাম্মদের নিয়োজিত মাদুরির সামরিক গভর্নর। মাদুরিতে কিছুদিন অবস্থান কালে তিনি শ্রীলংকার এডামস পিক এবং তেনাভারাম মন্দির পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে ইবন বতুতা সুলতান গিয়াসউদ্দিনকে মালদ্বীপ দখলের জন্য প্রলুব্ধ করেন এবং আক্রমনের জন্য সেখানে সৈন্য পাঠাতে রাজী করেন। তারপর তিনি ইয়েমেন যাওয়ার উদ্দেশে একটি জাহাজে চড়েন কিন্তু সেই জাহাজের বহরে জলদস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ায় এবং সকল সহায় সম্বল হারিয়ে পুনরায় মালদ্বীপ যান। তখন পর্যন্তও তার চীন যাওয়ার ইচ্ছায় কোনরকম ভাটা পড়েনি তাই তিনি মালদ্বীপ থেকে একটি চীনা বানিজ্য যাহাজে করে চীনের উদ্দেশে রওনা দেন। টানা তেতাল্লিশ দিন যাত্রা করে তিনি বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌছান।
বাংলাদেশে আগমন
ইবন বতুতার বর্ননায় পাওয়া যায় মাত্র এক দিরহাম দিয়ে তখন বাংলাদেশ আটটি স্বাস্থবান মুরগী পাওয়া যেত । তাছাড়াও এক দিরহামে পনেরোটা কবুতর দুই দিরহামে একটি ভেড়া এবং এক স্বর্নমূদ্রারও কম মূল্যে দাসদাসী কিনতে পাওয়া যেত। যখন ইবন বতুতা বাংলাদেশে এসে পৌছান তখন এখানকার সুলতান ছিলেন ফখর উদ্দিন। ইবন বতুতার বাংলাদেশে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মহান দরবেশ শেখ জালাল উদ্দিন হযরত শাহ জালাল রঃ সাথে সাক্ষাৎ করার। সিলেটের যেখানে শেখ জালাল উদ্দিন থাকতেন সেখান থেকে প্রায় দুই দিনের দূরত্বেই তার দুজন শিষ্যের সাথে দেখা হয় ইবন বতুতার। তাদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন যে শেখ জালাল উদ্দিন আদেশ দিয়েছেন পশ্চিম থেকে যে পর্যটক তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসছেন তাকে যেন স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ ইবন বতুতার সাথে শেখ জালাল উদ্দিনের আগে থেকে কোন পরিচয় ছিল না কিংবা ইবন বতুতা তার আগমনের কোন খবরও শেখ জালাল উদ্দিনকে দেন নি। সেখান থেকেই ইবন বতুতা শেখ জালাল উদ্দিনের আধ্যাত্বিক ক্ষমতার ব্যাপারে ইঙ্গিত পান। হযরত শাহজালাল রঃ সাথে সাক্ষাৎ করে ফেরার পথে ইবন বতুতা একটি ছাগলের পশমের কোট উপহার পান। ইবন বতুতার বর্ননা মতে শেখ জালাল উদ্দিন একটি পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতেন যেখানে তারা ছাগল পূষতেন দুধ এবং মাখনের জন্য। তার সহযোগীরা প্রত্তেকেই সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন এবং কেউই এদেশীয় ছিলেন না। অবশেষে শেখ জালাল উদ্দিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দীপের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ইবন বতুতা যখন চীনের কুয়ানজু বন্দরে এসে পৌছান। তখন শহরটি জায়তুন শহর নামেও পরিচীত ছিল
চীন সফর
ইবন বতুতা চীনের কুয়ানজু বন্দরে এসে পৌছান। শহরটি জায়তুন শহর নামেও পরিচীত ছিল ।চট্টগ্রাম বন্দর থেকে যাত্রা করে প্রায় চল্লিশ দিন পর সুমাত্রা উপকূলে পৌছেন। সেখানকার সূলতান আল মালিক আজ জহিররের আতিথিওতায় প্রায় দুই সপ্তাহ কাটানোর পর সূলতান তাকে চীন যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সহ একটি ছোট জাহাজের ব্যাবস্থা করে দেন। সেখানথেকে প্রায় চল্লিশ দিন যাত্রা করে ১৩৪৫ সালে বর্তমান চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের কুয়ানজু বন্দরে পৌছান।
তার বর্ননা মতে তখন কুয়ানজুর অধিবাসীরা হুবহু মানুষের প্রতিকৃতি আঁকতে পারদর্শি ছিলেন। সুলতানের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় যখন তিনি স্থানীয় বাজারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এক চিত্রকরের দ্বারা নিজের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নেন। সূলতানের সাথে দেখা করে ফেরার পথে তিনি লক্ষ্য করেন যে তাঁর এবং তাঁর সাথীদের প্রতিকৃতি শহরের দেয়ালে দেয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে তিনি জানতে পারলেন যে শহরে কোন আগন্তুক আসলেই তার প্রতিকৃতি এভাবে টাঙিয়ে রাখা হয় যাতে করে সেই আগন্তুক কোন অপকর্ম করে পালিয়ে যেতে না পারে। জেইতুন শহরে তার সাথে কাজী আল-ইসলামের সাথে দেখা হয় যার সাথে ইবন বতুতার ভারতেও একবার দেখা হয়েছিল। কাজী আল-ইসলাম চীনে এসে ব্যাবসা করে বেশ অর্থোপার্জন করেছিলেন। ইনি ইবন বতুতাকে বেশ কিছু উপহার সামগ্রী দান করেন।চীনে ইবন বতুতা শামস উদ্দিন নামে পরিচীত ছিলেন। তার বর্ণনায় চীনে তার কোন উপপত্নি থাকার কথা জানা না গেলেও বিভিন্ন ইতিহাসবিদের মতে চীনে তিনি একটি উপপত্নি গ্রহণ করেছিলেন। ধারনা করা হয় যে সেখান থেকেই ডিং (শামস উদ্দিন থেকে পরিবর্তীত হয়ে চীনা ভাষায় শিং শু ডিং পরিবারের উৎপত্তি। অবশেষে ১৩৪৬ সালে তিনি তার দেশ মরোক্কো ফেরৎ যাওয়ার উদ্দেশে সূলতানের দেওয়া একটি জাহাজে করে কুয়ানজু থেকে পশ্চিম দিকে রওনা দিলেন।
স্বদেশ প্রত্যবর্তন এবং কালা জ্বর
কুয়ানজু থেকে তিনি ভারত হয়ে মরোক্কোর পথে রওনা দেন । দুইমাস জাহাজে কাটিয়ে তিনি সুমাত্রা পৌছান। সেখানে দুই মাস থেকে তিনি কাওলাম ইতিহাসবিদদের মতে এটা বর্তমান মিয়ানমারের কোন বন্দর বা সে বন্দর হয়ে তিনি ১৩৪৭ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে ভারত পৌছান। ভারতে অবস্থান করার বদলে ফেরার পথে আরো একবার মক্কায় হজ্জ্ব করার পরিকল্পনা করেন কারন তার ধারনা ছিল ভারতের সূলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলক চীনা সম্রাটের কাছে পাঠানো উপটৌকোন হারিয়ে ফেলার জন্য তার প্রতি সদয় নাও হতে পারেন। ভারত থেকে অন্য একটি বানিজ্যিক জাহাজে চড়ে ভারত মহাসাগর হয়ে তিনি মাসকাটের দিকে যাত্রা করেন। মাসকট থেকে হরমুজ প্রণালী হয়ে সিরাজ ইস্পাহান হয়ে ১৩৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি বাগদাদ পৌছান। বাগদাদে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন যে সেখানকার সূলতান আবু সাঈদের মৃত্যু হলে তার ফুপাতো ভাই শেখ হাসান তার সম্রাজ্য দখল করে নেন।
১৩৪৮ সালের শুরুতে তিনি সিরিয়ার ডামেস্কাসে পৌছান। সেখানকার স্থানীয় জাহিরিয়া একাডেমিতে তার সাথে মরোক্কোর তাঞ্জিয়ারের এক বিখ্যাত শেখের সাথে দেখা হয়ে যায়। তার কাছে থেকে ইবন বতুতা জানতে পারেন যে তার বাবা পনেরো বছর আগে মারা গেছেন তবে তার মা এখনও বেঁচে আছেন।[ দামেস্কাসে তিনি ১৩৪৮ সালের শেষ পর্যন্ত থাকলেন। তখন সিরিয়া এবং গাজায় কালা জ্বরের মহামারি ছড়িয়ে পরেছে। ইবন বতুতা স্থানীয় কাজীর কাছ থেকে জানতে পারেন যে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ২৪০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি যখন হেবরন আর গাজা পৌছালেন তখন দেখলেন যে মহামারির প্রোকোপ কিছুটা কমে প্রতিদিন গড়ে ১১০০ তে নেমে এসেছে। এই মহামারি থেকে বাঁচতে ইবন বতুতা প্রতিদিন রোজা রাখতেন। সেখান থেকে কায়রোতে যেয়ে সেখানেও দেখলেন মহামারি থামেনি। ইবন বতুতা কায়রো পৌছানোর আগে এখানে প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা ২১,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কায়রো থেকে মিশরের সাঈদ বন্দর হয়ে ১৩৪৮ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি মক্কা পৌছান। ১৩৪৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২রা মার্চ পর্যন্ত হজ্জ্ব সেরে তিনি ফেজ হয়ে ওই বছরেই তার নিজ দেশ তাঞ্জিয়ার পৌছান। তাঞ্জিয়ার পৌছে তিনি দেখতে পান যে তার মা ও পরলোক গমন করেছেন।
আল আন্দুস স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকা
ইবন বতুতা গ্রানাডা ভ্রমন করেন যেটা আল আন্দুস সম্রাজ্যের শেষ নিদর্শন ছিল তার নিজের শহর তাঞ্জিয়ারে পৌছে তিনি আসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় তিন মাস শয্যাশায়ী থেকে সুস্থ হওয়ার পর ইবন বতুতা সূলতানের অনুরোধে যুদ্ধে জিহাদে অংশগ্রহন করার জন্য রক্ষি বাহিনীতে যোগ দেন এবং সৈন্যবাহিনীর সাথে জাহাজে চড়ে আন্দালুসিয়ায় পৌঁছান। স্পেনের খৃষ্টান শাষক আডফুনাস Alfonso XI দশ মাস ধরে জোবেল জিব্রাল্টার দখল এবং অবরোধ করে রেখেছিলেন। আডফুনাসের ধারনা ছিল যে অবরোধ করে রাখলে হয়তো মুসলিমরা পরাজিত হবে এবং দূর্গের সকলকে একসাথে বন্দি করা যাবে। কিন্তু আডফুনাস নিজেই কালাজ্বরের মহামারিতে আক্রান্ত হন এবং মারা যান। তাতে মুসলিমদের আর আডফুনাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রয়োজন হয় নাই। যুদ্ধ করার প্রয়োজন না হওয়ায় ইবন বতুতা স্পেনের ভ্যালেনসিয়া এবং গ্রানাডা ভাল করে ঘুরে দেখার সুযোগ পান। আল আন্দুস থেকে তিনি মরোক্কোতে ফেরৎ আসেন এবং আফ্রিকার এমন কিছু অঞ্চল পরিদর্শন করার ইচ্ছা পোষন করেন যেগুলো মুসলিম অধ্যুষিত কিন্তু তার তখনও সেগুলোতে যাওয়া হয় নি। তিনি মরোক্কোতে ফিরে কিছুকাল অবস্থান করে মারাক্কিস যান যেটা সাম্প্রতিক মহামারিতে একেবারে খালি হয়ে গেছে। তাই এর রাজধানী ফেজ শহরে স্থানান্তর করা হয়েছিল। সেখান থেকে পুনরায় তিনি তার নিজের শহর তাঞ্জিয়ার পৌঁছান।
সাহারা মরুভূমি এবং মালি
ইবন বতুতা ট্রান্স সাহারান বানিজ্য রুটের একটি গুরুত্বপূর্ন শহর আওয়ালাতায় কিছুদিন অবস্থান করেন
প্রায় সমস্ত মুসলিম সম্রাজ্য ভ্রমনের পর আর একটি মাত্র মুসলিম দেশ ভ্রমণ বাকি ছিল তাঁর আর সেটি হল নিগ্রোল্যান্ড। ১৩৫১ সালের বসন্তে ইবন বতুতা সাহারা মরুভুমির উত্তরে সিজিলমাসার উদ্দেশ্যে ফেজ নগরী ত্যাগ করেন। সিজিলমাসাতে তিনি কয়েকটি উট কেনেন এবং প্রায় চার মাস কাটান। সেখান থেকে ১৩৫২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি লবনের খনির শহর তাঘাজার Taghaza উদ্দেশ্যে রওনা দেন। প্রায় পঁচিশ দিন পর সেখানে পৌছেন। ইবন বতুতা বর্ননা মতে সেখানকার ঘরবাড়ি এবং মসজিদগুলো লবনের ব্লক দিয়ে তৈরী আর ছাদগুলো তৈরী ছিল উটের চামড়া দিয়ে। সেই এলাকায় গাছপালা তেমন একটা ছিল না আর এখানকার পানি অত্যন্ত লবনাক্ত ছিল তাই ইবন বতুতা তাঘাজাতে খুব কম সময় কাটান।
তাঘাজাতে প্রায় দশদিন অতিবাহিত করার পর বিরাট সাহারা মরুভূমি পার হবার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য তিনি তাসারাহলার একটি মরুদ্যানে তিন দিন অবস্থান করেন এবং মরুভূমির জন্য পর্যাপ্ত রসদ ও পানি সংগ্রহ করেন। তাসারাহলা থেকে যাত্রা শুরু করে আওয়ালাতায় একবার যাত্রাবিরতি দিয়ে ট্রান্স সাহারান বানিজ্য রুটের দিকে রওনা দেন। সিজিলমাসা থেকে এই রাস্তায় প্রায় ১৬০০ কিঃমিঃ সাহারা মরুভূমি পার হতে তার প্রায় দুই মাস লাগে। নাইজার নদীর তীরে মালি সম্রাজ্যে পৌছে তিনি সূলতানের সাথে সাক্ষাত করেন। তৎকালীন মালি সম্রাজ্যের সূলতান ছিলেন মানসা সুলায়মান মানসা একটি উপাধি অর্থ সূলতান এবং তার নাম ছিল সুলায়মান যিনি ১৩৪১ সাল থেকে সেখানকার সূলতান হিসেবে আছেন। মানসা সূলতান কিপ্টেমির জন্য কুখ্যাত ছিলেন। সেখানকার স্থানীয়দের আতিথিওতা ইবন বতুতার কাছে মনমুগ্ধকর মনে হলেও সূলতানের আতিথিওতা খুব একটা পছন্দ হল না তার কাছে। ইবন বতুতার বর্ননা মতে সেখানকার মানুষ ধর্মভীরু হলেও সেখানকার নারীরা ইসলামী পর্দাপ্রথা মানতেন না। তারা সকলেই এমনকি সুলতানের কন্যারাও সকলের সামনে বিবস্ত্র হয়ে ঘুরে বেড়াতো। মালিতেই ইবন বতুতা সার্বপ্রথম জলহস্তি দেখেন। মালিতে আট মাস অবস্থান করে তিনি তার কাফেলা নিয়ে তিম্বুক্তের দিকে রওনা হন। তিম্বুক্ত থেকে তিনি নাইজার নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত গাঁও শহরে যান। গাঁও শহরে অবস্থানকালে তিনি মরোক্কোর সম্রাট আবু ইনান ফারিসের একটি পত্র পান যেখানে তাকে মরোক্কো ফেরৎ যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সম্রাটের আদেশ পাওয়া মাত্রই ইবন বতুতা তার কাফেলা তৈরী করেন এবং মরোক্কোর উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১৩৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মরোক্কোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৩৫৪ সালের শুরুর দিকে তার জন্মভূমিতে শেষবারের মত পদার্পন করেন।
রিহলা
তাঞ্জিয়ারের মদিনা শহরের একটি বাড়ি যেটা ইবন বতুতার কবর হওয়ার সম্ভাবনা আছে
মরোক্কোর ফেজ নগরীতে গিয়ে ইবন বতুতা সুলতান আবু ইনান ফারিজ এবং তার সভাসদদের কাছে তার সমস্ত ভ্রমন কাহিনী খুলে বলেন। তার সমসাময়িক আরেক ঐতিহাসিক ইবন খালাদুনের বর্ননা থেকে জানা যায় যে তারা সেসব বিশ্বাস করেন নি। তবে গল্প বলার ফলে অন্য দিক থেকে লাভ হয়েছিল ইবন বতুতার। উজিরদের মধ্য থেকে একজন ক্ষমতাধর সমর্থক জুটে গিয়েছিল তার। তার চাপে পড়ে সুলতান নিজের একান্ত সচীবদের একজন ঈবন জুজাঈকে তার ভ্রমনের বিস্তারিত লিখে রাখার নির্দেশ দেন। শুরু হয় বলা ও লিখার পর্ব। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে ঈবন জুজাঈ ইবন বতুতার প্রতিটি কথা এবং বর্ননা হুবহু লিপিবদ্ধ করেন নি। তবে আরবী নাম ও জায়গার নামের ব্যাপারে অনেক সচেতন ছিলেন ঈবন জুজাঈ। অনেক ক্ষেত্রেই তার সম্পাদনায় ত্রুটি পাওয়া গেছে। লেখার ধরন সাধারন কিন্তু তার মধ্যে কিছুস্থানে কবিতার ছত্র যোগ করে লেখায় বৈচিত্র আনতে চেষ্টা করেছেন। কোথাও কোথাও আবার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথাও জুড়ে দিয়েছেন। ইবন জুবাইর নামে আন্দালুসিয়ার এক পন্ডিৎ দ্বাদশ শতাব্দিতে মিশর হিজাজ, সিরিয়া এবং পূর্বের বিভিন্ন জায়গা ভ্রমন করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ইবন বতুতার যেসকল ভ্রমন পথ ও বর্ননা ইবন জুবাইরের সাথে মিলে যায় সে জায়গায় ঈবন জুজাঈ নতুন কোন কাহিনী না লিখে ইবন জুবাইরের ভ্রমনের বর্ননাই তুলে ধরেছেন।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট । SomewhereinBlog.
Tags
ইসলামের ইতিহাস