প্রথম কথা : আল্লাহ তাআলা মাকে সন্তানের মাদরাসা বানিয়েছেন। মায়ের কোল সন্তানের মাদরাসা। তাবলীগের বড় মুরুব্বী হাজী আব্দুল মুকীত রাহ.-এর জামাতা প্রফেসর ড. আনওয়ারুল করীম সাহেব একবার হযরতজী এনামুল হাসান ছাহেব রাহ.-কে জিজ্ঞেস করলেন, হুযুর! এখন এত মাদরাসা, দ্বীনী তালীমের এত সুযোগ-সুবিধা, এরপরও নতুন প্রজন্ম খারাপ কেন, ওদের মধ্যে ভালো কম কেন? সাহাবায়ে কেরামের যামানায়, তাবেঈ-তাবে তাবেঈর যামানায় তো এত মাদরাসা ছিল না, তবু সেই যামানার সবাই ভাল, সব ছেলে ভাল। এখন কেন খারাপ? এত মাদরাসা সত্ত্বেও কেন ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ভালোর সংখ্যা কম? সম্ভবত হযরতজী বললেন, আরে! তখন মাদরাসা ছিল বেশী এখন মাদরাসা কম! এখন তো তুমি ছয়/সাত বছর বয়সে সন্তানকে মাদরাসায় পাঠাও, ভর্তি করাও। সে এক মাদরাসায় পড়ে, যতক্ষণ মাদরাসায় থাকে ততক্ষণ শুধু মাদরাসা। আর আগে সন্তান যেদিন ভূমিষ্ঠ হত সেদিন থেকে প্রতিটি মুহূর্তই হতো তার মাদরাসা, প্রতিটি কোলই ছিল তার একেকটি মাদরাসা। মায়ের কোলে আছে তো মাদরাসায় আছে। বোনের কোলে আছে তো আরেক মাদরাসায় আছে। ভাই কোলে নিয়েছে তো সে মাদরাসাতেই আছে। তখন সন্তান দুনিয়াতে আসার পর যার কোলে যাক যে দিকে তাকাক, যার হাতে যাক যে দিকে বের হোক- সবখানে মাদরাসা আর মাদরাসা। অর্থাৎ সে যেখানেই যাবে যার কাছেই থাকবে সে দ্বীনদার পাবে, দ্বীনী পরিবেশ পাবে। যে বোনের কোলে আছে, সে বোন মিথ্যা বলে না, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। ভায়ের কোলে গেল তো ভাই-ও ভদ্র ছেলে, নামাযী, কারো গীবত-শেকায়েত করে না। বাবা এসেছেন, তার কোলে গেল, তিনিও ভাল, তার কামাই হালাল, দুনিয়ার পিছে পড়ে নামায ছাড়েন না। ধন-সম্পদ গড়ার জন্য হারামে লিপ্ত হন না। তার মানে, সন্তান যার কোলে যাচ্ছে যার কাছে যাচ্ছে মাদরাসায় যাচ্ছে! আর এখন? কোথায় সেই মাদরাসা?
সন্তান যেখানে যাবে যার কোলে থাকবে, সেখানেই যদি আগের মত মাদরাসা হতো, তাহলে তো ভাল ছিল। কিন্তু তা যদি না হয়, অন্তত প্রত্যেক সন্তানের প্রথম কোলটি যেন হয় মাদরাসা। যিনি এ সন্তানকে ধারণ করছেন, বহন করছেন দশ মাস দশ দিন, তাঁর আখলাক যদি ভাল হয়, তাঁর মধ্যে যদি দ্বীন-ঈমান থাকে, নামায থাকে কুরআন থাকে, ভাল ব্যবহার থাকে, তবে সন্তানের উপর এর প্রভাব পড়বেই পড়বে। প্রত্যেক নারীকে বুঝতে হবে, আপনার ব্যক্তি-সত্তাই আপনার সন্তানের মাদরাসা। আপনিই আপনার সন্তানের প্রথম মাদরাসা। আপনি ভাল সন্তান ভাল, আপনি খারাপ সন্তান খারাপ। হয়ত বলবেন, মা অনে-ক ভাল, সন্তান খারাপ- এমনও তো দেখা যায়! আসলে এমনটা খুব কম হয়। হলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। আরেক কথা হল, মা যে অনেক ভাল, আমরা তাঁর বাহ্যিক অবস্থা দেখে সুধারণা করছি। কিন্তু মার তো নিজের হিসাব নিজে নেওয়া দরকার, আমি কতটুকু ভাল। নিশ্চই আমার কোনো ত্রুটি আছে, মানুষ জানে না, কিন্তু আল্লাহ জানেন। আমাকে আমার সেই ত্রুটি সংশোধন করতে হবে।
আমরা ছেলে-মেয়েদের শাসন করি কথা দিয়ে, হাত দিয়ে। বেশি ভাল হলে হয়ত হাত ব্যবহার করি না, শুধু কথা দিয়ে শাসন করি। কিন্তু সন্তানের শাসন-পদ্ধতি কি শুধু হাত আর মুখ ব্যবহার? বকাঝকা করা আর লাঠি হাতে নেওয়া? আসলে এভাবে শাসন হয় না। মূলত সন্তান শাসনের প্রথম কথা হল আমি ভাল হওয়া, এক নম্বরে আমি ভাল হওয়া। আমার আমল-আখলাক, আমার আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা ভাল হওয়া। বাপের রোজগার হালাল হওয়া। এ হল সন্তান শাসনের মৌলিক কথা। মা-বোনদের প্রতি নসীহত, আপনারা স্মরণ রাখবেন, আপনারা হলেন সন্তানের প্রথম মাদরাসা। প্রথম থেকেই মাদরাসা। আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন সন্তান আপনার কাছ থেকে শিখতে থাকবে। কাজেই আপনারা আপনাদের যতœ নিন।
দ্বিতীয় কথা : সময়ের অপচয়। এটা গুনাহ, স্বতন্ত্র গুনাহ। যদিও আমাদের সকল কাজ সময়ের সাথে বাঁধা। আমরা সময়ের উর্ধ্বে উঠে কোনো কাজ করতে পারি না। কিন্তু যদি সময়ের উর্ধ্বে উঠে কোনো গুনাহের কাজ করা যেত তবে কি ঐ গুনাহর কাজ গুনাহ হতো না? অবশ্যই হত। বোঝা গেল, গুনাহের কাজ এমনিতেই গুনাহ আর সময়ের অপচয় আলাদা গুনাহ। সময়কে কোনো কাজে না লাগানো বা হেলায় নষ্ট করা ভিন্ন একটা গুনাহ। সকল শ্রেণীর মানুষ এখন এই গুনাহে লিপ্ত। সময়-অপচয়-রোগে আমরা সবাই আক্রান্ত। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার ধারণা, মহিলাদের মধ্যে এ সমস্যাটা বেশি।
তাদের সময় বিভিন্নভাবে অপচয় হয়। একটা হল সাংসারিক কাজ। বলতে পারেন, এটা তো বড় কঠিন কথা, কাজের মধ্যে থাকলে আবার সময়ের অপচয় হয় কীভাবে! আমি বলি, ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কাজ? গ্রামের মহিলাদের সারাদিন কাজ আর কাজ। সারাদিন কেন কাজ? কোথায় আপনার একটু আরাম-বিশ্রাম, তালিম-তিলাওয়াত, নফল নামায, যিকির-আযকার? আসলে আমরা কাজ অনেক করি বটে, কিন্তু সুশৃঙ্খলভাবে করি না। রুটিন মোতাবেক করি না। অনেক সময় কাজ ফেলেও রাখি, সময় মতো করি না। ফলে আমাদের সময়ে বরকত হয় না। অপচয় হয়ে যায় বহু সময়। এজন্য প্রত্যেক ঘরে মহিলারা সময়সূচি বানিয়ে নিবেন। রুটিন মাফিক কাজ করলে দেখবেন অনেক সময় বেঁচে যাবে। আপনি রুটিনে তালিম-তেলওয়াতের জন্য সময় বরাদ্দ রাখুন। নফল নামাযের জন্য সময় বের করুন। আরাম-বিশ্রামের জন্য সময় খালি করুন। ঠিকমতো বিশ্রাম না নেওয়ার কারণে মহিলাদের শারীরিক কত সমস্যা হয়। আপনি ঠিক করুন, ঠিক কতটা থেকে কতটার মধ্যে নাশতা প্রস্তুত করবেন, বাচ্চাদেরকে মাদরাসায় কখন পাঠাবেন। দুপুরের রান্না কখন শুরু করবেন কখন শেষ করবেন। আপনার কাজ যদি সময় মতো হয়, গোছালো হয়, অলসতা না করে যদি সব কাজ সময় মতো করে ফেলতে পারেন, তাহলে আপনি ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনী কাজের জন্য অনেক সময় বের করতে পারবেন। আর না হয় কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে এবং পুরোটা দিন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আপনি একটু আরাম-বিশ্রামেরও সময় পাবেন না।
আপনি লক্ষ্য রাখুন, যেন কম থেকে কম সময়ে বাচ্চাদের খাওয়া-গোসল ইত্যাদি হয়ে যায়, সেভাবে ওদের গড়ে তুলুন। স্বামীরা স্ত্রীদের সময় বাঁচনোর প্রতি লক্ষ রাখুন। নিজের খাওয়ার বর্তনটা স্ত্রীর ধোওয়ার জন্য রেখে না দিয়ে নিজেই ধুয়ে ফেলুন। দস্তরখান বিছানো-গুটানোর ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সহায়তা করুন। সময় হলে ঘরের অন্যান্য কাজে অংশ নিয়ে স্ত্রীর কাজ এগিয়ে দিন। এটা পুরুষের দায়িত্ব। পুরুষের উদ্দেশ্যে যখন কথা বলবো তখন এ-বিষয়ে আরও বলা যাবে। আজ তো মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলছি। সুতরাং ঘরওয়ালি হিসাবে যে কাজের দায়িত্ব আপনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন, যে কাজ আপনি করবেনই, সে কাজ সময় মতো করুন। উদ্যমের সাথে করুন। তাহলে আপনি দ্বীন শেখার জন্য সময় বের করতে পারবেন। ইবাদত-বন্দেগীতে অগ্রসর হতে পারবেন।
ছোটকালে আমি আমার মার সঙ্গে রান্না ঘরে যেতাম। একদিন তিনি আউয়াল ওয়াক্তে যোহর পড়ে রান্না করতে এলেন। কী কারণে যেন আগুন ধরতে দেরি হচ্ছিল। লক্ষ্য করলাম, তিনি দোয়া পড়ছেন আর কেঁদে কেঁদে বলছেন, আহারে! নামাযের সময় বুঝি যায়! নামাযের সময় বুঝি যায়! আমি বললাম, এই না আপনি যোহর পড়ে এলেন, নামাযের সময় তাহলে যায় কোথায়? বললেন, ‘আসরের সময় চলে যায়!’অর্থাৎ এই যে আগুন জ্বলছে না, রান্না শুরুই হচ্ছে না, দেরি হয়ে যাচ্ছে, রান্নার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে তো আমি আসরের নামায আওয়াল ওয়াক্তে পড়তে পারবো না। চিন্তা করুন, এইমাত্র যোহর পড়ে এলেন, কিন্তু আগুন জ্বলতে একটু দেরি হচ্ছে বলে এখনই তাঁর আসরের সময় চলে যাচ্ছে!
আমরা সাধারণত দশটা উনষাট মিনিট হয়ে গেলেও এগারটা বাজেনি মনে করি। কিন্তু আমার আম্মা ঘড়ির কাঁটা দশটা পার হলেই বলতেন এগারটা বেজে গেছে। আসলেও তাই। দশটার পরের মিনিটগুলো এগারটার মিনিট দশটার নয়। আর এগারটা বাজার পর যে মিনিট সেটা তো এগারটার নয়, বারটার মিনিট!
তৃতীয় কথা : স্বামীর সাথে ভাল আচরণ। স্বামী যারা, তাদেরকে আদর্শ স্বামী হওয়ার জন্য যা জানা দরকার, প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার, তা তো আমরা নিইনি। স্বীকার করছি, আমরা আদর্শ স্বামী হতে পারিনি। আদর্শ স্বামীর গুণাবলী আমরা শিখিনি। ইসলাম কিন্তু খুব শিখিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য আদর্শ। তাঁর আদর্শই তো আদর্শ। কিন্তু নবীজীর সীরাত থেকে আমরা আদর্শ স্বামীর সেই গুণাবলী হাসিল করতে পারিনি। আমরা ভাল স্বামী নই, আমরা ‘আসামী’। এখন যেহেতু নারীদের উদ্দেশ্যে কথা বলছি সে জন্য ঐ প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। মা-বোনদের বলছি, আমরা যেন আমাদের আচরণ সুন্দর করি। আচরণ সুন্দর করার অনেক দিক আছে। সব তো আর এক মজলিশে বলা সম্ভব নয়। বলার দরকারও নেই। আপনারা মনিতেই জানেন। আমি শুধু সওয়াব হাসিলের জন্য একটি কথা তুলে ধরছি। যে কথা হাদীসেও এসেছে।
‘কখনও, কোন সময়, সব সময়’এই শব্দগুলো বিরক্তির সময় আমরা ব্যবহার করি। স্বামীর আচরণ একটু খারাপ লাগলেই বলে উঠি, তুমি ‘সব সময়’আমার সাথে এমন কর। এখানে ‘সব সময়’শব্দটা অপাত্রে ব্যবহার হয়েছে। আসলেই কি সব সময় আপনার স্বামী আপনার সাথে এমন করে? স্বামীরা বাহিরে বাহিরে থাকে। স্ত্রীদেরকে সময় কম দেয়। স্ত্রী এক দিন সময় চাইলেন। স্বামী ব্যস্ততা দেখালেন আর অমনি স্ত্রী বলে উঠলেন, ‘কখনও তোমার কাছে একটু সময় পাই না! কোনো দিন তুমি আমাকে সময় দাও না।’এই যে পাইকারি বলা, ‘সব সময় তুমি এরকম কর, কখনও তোমার কাছে একটু ভাল ব্যবহার পাই না, কোনো সময় তোমার কাছে একটা জিনিস চাইলে পাই না।’- এই ভাষাগুলো ঠিক না। হাদীসে এসেছে, গড়পড়তা নারীদের অভ্যাস হল, একটুতেই তারা স্বামীদের সব অনুগ্রহ ভুলে যায় এবং বলে উঠে,
مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَط ‘তোমার কাছে কখনও ভাল ব্যবহার দেখলাম না!’আহারে! কিচ্ছুই দেখেননি? এটা কীভাবে হয়! কিছু না কিছু দেখেছেন, অবশ্যই দেখেছেন! তাহলে এরকম করে বলার কী দরকার। এমন কথা স্ত্রী বললে স্বামীর মনে আঘাত লাগে, তিনি বড় কষ্ট পান। স্বামী বললেও স্ত্রীর মন ভেঙ্গে যায়, তিনি ভীষণ আঘাত পান।
উর্দুতে এজাতীয় একটি শব্দ হল হামেশা। মুফতি রফী উসমানী সাহেব হুযুরের বয়ানেও কথাটা আছে। একদিন তরকারিতে লবণ একটু কম হল, আপনি ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলেন, ‘সব সময় তরকারিতে লবণ কম হয়, রান্না একটা দিনও খাওয়ার মত হয় না।’ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন... একটা দিনও কি তরকারি খাওয়ার মত হয় না? আরে ভাই আপনি বলতে পারেন, সব সময় তো স্বাদ হয়! আজ বুঝি লবণটা কম হয়ে গেছে! আর এটাই বা বলার কী দরকার। ওরা কি খাওয়ার সময় বিষয়টা বুঝবে না? হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর ঘটনা শুনেছি, লবণ মোটেই দেয়া হয়নি এমন তরকারি হুযুর বিনাবাক্যে খেয়ে মাদরাসায় চলে গেলেন, কিছুই বলেননি। অন্যরা খেতে বসে তো আশ্চর্য! হুযুর তো কিছুই বললেন না। হুযুর তো কিছুই বললেন না! -আমাদেরকেও এমন হতে হবে। এ জাতীয় কথা পরিহার করতে হবে। আমরা বরং প্রশংসা করব, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। তাহলে স্ত্রীরা আমাদের কাছে শিখবে। স্ত্রীরা করলে স্বামীরা শিখবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে শেখার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আরেকটি কথা আরজ করছি। আগের যামানার মহিলা আর এ যামানার মহিলাদের মাঝে বিশেষ একটি পার্থক্য আছে। ‘রিসালাতুল মুস্তারশিদীন’কিতাবে আমি পড়েছি। ইহইয়াউ উলূমিদ্দীনসহ আরও অনেক কিতাবে কথাটা আছে। আগে যখন স্বামীরা রোজগারের জন্য ঘর থেকে বের হতেন, তখন স্ত্রীরা বলত, نَصْبِرُ عَلَى الْجُوعِ وَلَا نَصْبِرُ عَلَى النَّارِ আপনি আমাদের জন্য কামাই করতে যাচ্ছেন, সংসার চালানোর জন্য রোজগার করতে বের হচ্ছেন, আমরা আপনাকে আস্বস্ত করছি যে, আমরা দারিদ্র্যের উপর সবর করতে রাজী, ক্ষুধার কষ্ট সইতে প্রস্তুত, আজ এটা নেই কাল ওটা নেই, অভাব-অনটন চলছেই চলছে...এর উপর আমরা ধৈর্য ধরব। কিন্তু জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে পারব না। সুতরাং হালালভাবে যা পাবেন কেবল ততটুকু আনবেন, হারাম কিছু আনার চেষ্টা করবেন না। আমরা না খেয়ে কম খেয়ে থাকতে পারব কিন্তু দোযখের আগুন সইতে পারব না। এই ছিল আগের কালের মহিলাদের ভাষা। আর এই যামানার মহিলারা স্বামীর হাতে লম্বা তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, এগুলো আমার চাই। তালিকা দেখে স্বামী বেচারা বিমর্ষ হয়ে পড়ে। স্ত্রীকে অনুনয় করে বলে, আমি এত কিছু কীভাবে আনব, আমার আয় তো তোমার সামনে? তুমি তো জান আমার কত আয়! স্ত্রীর এক কথা; তোমার কত আয় আমার তা জানার দরকার নেই। এই জিনিসগুলো আমার চাই, এগুলো ছাড়া দিন চলবে না। এই যুগে এমন মহিলা অনেক। কিন্তু আগে এমন ছিল না। কম হোক আপত্তি নেই, কিন্তু হারাম তারা সহ্য করতেন না। আল্লাহ তাআলা সকল মহিলাদেরকে এমন হওয়ার তাওফীক দান করুন। পুরুষদেরও আগের পুরুষদের মত নেককার হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
[মুসাজ্জিলা থেকে বয়ানটি পত্রস্থ করেছেন মাহমুদ হাসান মাসরূর। জাযাহুল্লাহু খাইরান]
.
[ মাসিক আলকাউসার » জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৭ . মার্চ ২০১৬ ]মাসতুরাতের উদ্দেশ্যে তিনটি কথা
.
-- মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
.
প্রথম কথা : আল্লাহ তাআলা মাকে সন্তানের মাদরাসা বানিয়েছেন। মায়ের কোল সন্তানের মাদরাসা। তাবলীগের বড় মুরুব্বী হাজী আব্দুল মুকীত রাহ.-এর জামাতা প্রফেসর ড. আনওয়ারুল করীম সাহেব একবার হযরতজী এনামুল হাসান ছাহেব রাহ.-কে জিজ্ঞেস করলেন, হুযুর! এখন এত মাদরাসা, দ্বীনী তালীমের এত সুযোগ-সুবিধা, এরপরও নতুন প্রজন্ম খারাপ কেন, ওদের মধ্যে ভালো কম কেন? সাহাবায়ে কেরামের যামানায়, তাবেঈ-তাবে তাবেঈর যামানায় তো এত মাদরাসা ছিল না, তবু সেই যামানার সবাই ভাল, সব ছেলে ভাল। এখন কেন খারাপ? এত মাদরাসা সত্ত্বেও কেন ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ভালোর সংখ্যা কম? সম্ভবত হযরতজী বললেন, আরে! তখন মাদরাসা ছিল বেশী এখন মাদরাসা কম! এখন তো তুমি ছয়/সাত বছর বয়সে সন্তানকে মাদরাসায় পাঠাও, ভর্তি করাও। সে এক মাদরাসায় পড়ে, যতক্ষণ মাদরাসায় থাকে ততক্ষণ শুধু মাদরাসা। আর আগে সন্তান যেদিন ভূমিষ্ঠ হত সেদিন থেকে প্রতিটি মুহূর্তই হতো তার মাদরাসা, প্রতিটি কোলই ছিল তার একেকটি মাদরাসা। মায়ের কোলে আছে তো মাদরাসায় আছে। বোনের কোলে আছে তো আরেক মাদরাসায় আছে। ভাই কোলে নিয়েছে তো সে মাদরাসাতেই আছে। তখন সন্তান দুনিয়াতে আসার পর যার কোলে যাক যে দিকে তাকাক, যার হাতে যাক যে দিকে বের হোক- সবখানে মাদরাসা আর মাদরাসা। অর্থাৎ সে যেখানেই যাবে যার কাছেই থাকবে সে দ্বীনদার পাবে, দ্বীনী পরিবেশ পাবে। যে বোনের কোলে আছে, সে বোন মিথ্যা বলে না, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। ভায়ের কোলে গেল তো ভাই-ও ভদ্র ছেলে, নামাযী, কারো গীবত-শেকায়েত করে না। বাবা এসেছেন, তার কোলে গেল, তিনিও ভাল, তার কামাই হালাল, দুনিয়ার পিছে পড়ে নামায ছাড়েন না। ধন-সম্পদ গড়ার জন্য হারামে লিপ্ত হন না। তার মানে, সন্তান যার কোলে যাচ্ছে যার কাছে যাচ্ছে মাদরাসায় যাচ্ছে! আর এখন? কোথায় সেই মাদরাসা?
সন্তান যেখানে যাবে যার কোলে থাকবে, সেখানেই যদি আগের মত মাদরাসা হতো, তাহলে তো ভাল ছিল। কিন্তু তা যদি না হয়, অন্তত প্রত্যেক সন্তানের প্রথম কোলটি যেন হয় মাদরাসা। যিনি এ সন্তানকে ধারণ করছেন, বহন করছেন দশ মাস দশ দিন, তাঁর আখলাক যদি ভাল হয়, তাঁর মধ্যে যদি দ্বীন-ঈমান থাকে, নামায থাকে কুরআন থাকে, ভাল ব্যবহার থাকে, তবে সন্তানের উপর এর প্রভাব পড়বেই পড়বে। প্রত্যেক নারীকে বুঝতে হবে, আপনার ব্যক্তি-সত্তাই আপনার সন্তানের মাদরাসা। আপনিই আপনার সন্তানের প্রথম মাদরাসা। আপনি ভাল সন্তান ভাল, আপনি খারাপ সন্তান খারাপ। হয়ত বলবেন, মা অনে-ক ভাল, সন্তান খারাপ- এমনও তো দেখা যায়! আসলে এমনটা খুব কম হয়। হলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। আরেক কথা হল, মা যে অনেক ভাল, আমরা তাঁর বাহ্যিক অবস্থা দেখে সুধারণা করছি। কিন্তু মার তো নিজের হিসাব নিজে নেওয়া দরকার, আমি কতটুকু ভাল। নিশ্চই আমার কোনো ত্রুটি আছে, মানুষ জানে না, কিন্তু আল্লাহ জানেন। আমাকে আমার সেই ত্রুটি সংশোধন করতে হবে।
আমরা ছেলে-মেয়েদের শাসন করি কথা দিয়ে, হাত দিয়ে। বেশি ভাল হলে হয়ত হাত ব্যবহার করি না, শুধু কথা দিয়ে শাসন করি। কিন্তু সন্তানের শাসন-পদ্ধতি কি শুধু হাত আর মুখ ব্যবহার? বকাঝকা করা আর লাঠি হাতে নেওয়া? আসলে এভাবে শাসন হয় না। মূলত সন্তান শাসনের প্রথম কথা হল আমি ভাল হওয়া, এক নম্বরে আমি ভাল হওয়া। আমার আমল-আখলাক, আমার আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা ভাল হওয়া। বাপের রোজগার হালাল হওয়া। এ হল সন্তান শাসনের মৌলিক কথা। মা-বোনদের প্রতি নসীহত, আপনারা স্মরণ রাখবেন, আপনারা হলেন সন্তানের প্রথম মাদরাসা। প্রথম থেকেই মাদরাসা। আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন সন্তান আপনার কাছ থেকে শিখতে থাকবে। কাজেই আপনারা আপনাদের যতœ নিন।
দ্বিতীয় কথা : সময়ের অপচয়। এটা গুনাহ, স্বতন্ত্র গুনাহ। যদিও আমাদের সকল কাজ সময়ের সাথে বাঁধা। আমরা সময়ের উর্ধ্বে উঠে কোনো কাজ করতে পারি না। কিন্তু যদি সময়ের উর্ধ্বে উঠে কোনো গুনাহের কাজ করা যেত তবে কি ঐ গুনাহর কাজ গুনাহ হতো না? অবশ্যই হত। বোঝা গেল, গুনাহের কাজ এমনিতেই গুনাহ আর সময়ের অপচয় আলাদা গুনাহ। সময়কে কোনো কাজে না লাগানো বা হেলায় নষ্ট করা ভিন্ন একটা গুনাহ। সকল শ্রেণীর মানুষ এখন এই গুনাহে লিপ্ত। সময়-অপচয়-রোগে আমরা সবাই আক্রান্ত। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার ধারণা, মহিলাদের মধ্যে এ সমস্যাটা বেশি।
তাদের সময় বিভিন্নভাবে অপচয় হয়। একটা হল সাংসারিক কাজ। বলতে পারেন, এটা তো বড় কঠিন কথা, কাজের মধ্যে থাকলে আবার সময়ের অপচয় হয় কীভাবে! আমি বলি, ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কাজ? গ্রামের মহিলাদের সারাদিন কাজ আর কাজ। সারাদিন কেন কাজ? কোথায় আপনার একটু আরাম-বিশ্রাম, তালিম-তিলাওয়াত, নফল নামায, যিকির-আযকার? আসলে আমরা কাজ অনেক করি বটে, কিন্তু সুশৃঙ্খলভাবে করি না। রুটিন মোতাবেক করি না। অনেক সময় কাজ ফেলেও রাখি, সময় মতো করি না। ফলে আমাদের সময়ে বরকত হয় না। অপচয় হয়ে যায় বহু সময়। এজন্য প্রত্যেক ঘরে মহিলারা সময়সূচি বানিয়ে নিবেন। রুটিন মাফিক কাজ করলে দেখবেন অনেক সময় বেঁচে যাবে। আপনি রুটিনে তালিম-তেলওয়াতের জন্য সময় বরাদ্দ রাখুন। নফল নামাযের জন্য সময় বের করুন। আরাম-বিশ্রামের জন্য সময় খালি করুন। ঠিকমতো বিশ্রাম না নেওয়ার কারণে মহিলাদের শারীরিক কত সমস্যা হয়। আপনি ঠিক করুন, ঠিক কতটা থেকে কতটার মধ্যে নাশতা প্রস্তুত করবেন, বাচ্চাদেরকে মাদরাসায় কখন পাঠাবেন। দুপুরের রান্না কখন শুরু করবেন কখন শেষ করবেন। আপনার কাজ যদি সময় মতো হয়, গোছালো হয়, অলসতা না করে যদি সব কাজ সময় মতো করে ফেলতে পারেন, তাহলে আপনি ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনী কাজের জন্য অনেক সময় বের করতে পারবেন। আর না হয় কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে এবং পুরোটা দিন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আপনি একটু আরাম-বিশ্রামেরও সময় পাবেন না।
আপনি লক্ষ্য রাখুন, যেন কম থেকে কম সময়ে বাচ্চাদের খাওয়া-গোসল ইত্যাদি হয়ে যায়, সেভাবে ওদের গড়ে তুলুন। স্বামীরা স্ত্রীদের সময় বাঁচনোর প্রতি লক্ষ রাখুন। নিজের খাওয়ার বর্তনটা স্ত্রীর ধোওয়ার জন্য রেখে না দিয়ে নিজেই ধুয়ে ফেলুন। দস্তরখান বিছানো-গুটানোর ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সহায়তা করুন। সময় হলে ঘরের অন্যান্য কাজে অংশ নিয়ে স্ত্রীর কাজ এগিয়ে দিন। এটা পুরুষের দায়িত্ব। পুরুষের উদ্দেশ্যে যখন কথা বলবো তখন এ-বিষয়ে আরও বলা যাবে। আজ তো মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলছি। সুতরাং ঘরওয়ালি হিসাবে যে কাজের দায়িত্ব আপনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন, যে কাজ আপনি করবেনই, সে কাজ সময় মতো করুন। উদ্যমের সাথে করুন। তাহলে আপনি দ্বীন শেখার জন্য সময় বের করতে পারবেন। ইবাদত-বন্দেগীতে অগ্রসর হতে পারবেন।
ছোটকালে আমি আমার মার সঙ্গে রান্না ঘরে যেতাম। একদিন তিনি আউয়াল ওয়াক্তে যোহর পড়ে রান্না করতে এলেন। কী কারণে যেন আগুন ধরতে দেরি হচ্ছিল। লক্ষ্য করলাম, তিনি দোয়া পড়ছেন আর কেঁদে কেঁদে বলছেন, আহারে! নামাযের সময় বুঝি যায়! নামাযের সময় বুঝি যায়! আমি বললাম, এই না আপনি যোহর পড়ে এলেন, নামাযের সময় তাহলে যায় কোথায়? বললেন, ‘আসরের সময় চলে যায়!’অর্থাৎ এই যে আগুন জ্বলছে না, রান্না শুরুই হচ্ছে না, দেরি হয়ে যাচ্ছে, রান্নার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে তো আমি আসরের নামায আওয়াল ওয়াক্তে পড়তে পারবো না। চিন্তা করুন, এইমাত্র যোহর পড়ে এলেন, কিন্তু আগুন জ্বলতে একটু দেরি হচ্ছে বলে এখনই তাঁর আসরের সময় চলে যাচ্ছে!
আমরা সাধারণত দশটা উনষাট মিনিট হয়ে গেলেও এগারটা বাজেনি মনে করি। কিন্তু আমার আম্মা ঘড়ির কাঁটা দশটা পার হলেই বলতেন এগারটা বেজে গেছে। আসলেও তাই। দশটার পরের মিনিটগুলো এগারটার মিনিট দশটার নয়। আর এগারটা বাজার পর যে মিনিট সেটা তো এগারটার নয়, বারটার মিনিট!
তৃতীয় কথা : স্বামীর সাথে ভাল আচরণ। স্বামী যারা, তাদেরকে আদর্শ স্বামী হওয়ার জন্য যা জানা দরকার, প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার, তা তো আমরা নিইনি। স্বীকার করছি, আমরা আদর্শ স্বামী হতে পারিনি। আদর্শ স্বামীর গুণাবলী আমরা শিখিনি। ইসলাম কিন্তু খুব শিখিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য আদর্শ। তাঁর আদর্শই তো আদর্শ। কিন্তু নবীজীর সীরাত থেকে আমরা আদর্শ স্বামীর সেই গুণাবলী হাসিল করতে পারিনি। আমরা ভাল স্বামী নই, আমরা ‘আসামী’। এখন যেহেতু নারীদের উদ্দেশ্যে কথা বলছি সে জন্য ঐ প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। মা-বোনদের বলছি, আমরা যেন আমাদের আচরণ সুন্দর করি। আচরণ সুন্দর করার অনেক দিক আছে। সব তো আর এক মজলিশে বলা সম্ভব নয়। বলার দরকারও নেই। আপনারা মনিতেই জানেন। আমি শুধু সওয়াব হাসিলের জন্য একটি কথা তুলে ধরছি। যে কথা হাদীসেও এসেছে।
‘কখনও, কোন সময়, সব সময়’এই শব্দগুলো বিরক্তির সময় আমরা ব্যবহার করি। স্বামীর আচরণ একটু খারাপ লাগলেই বলে উঠি, তুমি ‘সব সময়’আমার সাথে এমন কর। এখানে ‘সব সময়’শব্দটা অপাত্রে ব্যবহার হয়েছে। আসলেই কি সব সময় আপনার স্বামী আপনার সাথে এমন করে? স্বামীরা বাহিরে বাহিরে থাকে। স্ত্রীদেরকে সময় কম দেয়। স্ত্রী এক দিন সময় চাইলেন। স্বামী ব্যস্ততা দেখালেন আর অমনি স্ত্রী বলে উঠলেন, ‘কখনও তোমার কাছে একটু সময় পাই না! কোনো দিন তুমি আমাকে সময় দাও না।’এই যে পাইকারি বলা, ‘সব সময় তুমি এরকম কর, কখনও তোমার কাছে একটু ভাল ব্যবহার পাই না, কোনো সময় তোমার কাছে একটা জিনিস চাইলে পাই না।’- এই ভাষাগুলো ঠিক না। হাদীসে এসেছে, গড়পড়তা নারীদের অভ্যাস হল, একটুতেই তারা স্বামীদের সব অনুগ্রহ ভুলে যায় এবং বলে উঠে,
مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَط ‘তোমার কাছে কখনও ভাল ব্যবহার দেখলাম না!’আহারে! কিচ্ছুই দেখেননি? এটা কীভাবে হয়! কিছু না কিছু দেখেছেন, অবশ্যই দেখেছেন! তাহলে এরকম করে বলার কী দরকার। এমন কথা স্ত্রী বললে স্বামীর মনে আঘাত লাগে, তিনি বড় কষ্ট পান। স্বামী বললেও স্ত্রীর মন ভেঙ্গে যায়, তিনি ভীষণ আঘাত পান।
উর্দুতে এজাতীয় একটি শব্দ হল হামেশা। মুফতি রফী উসমানী সাহেব হুযুরের বয়ানেও কথাটা আছে। একদিন তরকারিতে লবণ একটু কম হল, আপনি ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলেন, ‘সব সময় তরকারিতে লবণ কম হয়, রান্না একটা দিনও খাওয়ার মত হয় না।’ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন... একটা দিনও কি তরকারি খাওয়ার মত হয় না? আরে ভাই আপনি বলতে পারেন, সব সময় তো স্বাদ হয়! আজ বুঝি লবণটা কম হয়ে গেছে! আর এটাই বা বলার কী দরকার। ওরা কি খাওয়ার সময় বিষয়টা বুঝবে না? হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর ঘটনা শুনেছি, লবণ মোটেই দেয়া হয়নি এমন তরকারি হুযুর বিনাবাক্যে খেয়ে মাদরাসায় চলে গেলেন, কিছুই বলেননি। অন্যরা খেতে বসে তো আশ্চর্য! হুযুর তো কিছুই বললেন না। হুযুর তো কিছুই বললেন না! -আমাদেরকেও এমন হতে হবে। এ জাতীয় কথা পরিহার করতে হবে। আমরা বরং প্রশংসা করব, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। তাহলে স্ত্রীরা আমাদের কাছে শিখবে। স্ত্রীরা করলে স্বামীরা শিখবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে শেখার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আরেকটি কথা আরজ করছি। আগের যামানার মহিলা আর এ যামানার মহিলাদের মাঝে বিশেষ একটি পার্থক্য আছে। ‘রিসালাতুল মুস্তারশিদীন’কিতাবে আমি পড়েছি। ইহইয়াউ উলূমিদ্দীনসহ আরও অনেক কিতাবে কথাটা আছে। আগে যখন স্বামীরা রোজগারের জন্য ঘর থেকে বের হতেন, তখন স্ত্রীরা বলত, نَصْبِرُ عَلَى الْجُوعِ وَلَا نَصْبِرُ عَلَى النَّارِ আপনি আমাদের জন্য কামাই করতে যাচ্ছেন, সংসার চালানোর জন্য রোজগার করতে বের হচ্ছেন, আমরা আপনাকে আস্বস্ত করছি যে, আমরা দারিদ্র্যের উপর সবর করতে রাজী, ক্ষুধার কষ্ট সইতে প্রস্তুত, আজ এটা নেই কাল ওটা নেই, অভাব-অনটন চলছেই চলছে...এর উপর আমরা ধৈর্য ধরব। কিন্তু জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে পারব না। সুতরাং হালালভাবে যা পাবেন কেবল ততটুকু আনবেন, হারাম কিছু আনার চেষ্টা করবেন না। আমরা না খেয়ে কম খেয়ে থাকতে পারব কিন্তু দোযখের আগুন সইতে পারব না। এই ছিল আগের কালের মহিলাদের ভাষা। আর এই যামানার মহিলারা স্বামীর হাতে লম্বা তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, এগুলো আমার চাই। তালিকা দেখে স্বামী বেচারা বিমর্ষ হয়ে পড়ে। স্ত্রীকে অনুনয় করে বলে, আমি এত কিছু কীভাবে আনব, আমার আয় তো তোমার সামনে? তুমি তো জান আমার কত আয়! স্ত্রীর এক কথা; তোমার কত আয় আমার তা জানার দরকার নেই। এই জিনিসগুলো আমার চাই, এগুলো ছাড়া দিন চলবে না। এই যুগে এমন মহিলা অনেক। কিন্তু আগে এমন ছিল না। কম হোক আপত্তি নেই, কিন্তু হারাম তারা সহ্য করতেন না। আল্লাহ তাআলা সকল মহিলাদেরকে এমন হওয়ার তাওফীক দান করুন। পুরুষদেরও আগের পুরুষদের মত নেককার হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
[মুসাজ্জিলা থেকে বয়ানটি পত্রস্থ করেছেন মাহমুদ হাসান মাসরূর। জাযাহুল্লাহু খাইরান]
.
[ মাসিক আলকাউসার » জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৭ . মার্চ ২০১৬ ]মাসতুরাতের উদ্দেশ্যে তিনটি কথা
.
-- মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
.
প্রথম কথা : আল্লাহ তাআলা মাকে সন্তানের মাদরাসা বানিয়েছেন। মায়ের কোল সন্তানের মাদরাসা। তাবলীগের বড় মুরুব্বী হাজী আব্দুল মুকীত রাহ.-এর জামাতা প্রফেসর ড. আনওয়ারুল করীম সাহেব একবার হযরতজী এনামুল হাসান ছাহেব রাহ.-কে জিজ্ঞেস করলেন, হুযুর! এখন এত মাদরাসা, দ্বীনী তালীমের এত সুযোগ-সুবিধা, এরপরও নতুন প্রজন্ম খারাপ কেন, ওদের মধ্যে ভালো কম কেন? সাহাবায়ে কেরামের যামানায়, তাবেঈ-তাবে তাবেঈর যামানায় তো এত মাদরাসা ছিল না, তবু সেই যামানার সবাই ভাল, সব ছেলে ভাল। এখন কেন খারাপ? এত মাদরাসা সত্ত্বেও কেন ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ভালোর সংখ্যা কম? সম্ভবত হযরতজী বললেন, আরে! তখন মাদরাসা ছিল বেশী এখন মাদরাসা কম! এখন তো তুমি ছয়/সাত বছর বয়সে সন্তানকে মাদরাসায় পাঠাও, ভর্তি করাও। সে এক মাদরাসায় পড়ে, যতক্ষণ মাদরাসায় থাকে ততক্ষণ শুধু মাদরাসা। আর আগে সন্তান যেদিন ভূমিষ্ঠ হত সেদিন থেকে প্রতিটি মুহূর্তই হতো তার মাদরাসা, প্রতিটি কোলই ছিল তার একেকটি মাদরাসা। মায়ের কোলে আছে তো মাদরাসায় আছে। বোনের কোলে আছে তো আরেক মাদরাসায় আছে। ভাই কোলে নিয়েছে তো সে মাদরাসাতেই আছে। তখন সন্তান দুনিয়াতে আসার পর যার কোলে যাক যে দিকে তাকাক, যার হাতে যাক যে দিকে বের হোক- সবখানে মাদরাসা আর মাদরাসা। অর্থাৎ সে যেখানেই যাবে যার কাছেই থাকবে সে দ্বীনদার পাবে, দ্বীনী পরিবেশ পাবে। যে বোনের কোলে আছে, সে বোন মিথ্যা বলে না, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। ভায়ের কোলে গেল তো ভাই-ও ভদ্র ছেলে, নামাযী, কারো গীবত-শেকায়েত করে না। বাবা এসেছেন, তার কোলে গেল, তিনিও ভাল, তার কামাই হালাল, দুনিয়ার পিছে পড়ে নামায ছাড়েন না। ধন-সম্পদ গড়ার জন্য হারামে লিপ্ত হন না। তার মানে, সন্তান যার কোলে যাচ্ছে যার কাছে যাচ্ছে মাদরাসায় যাচ্ছে! আর এখন? কোথায় সেই মাদরাসা?
সন্তান যেখানে যাবে যার কোলে থাকবে, সেখানেই যদি আগের মত মাদরাসা হতো, তাহলে তো ভাল ছিল। কিন্তু তা যদি না হয়, অন্তত প্রত্যেক সন্তানের প্রথম কোলটি যেন হয় মাদরাসা। যিনি এ সন্তানকে ধারণ করছেন, বহন করছেন দশ মাস দশ দিন, তাঁর আখলাক যদি ভাল হয়, তাঁর মধ্যে যদি দ্বীন-ঈমান থাকে, নামায থাকে কুরআন থাকে, ভাল ব্যবহার থাকে, তবে সন্তানের উপর এর প্রভাব পড়বেই পড়বে। প্রত্যেক নারীকে বুঝতে হবে, আপনার ব্যক্তি-সত্তাই আপনার সন্তানের মাদরাসা। আপনিই আপনার সন্তানের প্রথম মাদরাসা। আপনি ভাল সন্তান ভাল, আপনি খারাপ সন্তান খারাপ। হয়ত বলবেন, মা অনে-ক ভাল, সন্তান খারাপ- এমনও তো দেখা যায়! আসলে এমনটা খুব কম হয়। হলেও পরে ঠিক হয়ে যায়। আরেক কথা হল, মা যে অনেক ভাল, আমরা তাঁর বাহ্যিক অবস্থা দেখে সুধারণা করছি। কিন্তু মার তো নিজের হিসাব নিজে নেওয়া দরকার, আমি কতটুকু ভাল। নিশ্চই আমার কোনো ত্রুটি আছে, মানুষ জানে না, কিন্তু আল্লাহ জানেন। আমাকে আমার সেই ত্রুটি সংশোধন করতে হবে।
আমরা ছেলে-মেয়েদের শাসন করি কথা দিয়ে, হাত দিয়ে। বেশি ভাল হলে হয়ত হাত ব্যবহার করি না, শুধু কথা দিয়ে শাসন করি। কিন্তু সন্তানের শাসন-পদ্ধতি কি শুধু হাত আর মুখ ব্যবহার? বকাঝকা করা আর লাঠি হাতে নেওয়া? আসলে এভাবে শাসন হয় না। মূলত সন্তান শাসনের প্রথম কথা হল আমি ভাল হওয়া, এক নম্বরে আমি ভাল হওয়া। আমার আমল-আখলাক, আমার আচার-ব্যবহার, চিন্তা-চেতনা ভাল হওয়া। বাপের রোজগার হালাল হওয়া। এ হল সন্তান শাসনের মৌলিক কথা। মা-বোনদের প্রতি নসীহত, আপনারা স্মরণ রাখবেন, আপনারা হলেন সন্তানের প্রথম মাদরাসা। প্রথম থেকেই মাদরাসা। আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন সন্তান আপনার কাছ থেকে শিখতে থাকবে। কাজেই আপনারা আপনাদের যতœ নিন।
দ্বিতীয় কথা : সময়ের অপচয়। এটা গুনাহ, স্বতন্ত্র গুনাহ। যদিও আমাদের সকল কাজ সময়ের সাথে বাঁধা। আমরা সময়ের উর্ধ্বে উঠে কোনো কাজ করতে পারি না। কিন্তু যদি সময়ের উর্ধ্বে উঠে কোনো গুনাহের কাজ করা যেত তবে কি ঐ গুনাহর কাজ গুনাহ হতো না? অবশ্যই হত। বোঝা গেল, গুনাহের কাজ এমনিতেই গুনাহ আর সময়ের অপচয় আলাদা গুনাহ। সময়কে কোনো কাজে না লাগানো বা হেলায় নষ্ট করা ভিন্ন একটা গুনাহ। সকল শ্রেণীর মানুষ এখন এই গুনাহে লিপ্ত। সময়-অপচয়-রোগে আমরা সবাই আক্রান্ত। আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার ধারণা, মহিলাদের মধ্যে এ সমস্যাটা বেশি।
তাদের সময় বিভিন্নভাবে অপচয় হয়। একটা হল সাংসারিক কাজ। বলতে পারেন, এটা তো বড় কঠিন কথা, কাজের মধ্যে থাকলে আবার সময়ের অপচয় হয় কীভাবে! আমি বলি, ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কাজ? গ্রামের মহিলাদের সারাদিন কাজ আর কাজ। সারাদিন কেন কাজ? কোথায় আপনার একটু আরাম-বিশ্রাম, তালিম-তিলাওয়াত, নফল নামায, যিকির-আযকার? আসলে আমরা কাজ অনেক করি বটে, কিন্তু সুশৃঙ্খলভাবে করি না। রুটিন মোতাবেক করি না। অনেক সময় কাজ ফেলেও রাখি, সময় মতো করি না। ফলে আমাদের সময়ে বরকত হয় না। অপচয় হয়ে যায় বহু সময়। এজন্য প্রত্যেক ঘরে মহিলারা সময়সূচি বানিয়ে নিবেন। রুটিন মাফিক কাজ করলে দেখবেন অনেক সময় বেঁচে যাবে। আপনি রুটিনে তালিম-তেলওয়াতের জন্য সময় বরাদ্দ রাখুন। নফল নামাযের জন্য সময় বের করুন। আরাম-বিশ্রামের জন্য সময় খালি করুন। ঠিকমতো বিশ্রাম না নেওয়ার কারণে মহিলাদের শারীরিক কত সমস্যা হয়। আপনি ঠিক করুন, ঠিক কতটা থেকে কতটার মধ্যে নাশতা প্রস্তুত করবেন, বাচ্চাদেরকে মাদরাসায় কখন পাঠাবেন। দুপুরের রান্না কখন শুরু করবেন কখন শেষ করবেন। আপনার কাজ যদি সময় মতো হয়, গোছালো হয়, অলসতা না করে যদি সব কাজ সময় মতো করে ফেলতে পারেন, তাহলে আপনি ইবাদত-বন্দেগী ও দ্বীনী কাজের জন্য অনেক সময় বের করতে পারবেন। আর না হয় কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে এবং পুরোটা দিন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আপনি একটু আরাম-বিশ্রামেরও সময় পাবেন না।
আপনি লক্ষ্য রাখুন, যেন কম থেকে কম সময়ে বাচ্চাদের খাওয়া-গোসল ইত্যাদি হয়ে যায়, সেভাবে ওদের গড়ে তুলুন। স্বামীরা স্ত্রীদের সময় বাঁচনোর প্রতি লক্ষ রাখুন। নিজের খাওয়ার বর্তনটা স্ত্রীর ধোওয়ার জন্য রেখে না দিয়ে নিজেই ধুয়ে ফেলুন। দস্তরখান বিছানো-গুটানোর ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সহায়তা করুন। সময় হলে ঘরের অন্যান্য কাজে অংশ নিয়ে স্ত্রীর কাজ এগিয়ে দিন। এটা পুরুষের দায়িত্ব। পুরুষের উদ্দেশ্যে যখন কথা বলবো তখন এ-বিষয়ে আরও বলা যাবে। আজ তো মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলছি। সুতরাং ঘরওয়ালি হিসাবে যে কাজের দায়িত্ব আপনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন, যে কাজ আপনি করবেনই, সে কাজ সময় মতো করুন। উদ্যমের সাথে করুন। তাহলে আপনি দ্বীন শেখার জন্য সময় বের করতে পারবেন। ইবাদত-বন্দেগীতে অগ্রসর হতে পারবেন।
ছোটকালে আমি আমার মার সঙ্গে রান্না ঘরে যেতাম। একদিন তিনি আউয়াল ওয়াক্তে যোহর পড়ে রান্না করতে এলেন। কী কারণে যেন আগুন ধরতে দেরি হচ্ছিল। লক্ষ্য করলাম, তিনি দোয়া পড়ছেন আর কেঁদে কেঁদে বলছেন, আহারে! নামাযের সময় বুঝি যায়! নামাযের সময় বুঝি যায়! আমি বললাম, এই না আপনি যোহর পড়ে এলেন, নামাযের সময় তাহলে যায় কোথায়? বললেন, ‘আসরের সময় চলে যায়!’অর্থাৎ এই যে আগুন জ্বলছে না, রান্না শুরুই হচ্ছে না, দেরি হয়ে যাচ্ছে, রান্নার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে তো আমি আসরের নামায আওয়াল ওয়াক্তে পড়তে পারবো না। চিন্তা করুন, এইমাত্র যোহর পড়ে এলেন, কিন্তু আগুন জ্বলতে একটু দেরি হচ্ছে বলে এখনই তাঁর আসরের সময় চলে যাচ্ছে!
আমরা সাধারণত দশটা উনষাট মিনিট হয়ে গেলেও এগারটা বাজেনি মনে করি। কিন্তু আমার আম্মা ঘড়ির কাঁটা দশটা পার হলেই বলতেন এগারটা বেজে গেছে। আসলেও তাই। দশটার পরের মিনিটগুলো এগারটার মিনিট দশটার নয়। আর এগারটা বাজার পর যে মিনিট সেটা তো এগারটার নয়, বারটার মিনিট!
তৃতীয় কথা : স্বামীর সাথে ভাল আচরণ। স্বামী যারা, তাদেরকে আদর্শ স্বামী হওয়ার জন্য যা জানা দরকার, প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার, তা তো আমরা নিইনি। স্বীকার করছি, আমরা আদর্শ স্বামী হতে পারিনি। আদর্শ স্বামীর গুণাবলী আমরা শিখিনি। ইসলাম কিন্তু খুব শিখিয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য আদর্শ। তাঁর আদর্শই তো আদর্শ। কিন্তু নবীজীর সীরাত থেকে আমরা আদর্শ স্বামীর সেই গুণাবলী হাসিল করতে পারিনি। আমরা ভাল স্বামী নই, আমরা ‘আসামী’। এখন যেহেতু নারীদের উদ্দেশ্যে কথা বলছি সে জন্য ঐ প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না। মা-বোনদের বলছি, আমরা যেন আমাদের আচরণ সুন্দর করি। আচরণ সুন্দর করার অনেক দিক আছে। সব তো আর এক মজলিশে বলা সম্ভব নয়। বলার দরকারও নেই। আপনারা মনিতেই জানেন। আমি শুধু সওয়াব হাসিলের জন্য একটি কথা তুলে ধরছি। যে কথা হাদীসেও এসেছে।
‘কখনও, কোন সময়, সব সময়’এই শব্দগুলো বিরক্তির সময় আমরা ব্যবহার করি। স্বামীর আচরণ একটু খারাপ লাগলেই বলে উঠি, তুমি ‘সব সময়’আমার সাথে এমন কর। এখানে ‘সব সময়’শব্দটা অপাত্রে ব্যবহার হয়েছে। আসলেই কি সব সময় আপনার স্বামী আপনার সাথে এমন করে? স্বামীরা বাহিরে বাহিরে থাকে। স্ত্রীদেরকে সময় কম দেয়। স্ত্রী এক দিন সময় চাইলেন। স্বামী ব্যস্ততা দেখালেন আর অমনি স্ত্রী বলে উঠলেন, ‘কখনও তোমার কাছে একটু সময় পাই না! কোনো দিন তুমি আমাকে সময় দাও না।’এই যে পাইকারি বলা, ‘সব সময় তুমি এরকম কর, কখনও তোমার কাছে একটু ভাল ব্যবহার পাই না, কোনো সময় তোমার কাছে একটা জিনিস চাইলে পাই না।’- এই ভাষাগুলো ঠিক না। হাদীসে এসেছে, গড়পড়তা নারীদের অভ্যাস হল, একটুতেই তারা স্বামীদের সব অনুগ্রহ ভুলে যায় এবং বলে উঠে,
مَا رَأَيْتُ مِنْكَ خَيْرًا قَط ‘তোমার কাছে কখনও ভাল ব্যবহার দেখলাম না!’আহারে! কিচ্ছুই দেখেননি? এটা কীভাবে হয়! কিছু না কিছু দেখেছেন, অবশ্যই দেখেছেন! তাহলে এরকম করে বলার কী দরকার। এমন কথা স্ত্রী বললে স্বামীর মনে আঘাত লাগে, তিনি বড় কষ্ট পান। স্বামী বললেও স্ত্রীর মন ভেঙ্গে যায়, তিনি ভীষণ আঘাত পান।
উর্দুতে এজাতীয় একটি শব্দ হল হামেশা। মুফতি রফী উসমানী সাহেব হুযুরের বয়ানেও কথাটা আছে। একদিন তরকারিতে লবণ একটু কম হল, আপনি ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলেন, ‘সব সময় তরকারিতে লবণ কম হয়, রান্না একটা দিনও খাওয়ার মত হয় না।’ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন... একটা দিনও কি তরকারি খাওয়ার মত হয় না? আরে ভাই আপনি বলতে পারেন, সব সময় তো স্বাদ হয়! আজ বুঝি লবণটা কম হয়ে গেছে! আর এটাই বা বলার কী দরকার। ওরা কি খাওয়ার সময় বিষয়টা বুঝবে না? হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর ঘটনা শুনেছি, লবণ মোটেই দেয়া হয়নি এমন তরকারি হুযুর বিনাবাক্যে খেয়ে মাদরাসায় চলে গেলেন, কিছুই বলেননি। অন্যরা খেতে বসে তো আশ্চর্য! হুযুর তো কিছুই বললেন না। হুযুর তো কিছুই বললেন না! -আমাদেরকেও এমন হতে হবে। এ জাতীয় কথা পরিহার করতে হবে। আমরা বরং প্রশংসা করব, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। তাহলে স্ত্রীরা আমাদের কাছে শিখবে। স্ত্রীরা করলে স্বামীরা শিখবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে শেখার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আরেকটি কথা আরজ করছি। আগের যামানার মহিলা আর এ যামানার মহিলাদের মাঝে বিশেষ একটি পার্থক্য আছে। ‘রিসালাতুল মুস্তারশিদীন’কিতাবে আমি পড়েছি। ইহইয়াউ উলূমিদ্দীনসহ আরও অনেক কিতাবে কথাটা আছে। আগে যখন স্বামীরা রোজগারের জন্য ঘর থেকে বের হতেন, তখন স্ত্রীরা বলত, نَصْبِرُ عَلَى الْجُوعِ وَلَا نَصْبِرُ عَلَى النَّارِ আপনি আমাদের জন্য কামাই করতে যাচ্ছেন, সংসার চালানোর জন্য রোজগার করতে বের হচ্ছেন, আমরা আপনাকে আস্বস্ত করছি যে, আমরা দারিদ্র্যের উপর সবর করতে রাজী, ক্ষুধার কষ্ট সইতে প্রস্তুত, আজ এটা নেই কাল ওটা নেই, অভাব-অনটন চলছেই চলছে...এর উপর আমরা ধৈর্য ধরব। কিন্তু জাহান্নামের আগুন সহ্য করতে পারব না। সুতরাং হালালভাবে যা পাবেন কেবল ততটুকু আনবেন, হারাম কিছু আনার চেষ্টা করবেন না। আমরা না খেয়ে কম খেয়ে থাকতে পারব কিন্তু দোযখের আগুন সইতে পারব না। এই ছিল আগের কালের মহিলাদের ভাষা। আর এই যামানার মহিলারা স্বামীর হাতে লম্বা তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, এগুলো আমার চাই। তালিকা দেখে স্বামী বেচারা বিমর্ষ হয়ে পড়ে। স্ত্রীকে অনুনয় করে বলে, আমি এত কিছু কীভাবে আনব, আমার আয় তো তোমার সামনে? তুমি তো জান আমার কত আয়! স্ত্রীর এক কথা; তোমার কত আয় আমার তা জানার দরকার নেই। এই জিনিসগুলো আমার চাই, এগুলো ছাড়া দিন চলবে না। এই যুগে এমন মহিলা অনেক। কিন্তু আগে এমন ছিল না। কম হোক আপত্তি নেই, কিন্তু হারাম তারা সহ্য করতেন না। আল্লাহ তাআলা সকল মহিলাদেরকে এমন হওয়ার তাওফীক দান করুন। পুরুষদেরও আগের পুরুষদের মত নেককার হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
[মুসাজ্জিলা থেকে বয়ানটি পত্রস্থ করেছেন মাহমুদ হাসান মাসরূর। জাযাহুল্লাহু খাইরান]
.
[ মাসিক আলকাউসার » জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৭ . মার্চ ২০১৬ ]