ভারতের রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদের উল্লম্ফনের ঐতিহাসিক পটভূমি
লেখকঃ বদরুদ্দীন উমরহিন্দুত্ব এখন যেভাবে ভারতের রাজনীতিতে শুধু প্ৰবল প্রভাব নয়, আধিপত্য বিস্তার করেছে, এটা এক ভয়াবহ ব্যাপার। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির জন্যও বিপজ্জনক। এই প্রতিক্রিয়াশীলতা পরাজিত করার জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), বিজেপি বা নরেন্দ্ৰ মোদির সমালোচনা ও বিরোধিতাই যথেষ্ট নয়। বাস্তবতঃ এর কোন কাৰ্যকারিতাও নেই। ভারতের রাজনীতি আজ এ পর্যায়ে এসে দাঁড়ানো কোন অলৌকিক বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ব্যাপার নয়। এটা মনে করাও বড় রকমের এক মূ্র্খতা। অকারণে কিছুই ঘটে না। কাজেই এর কারণ অনুসন্ধান ও সঠিক ব্যাখ্যা ছাড়া এর সমালোচনা ও বিরোধিতা তীব্র হলেও এর পরিবর্তন সম্ভব নয়। বলাই বাহুল্য, ভারতীয় সমাজের মধ্যেই এর মূল প্রোথিত। ভারতের ইতিহাসের মধ্যেই এর কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের ইতিহাস চেতনা ছিল না বললেই চলে। এ কারণে ভারতে বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ ও রামায়ন মহাভারতের মত মহাকাব্য থেকে নিয়ে অনেক উত্তম সাহিত্য রচিত হলেও ইতিহাস চর্চা ভারতীয়দের মধ্যে ছিল না। এর জের হিসেবে পরবর্তীকালেও তাদের নানা বক্তব্য এবং আলোচনায় ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞতারই পরিচয় পাওয়া যায়।
ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ইতিহাসের চেতনা না থাকার কারণেই হিন্দুদের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনেক বিভ্রান্তি ও মিথ্যা ধারণার জন্ম হয়েছে। এই অজ্ঞতা অনেক হিন্দু পণ্ডিত ও মহান ব্যক্তিদের মধ্যেও দেখা যায়। স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে অনেক উদারতা ছিল । সাধারণ অর্থে তাকে সাম্প্রদায়িক বলা যায় না। কিন্তু ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে তাঁর বেশ কিছু বক্তব্য আপাতঃদৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িক বলেই মনে হবে। এই সব বক্তব্যকে অজ্ঞতাপ্রসূত না বললে সাম্প্রদায়িক বলা ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই।
‘মুসলমান অধিকার’ শীর্ষক এক রচনায় বিবেকানন্দ বলছেন, “মুসলমানরাজত্বে অপরদিকে পৌরহিত্যশক্তির প্রাদুর্ভাব অসম্ভব। হযরত মহম্মদ সর্বতোভাবে ঐ শক্তির বিপক্ষ ছিলেন এবং যথাসম্ভব ঐ শক্তির একান্ত বিনাশের জন্য নিয়মাদি করিয়া গিয়াছেন। মুসলমান-রাজত্বে রাজাই স্বয়ং প্রধান পুরোহিত; তিনিই ধর্মগুরু, এবং সম্রাট হইলে (তিনি) প্রায়ই সমস্ত মুসলমান জগতের নেতা হইবার আশা রাখেন। য়াহুদী, বা ঈশাহী মুসলমানের নিকট সম্যক ঘৃণ্য নহে, তাহারা অল্পবিশ্বাসী মাত্ৰ; কিন্তু কাফের মূর্তিপূজাকারী হিন্দু এ জীবনে বলিদান ও অন্তে অনন্ত নরকের ভাগী। সেই কাফেরের ধর্মগুরুদিগকে - পুরোহিতবর্গকে - দয়া করিয়া কোনও কহন; নতুবা রাজার ধর্মানুরাগ একটু বৃদ্ধি হইলেই কাফের হত্যারূপ মহাযজ্ঞের আয়ােজন” (বিবেকানন্দ রচনাসমগ্ৰ, নবপত্র প্রকাশন, সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১০১)
ইসলাম পুরোহিততন্ত্রের বিরোধী হলেও এবং খলিফা হিসেবে রাজা স্বয়ং ধর্মগুরু হলেও ভারতের মুসলমান নবাব বাদশাহরা ধর্মগুরু ছিলেন না। মধ্যপ্রাচ্যেও মুসলমান সুলতান ও বাদশাহরা যে সকলে ধর্মগুরু ছিলেন এমন নয়। হযরত মহম্মদের পর চার খলিফা এবং উমাইয়া ও আব্বাসীয় সুলতান ও বাদশাহরা খলিফা হিসেবে ধর্মগুরু ছিলেন। তবে পরের দিকে মুসলমান খলিফারা ধর্মগুরু হিসেবে সে রকম প্রভাবশালী ছিলেন না। তাছাড়া কোন সময়েই হিন্দু সমাজের সাথে তাদের কোন যোগ ছিল না। ভারতে সুলতানী এবং পাঠান মোগল আমলে সম্রাটরা নিজেদেরকে ইসলাম ধর্মগুরু বলে দাবী করতেন না। ধর্মগুরু হিসেবে ছিলেন সুফী ও ইসলাম ধর্মপ্রচারকরা যাদের মধ্যে ছিলেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী, নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মত সাধকরা । তারা ধর্ম প্রচারের জন্য অস্ত্ৰ ব্যবহার করতেন না। তাঁদের দ্বারা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে তাদেরকে ধর্মান্তরিত করার কোন দৃষ্টান্ত নেই। সুলতান ও বাদশাহরাও একাজ করতেন এমন নয়। ক্ষেত্র বিশেষে এর ব্যতিক্রম হলেও ইসলামের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। সেটা করা হতো সাম্রাজ্যিক কারণে। এ প্রসঙ্গে এখানে বলা দরকার যে, মুসলমান আমলে সুলতান ও বাদশাহদের শাসন ব্যবস্থায় অনেক হিন্দু উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মোগল আমলে, এমনকি আওরঙ্গজেবের আমলেও, দরবারে ও সেনাবাহিনীতে হিন্দুদের উপস্থিতি ছিল। আকবরের সময় তো কথাই নেই। তাঁর বিখ্যাত নবরত্বের মধ্যে আবুল ফজল, ফৈজী, মোল্লা দোপেয়াজা, আব্দুর রহিম খান-ই-খানা, ফকির আজিয়াও-দিন ছাড়া অন্য চারজন ছিলেন হিন্দু। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তানসেন, টোডর মল, বীরবল, মান সিং । অন্য কিছু না হােক, আকবরের নবরত্বের কথা কি বিবেকানন্দের জানা ছিল না? কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কিভাবে মুসলমান শাসকদের সম্পর্কে উপরোক্ত কথা বলতে পারলেন এটা বিস্ময়ের ব্যাপার। সুলতানী ও পাঠান মোগল আমলে সারা ভারতে ‘কাফের হত্যারূপ মহাযজ্ঞের আয়োজন’ কখন হয়েছিল তার কোন হদিস তো ইতিহাসে নেই!
ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বিবেকানন্দ বলছেন, “এদিকে আবার আরব মরুভূমে মুসলমানী ধর্মের উদয় হল । বন্যপশু প্ৰায় আরব এক মহাপুরুষের প্রেরণা বলে অদম্য তেজে, অনাহত বলে পৃথিবীর উপর আঘাত করলে।” (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। উদ্ধৃত: সৈয়দ আবদুল হালিম, বাঙালীর মুসলিম উত্তরাধিকার, ২০০৬) এছাড়া তিনি আরও বলছেন, “এই নগণ্য পশু প্ৰায় আরব জাতি বিদ্যুদ্বেগে ভূমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ল” (পরিব্রাজক); “সভ্যতার আকর প্রাচীন গ্ৰীস ডুবে গেল। ... ইউরোপের আলো নিবে গেল, একদিকে অতি বর্বর জাতির আশিয়া খণ্ডে প্রাদুর্ভাব হল - আরব জাতি।” (উদ্ধৃত: সৈয়দ আবদুল হালিম, ঐ) বিবেকানন্দ অবশ্যই মুর্খ ছিলেন না। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য পাণ্ডিত্য ছিল। কিন্তু তিনি যে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞ ছিলেন এর মধ্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে আবার বলা দরকার যে, এ বিষয়ে জ্ঞান থাকলে এই সব মন্তব্য বিদ্বেষ ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই।
হযরত মুহম্মদকে তিনি “মহাপুরুষ” বলেছেন। কিন্তু বর্বর জাতির মধ্যে কি মহাপুরুষের জন্ম সম্ভব? মহাপুরুষ কি আকাশ থেকে পড়ে, না সমাজই সে ধরনের প্রতিভার জন্ম দেয়? আরব দেশে বেদুইনরা এক ধরনের জীবন যাপন করতো। যার সাথে সভ্যতার বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু বেদুইন এবং আরব জাতি তো সমাৰ্থক ছিল না, এখনও নেই। হযরত মহম্মদের আবির্ভাবের আগে আরবে শিক্ষিত লোকের অভাব ছিল না। সে সময়কার আরব সাহিত্য উল্লেখযোগ্য ছিল। ছিলেন ইমরুল কায়েসের মত প্ৰতিভাশালী কবি। আরবী গদ্য সাহিত্যও যথেষ্ট উন্নত ছিল। ইসলামের ঘোরতর শত্রুরাও হযরত মহম্মদের ভাষার উতকর্ষকতা বরাবর স্বীকার করে এসেছেন। তাঁর ভাষা তো আরব সাহিত্যের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার ছিল।
সভ্যতার আকর প্রাচীন গ্ৰীসের ডুবে যাওয়া, ইউরোপের আলো নিবে যাওয়ার কথা বলার পর তিনি বলছেন আরব জাতির মত অতি বর্বর জাতির এশিয়াখণ্ডে প্রাদুর্ভাবের কথা। কিন্তু তিনি কি জানতেন যে, ‘গ্ৰীস ডুবে যাওয়া” এবং “ইউরোপের আলো নিবে যাওয়ার” পরবর্তী পর্যায়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অভ্যুদয়ের আগে পর্যন্ত কয়েক শতাব্দীব্যাপী আরবরাই দুনিয়ায় দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে রেখেছিলেন। এই আরবদেরকে ‘অতি বর্বর জাতি’ বলে আখ্যায়িত করে বিবেকানন্দ কি নিজের অজ্ঞতার পরিচয় দেন নি?
একে বিদ্বেষের পরিবর্তে ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞতা বলাই ঠিক। কারণ মুসলমানদের সম্পর্কে তিনি অন্যত্র আবার বলছেন, “ভারতবর্ষে দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশী কেন? এ কথা বলা মূর্খতা যে, তরবারীর সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল”; “মুসলমানদের ভারতাধিকার দরিদ্র পদদলিতদের উদ্ধারের কারণ হইয়াছিল। এ দারিদ্র্য ও অবহেলার জন্যই আমাদের এক পঞ্চমাংশ লোক মুসলমান হইয়া গিয়াছে। কেবল তরবারি ও অগ্নির কথা বলে ইহা সাধিত হইয়াছিল, একথা মনে করা নিতান্ত পাগলামী।” (ভারতের ভবিষ্যৎ । ঐ । বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র)
উনিশ শতকের হিন্দু নেতাদের মধ্যে বিবেকানন্দ নিজে ধর্মপ্রচারক হওয়া সত্ত্বেও বিবেকানন্দের কথা এখানে এত গুরুত্বের সাথে বলার কারণ তাঁর মধ্যে একটা উদারতাও ছিল। মুসলমান সমাজের প্রতি হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গীর এক ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যে। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের হিন্দু নেতাদের মধ্যে সব থেকে অগ্রগণ্য। তিনি নিজে কোন ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। হিন্দু সমাজ সংস্কার, আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর বেশী অবদান কারও ছিল না। কিন্তু এ হেন বিদ্যাসাগরকে সাম্প্রদায়িক বলা সম্পূর্ণ ভ্ৰান্ত। কারণ মুসলমান সমাজ বলতে তাঁর সময়ে কিছু ছিল এটা তাঁর রচনা ও সমাজ সংস্কার, শিক্ষা ইত্যাদি আন্দোলনের মধ্যে পাওয়া যায় না। তাঁর চিন্তায় মুসলমানদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। এটা না হলে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে তাঁর পরিপূর্ণ ঔদাসীন্য সম্ভব হতো না। মুসলমান সমাজ থেকে তাঁর এই বিচ্ছিন্নতা তাৎপর্যপূর্ণ। অন্য যে বিষয়টি বলা দরকার তা হলো, ইতিহাস তাঁর জ্ঞান চর্চার বিষয় ছিল না । ইংরেজদের সস্তা প্রচারণার শিকার হয়ে তিনি তার এক রচনায় সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজদের বানানাে অন্ধকূপ হত্যার গল্প অনুযায়ী “পামর” ইত্যাদি বলে যেভাবে গালাগালি করেছিলেন তার থেকে বোঝা যায় ইতিহাস বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধি। এদিক দিয়ে বিদ্যাসাগর কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। হিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায় ও সমাজপতিদের এটাই ছিল সাধারণ অবস্থা। এদিক দিয়ে এক বড় ব্যতিক্রম ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ইতিহাস চর্চা ক্ষেত্রে বর্ণ হিন্দুদের অনীহা যে ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমানের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার জন্য কতখানি দায়ী এ নিয়ে কোন গবেষণা আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে জানা নেই।
ভারতীয়দের ইতিহাস চর্চা বিষয়ে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর ভারতবর্ষের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, “আমাদের এই মান্ধান্তাপন্থী দেশে প্রায় আদিযুগ থেকে মনে হয় যেন সুপরিকল্পিকভাবে সমাজের স্থিতিশীলতাকে নিশ্চিত করার অভিপ্ৰায় নিয়ে, ইতিহাস বিষয়ে অনীহা এবং ঔদাসীন্য অত্যন্ত গভীরভাবে জনমানসে সঞ্চারিত করা হয়েছে। ইতিহাসকে ‘পঞ্চতম বেদ’ আখ্যা অবশ্য দেওয়া হয়েছেঃ ‘ইতিহাস’, ‘পুরান’ ইত্যাদি বিষয়ে বহু প্ৰশস্তিও উচ্চারিত হয়েছে; কিন্তু ইতিহাস অনুধাবন এবং প্রণয়নের প্রয়াস থেকে ভারত প্রতিভা প্রকৃত প্রস্তাবে নিরস্ত থেকেছে। প্রাচীন গ্রীসে Herodotus, Thucydides প্রভৃতি মনস্বী যে পরম্পরার প্রতিনিধি, তার অনুরূপ কিছু আমাদের নেই।” (হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪-৫)
বিবেকানন্দ যে আরবদেরকে ‘নগণ্য পশু’ ‘বর্বর’ ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করেছেন তাদের কীর্তি বিষয়ে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ঐ একই গ্রন্থে বলছেন, “আমাদের দেশে আরবরাই প্ৰথমে ইতিহাস (যার আরব প্রতিশব্দ হলো “তারিখ”) বিষয়টির প্রকৃত প্রবর্তনা করেছিলেন। তিথির হিসেবে রামচন্দ্র এবং শ্ৰীকৃষ্ণের জন্মক্ষণ আমরা জানি, কিন্তু ‘রামনবমী’ বা ‘জন্মাষ্টমী’ পালনকালে জানার দরকারই অনুভূত হয় না যে কোন যুগে কোন বৎসরে কোন দিন সেই পূণ্য ঘটনা ঘটেছিল। গ্ৰীক বিবরণীতে ‘Sandroikottos’ এর উল্লেখ আছে বলেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে চন্দ্ৰগুপ্ত মৌর্যের ‘তারিখ’ স্থির করা-এর পূর্বতন কয়েক সহস্ৰ বৎসরের ঘটনার কাল নির্দেশন এখনও অনেকটা অনুমান সাপেক্ষ। শুধু তাই কেন, এরই যেন জের টেনে একেবারে আধুনিক কালের ঘটনা নিয়েও প্রচুর মতবিভেদ আজও চলেছে।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৫-৬)
হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে আরও বলছেন, “প্রাচীন ভারতের সাহিত্য ও শিল্পকর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ রচয়িতা যারা, সেই স্রষ্টাদের নাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের অজানা। ... কিন্তু যা ঘটেছে এবং ঘটছে তার বিবরণ যত্ন করে রাখব না। আর তা থেকে শিক্ষা নিতে থাকব না - একি উদ্ভট আচরণ? এরই কুফল যে আমরা সমাজ জীবনে ভুগে চলেছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। সমাজের গতি পরিণতি সম্বন্ধে আগ্রহ থাকলে এমন কাণ্ড ঘটত না - আমাদের ভারতবর্ষও হয়তো যুগ যুগ ধরে যে পরিমাণে ‘অচলায়তন’ হয়ে থেকেছে সেক্ষেত্রে তা হতো না।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৬)
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্ৰ মোদি। মুম্বাই-এ অনুষ্ঠিত সারা ভারত বিজ্ঞান সম্মেলনে হিন্দুদের দেবতা গণেশ এবং সেই সাথে রথের উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, এর থেকে প্রমাণিত হয় প্রাচীন ভারতীয়রা প্লাস্টিক সার্জারী জানতো এবং তারা উড়োজাহাজে চড়তো! তারা হাতির মাথা কেটে মানুষের মাথায় জোড়া দিয়েছিল (গনেশ) এবং রথই ছিল উড়োজাহাজের প্রাচীন ভারতীয় সংস্করণ!! একবিংশ শতাব্দীতে অচলায়তনে বসবাসকারী ছাড়া এ ধরনের উদ্ভট কথা আর কে বলতে পারে? এবং যিনি একথা বলেছিলেন তিনি হলেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, ভারতের রাজনীতিতে এখন যার জয়জয়কার!!!
হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন রামচন্দ্র ও শ্ৰীকৃষ্ণের জন্মদিন বিষয়ে হিন্দুদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কথা। ‘রামনবমী’ ও ‘জন্মাষ্টমী’ পালনকালে তাদের জানারই দরকার হয় না কোন যুগে কোন বৎসরে কোন দিনে সেই ঘটনা ঘটেছিল। রামচন্দ্র ও শ্ৰীকৃষ্ণের জন্মদিন না জানার একটা কারণ হতে পারে তাঁরা রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্যের নায়ক হলেও তাঁদের কোন প্রকৃত অস্তিত্ব ছিল না, যা এখন অনেক হিন্দু পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদও মনে করেন। এদিক দিয়েই বিবেকানন্দ উচ্ছাসের সাথে যে গ্ৰীক সভ্যতার কথা ওপরের উদ্ধৃতিতে বলেছেন সেই গ্ৰীকদের সাথে ভারতীয়দের পার্থক্য। গ্ৰীকরা তাদের মাইথলজি ও মহাকাব্যের নায়ক নায়িকাদেরকে বাস্তব মনে করেন নি, তাদের কোন পূজাও তাঁরা করতেন না। এবং এখনো করেন না। এর একটা বড় কারণ ছিল গ্রীকদের ইতিহাস সচেতনতা যার উল্লেখ হীরেন মুখোপাধ্যায় করেছেন। ভারতীয়দের কোন ইতিহাস না থাকায় মাইথলজিকেই তারা ইতিহাস জ্ঞান করেছে।
কিন্তু ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং উদাসীনতার অন্য দৃষ্টান্তও অনেক, যার ফলে এখনো পর্যন্ত এই অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কারণে ধর্ম ও রাজনীতি ক্ষেত্রে ভারতে ‘অচলায়তনের’ অভাব নেই। গরু নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে ভারতে ধর্ম রক্ষার নামে যা করা হচ্ছে এটা হলো তার এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে, এমনকি ধৰ্মগ্রন্থেও আর্য ঋষিদের গো মাংস ভক্ষণের উল্লেখ আছে। গরুর বাছুরের মাংস তাদের খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু ঋষিরা পর্যন্ত প্রাচীন কালে গো মাংস ভক্ষণ করলেও পরবর্তীকালে হিন্দুদের জন্য গো মাংস কেন নিষিদ্ধ হলো এ নিয়ে কোন জিজ্ঞাসা, হিন্দু ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিবিদ বা ইতিহাসবিদদের কোন কথা শোনা যায় না। এ বিষয়ে তাদের কোন কৌতুহল নেই! যারা গো রক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মুসলমান, খ্রীস্টান, দলিতদের গো মাংস খাওয়ার অধিকারের কথা বলেন তাদের মধ্যেও নেই!! এ নিয়ে আমিও কোন গবেষণা করতে যাই নি। কিন্তু আমার একটা ধারণা যে হাজার হাজার বছর আগে ভারতে এক সময় খুব ব্যাপকভাবে গরুর মড়ক দেখা দিয়েছিল যাতে লাখ লাখ গরুর মৃত্যু হয়েছিল। চাষের জন্য গরুর নিদারুণ অভাব দেখা দিয়েছিল। কাজেই গরুর মাংসের জন্য গো হত্যা বন্ধ করতে হয়েছিল এবং সেটা কার্যকরভাবে বন্ধ করার জন্য গো হত্যা নিবারণের জন্য ধর্মের আশ্রয় নিয়ে হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোন ধার্মিক লোক ছিলেন না। কিন্তু বিধবা বিবাহ প্ৰচলনের সময় তিনি কিন্তু ধর্মগ্রন্থ মন্থন করে। তার পক্ষে প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টার সময় তাঁকে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, নিজে ধর্ম না মানলেও কেন তিনি বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত এটা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, এদেশে কোন কিছুর প্রচলন বা প্ৰচলন বন্ধ করার জন্য ধর্মের দোহাই ছাড়া উপায় নেই। বিদ্যাসাগরের যুগে হঠাৎ করে এই অবস্থা তৈরী হয় নি। প্রাচীন কাল থেকে হিন্দু সমাজের অবস্থা এরকমই ছিল। কাজেই গো মাংস খাওয়া নিষিদ্ধকরণের জন্যও ধর্মের দোহাই এর প্রয়োজন ছিল। আমার এটা মনে হয়েছে, তবে এর কোন প্রমাণ আমার কাছে নেই। কিন্তু হিন্দু সমাজে যে এ বিষয়ে কোন কৌতুহল বা জিজ্ঞাসা নেই, ইতিহাসবিদদের কোন গবেষণা নেই, এটা দেখাই যায়। এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে হিন্দুদের এই অবস্থা, ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞতা অনেক অনার্থের কারণ হয়েছে।
ভারতের পশ্চিমে হরিয়ানা এবং রাজপুতানায় এখন ব্যাপকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ চলছে। অনেক নরকঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে। তাদের হাড়ে জিঙ্ক (Zinc) বা দস্তার পরিমাণ খুব বেশী থাকায় প্রমাণিত হয় যে, খৃস্টপূর্ব দেড় দুই হাজার বছর আগে ঐ অঞ্চলের মানুষ মাংস ভক্ষণ করতো। সে মাংস কোন পাখীর নয়, ছাগল ভেড়ারও নয়। তারা ছিল কৃষিজীবী। চাষাবাদের জন্য তারা যে গরু পালন করতো। সেই গরুর মাংসই তারা খেতো। কিন্তু তাদের গো মাংস ভক্ষণ কখন থেকে বন্ধ হলো এ নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের কোন প্রশ্ন বা ইতিহাসবিদদের অনুসন্ধানের কোন ব্যাপার নেই।
প্ৰাচীন ভারতের ইতিহাসে জাতিভেদ প্ৰথা বা বৰ্ণাশ্রমের উদ্ভব এদিক দিয়ে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। গীতায় চতুৰ্বর্ণের কথা বলা আছে। গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে এই বিভাগ করা হয়েছে ও তাকে পরিণত করা হয়েছে ধর্মশাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশে । মনুসংহিতাতে একে শাস্ত্রীয় আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া রামায়ন মহাভারতের কাহিনীতে এই জাতি বিভক্তির দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে প্রাচীন ভারতে কিভাবে এই প্রথার উদ্ভব হলো সে বিষয়ে কোন অনুসন্ধান ইতিহাসবিদদের নেই। আর্যদের আসার আগে এর অস্তিত্বের বিষয়ে কিছু জানা যায় না। এ কীর্তি আর্যদেরই। তারা এসেছিল ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া থেকে, যেখানে কোন জাতিভেদ প্ৰথা নেই। কাজেই তারা আসার সময় বর্ণপ্ৰথা সাথে করে আনে নি। ভারতে আসার পরই তারা এ প্রথার প্রবর্তন করেছিল। কিন্তু বিশ্বের কোথাও যেখানে এ ধরনের জাতিভেদ প্ৰথা নেই, সেখানে ভারতে কি অবস্থায় ও কি কারণে এর উদ্ভব হলো সে বিষয়ে কোন ঐতিহাসিক অনুসন্ধান কোথাও নেই, তথ্যভিত্তিক ব্যাখ্যা তো দূরের কথা।
হিন্দু মৌলবাদ বলে কিছু নেই। হিন্দুত্ব বলতে সুনির্দিষ্ট আদর্শগত কিছু নেই। এর জন্য প্রয়োজন হয় এমন গ্ৰন্থ যাতে আদর্শ ও ধর্মীয় নিয়ম কানুন সুনির্দিষ্টভাবে
বিবৃত ও লিপিবদ্ধ থাকে এবং যার প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য বাধ্যতামূলক। এ অর্থে বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রীস্টান, ইসলাম, শিখ ধর্মীয় মৌলবাদের কথা বলা যায়, কারণ
হলো এই গ্রন্থগুলিতে বিবৃত আদর্শ, অনুশাসন ও নিয়ম কানুনের কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকা । তাই textual reference ছাড়া মৌলবাদ বলে কিছু হতে পারে না। এই অর্থে হিন্দু ধর্মের কোন গ্ৰন্থ নেই। বেদ, উপনিষদ, পুরান, মনুসংহিতা, রামায়ন, মহাভারত ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের অভাব হিন্দু ধর্মে নেই। কিন্তু হিন্দু হওয়ার জন্য এ গ্রন্থগুলির কোনটির প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখা ও তা মান্য করার প্রয়ােজন নেই। কোন লোক বেদ, উপনিষদ, মনু ইত্যাদির প্রকাশ্য সমালোচনা করা ও তাকে অস্বীকারের পরও হিন্দু থাকতে পারে। নাস্তিকও হিন্দু থাকতে পারে, যেমন ছিলেন চর্বাক। আবার হিন্দু হতে পারে একশো দেব দেবতার পূজারী। এদিক দিয়ে হিন্দু ধর্মের আদৰ্শিক বন্ধন খুব শিথিল। তার নিয়ম কানুনের সুনির্দিষ্ট কাঠামো বলেও কিছু নেই। এজন্য এখনো দেখা যাবে যে, আরএসএস-বিজেপি মার্কা হিন্দু নেতারা হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চীৎকার করে গলা ফাটালেও, হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কোন নীতি আদর্শের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে দাঁড়াতে হবে তার কোন বয়ান তাঁদের নেই।
হিন্দু ধর্মে এ কারণেই ধর্মনাশ হওয়া বলতে ঠিক কি বোঝায়, বা হিন্দুত্বের অবমাননা কোন আদর্শিক বিচূতির কারণে হয়, এ বিষয়ে কিছু নেই। ধর্মনাশ হওয়া থেকে জাত যাওয়ার গুরুত্ব হিন্দু ধর্মে অনেক বেশী। শুধু তাই নয়, সর্বনাশ হওয়ার প্রকৃত অৰ্থও হলো জাত যাওয়া। এ কারণে এক ব্যক্তি বেদ বেদান্ত, উপনিষদ ইত্যাদি অস্বীকার করেও হিন্দু থাকতে পারে; কিন্তু নিম্নবর্ণের কোন হিন্দুর সাথে কোন উচ্চ বর্ণের হিন্দু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে, এমনকি একত্রে আহার করলেও তার জাত যায়, যা ধর্মচ্যুতির মতই ব্যাপার। এর কারণ হিন্দু মৌলবাদ বলতে যা বোঝায় তার সাথে হিন্দু ধর্মের কোন নীতি আদর্শের প্রতি আনুগত্যের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় বর্ণাশ্রম প্রথা কঠোরভাবে মান্য করা। জাতিভেদ প্রথা থেকে কোনভাবে বিচ্যুত না হওয়া। বর্ণপ্ৰথা হচ্ছে হিন্দু ধর্মের প্রাণ। এ কারণে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, নানা হিন্দু মতবাদের সমালোচনা তারা সহ্য করে। তার মত উদারতা তাদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু বর্ণপ্রথার ওপর কোন আঘাত তারা সহ্য করে না ।
ভারতে দাসপ্রথা একেবারে অনুপস্থিত না থাকলেও অন্যান্য দেশের মত ভারতে কোন দাসপ্রথা ছিল না। বর্ণাশ্রমের কারণে গুণ কর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করার ফলে শুদ্রদের সামাজিক অবস্থান কঠোরভাবে নির্দেশ করে উচ্চবর্ণের লোকরা তাদের বাস্তবতঃ দাস এর মতই ব্যবহার করতো । তাই ভারতে শুদ্ৰ বা নিম্নবর্ণের হিন্দুরাই ছিল উচ্চবর্ণের দাস। এখনো ভারতে কোটি কোটি নিম্নবর্ণের ও দলিতদের অবস্থা দাসের মতই। এই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ পাঠের কোন অধিকার থাকে নি। কেউ সে কাজ করলে তার ‘অধিকার দোষ’ ঘটতো। বর্ণ হিন্দুদের, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দেব্দেবীর পূজাও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল । দেব দেবতাদের মন্দিরে প্রবেশের কোন অধিকার তাদের ছিল না। এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই।
এর থেকে বােঝার অসুবিধে নেই যে, হিন্দুত্বের কোন মূল আদর্শিক বন্ধন নেই। সামাজিক বন্ধনের মধ্যেই হিন্দুত্বের বা হিন্দু ধর্মের পরিচয়। হিন্দু মৌলবাদ বলে যদি কিছু থাকে তাহলে সেটা হলো, কোন আদর্শের প্রতি আনুগত্য নয়, চতুৰ্বর্ণের সামাজিক বন্ধনের প্রতি আনুগত্য। এই বন্ধন থেকে বিচ্যুত হওয়া বা তা ছিন্ন করাই হিন্দু ধর্মের সব থেকে বড় অপরাধ। এই বিচূতির কোন মাফ নেই। এই জাতিভেদ প্রথার মধ্যে হিন্দু ধর্মের মূল এমন গভীরভাবে প্রোথিত যে, ঠিক এই মুহূর্ত পর্যন্ত জাতিভেদ বা বর্ণপ্ৰথা ভারতে শক্তিশালীভাবে বিদ্যমান। জাতিভেদ প্রথা উচ্ছেদের জন্য দাঁড়ানাে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখনাে হিন্দুত্বের দৃষ্টিতে সব থেকে বড় ধর্মীয় অপরাধ। হিন্দুতৃের নামে এই জাতিভেদ প্ৰথাই হিন্দু ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের ভিত্তি। এদিক দিয়েই খ্ৰীস্টধর্ম, ইসলাম ইত্যাদির সাথে হিন্দু ধর্মের পার্থক্য। ধর্মীয় গ্রন্থের অবমাননার বিরুদ্ধে এই সব ধর্মে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা আছে। এমনকি তার মধ্যেই ফ্যাসিবাদের বীজও নিহিত আছে। কিন্তু সামাজিক কাঠামোর কোন কঠোর বন্ধনে তারা আবদ্ধ নয়।
স্বামী বিবেকানন্দ মুসলমান এবং ইসলামের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছিলেন, যার উল্লেখ আগে করা হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশংসাসূচক কথাবার্তাও তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। যেমন তিনি বলছেন, “যখনই একজন মুসলমান ধর্ম গ্ৰহণ করিল, তখনই সমগ্র ইসলামী সমাজ তাহাকে জাতিধর্ম নির্বিশেষে ভ্ৰাতা বলিয়া বক্ষে ধারণা করিল। এরূপ আর কোন ধর্মে করে না।” (উদ্ধৃত: সৈয়দ আবদুল হালিম, বাঙ্গালীর মুসলিম উত্তরাধিকার) কিন্তু শুধু ইসলামী সমাজ নয়, খৃস্টান এমনকি শিখ সমাজেও ধর্মান্তরিতদেরকে একইভাবে আলিঙ্গন করে ।
হিন্দু ধর্মে এটা হওয়ার উপায় নেই। আসলে হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী অন্য ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে আসার কোন ব্যবস্থা নেই। এর কারণ হিন্দু ধর্ম বলতে কার্যতঃ বোঝায় বর্ণাশ্রম প্রথা। অন্য ধর্ম থেকে কেউ হিন্দু ধর্মান্তরিত হলে সমস্যা দাঁড়ায় বর্ণপ্ৰথা অনুযায়ী তার কি অবস্থান হবে। হিন্দু হয়ে সে কি ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয় বা বৈশ্য হবে? তার কোন সম্ভাবনা নেই। এ কারণে হিন্দু ধর্মে আসার অর্থই হলো, নিম্নবর্ণে তার অবস্থান। বর্তমান ভারতে আরএসএস এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জোর করে তারা হিন্দু ধর্মািন্তকরণ শুরু করেছিল। এই ধর্মািন্তকরণের ফলে মুসলমান, খ্রীস্টান ধর্মান্তরিতরা সামাজিক স্বাধীনতা খুইয়ে বন্দী হয়েছে নিম্নবর্ণের খাচায়। এই ধর্মান্তরিতদেরকে ভাই বলে বুকে টেনে নেওয়ার কোন প্রশ্ন হিন্দু ধর্মে নেই।
মুসলমান বা খ্ৰীস্টানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদীদের যে ঘূণা এবং আক্রমণাত্মক অবস্থান এটা আধুনিক ব্যাপার। এই ঘূণা এবং আক্রমণাত্মক অবস্থান হিন্দু ধর্মে নিম্নবর্ণের বিরুদ্ধে হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে এবং এখনো ভারতে খুব শক্তিশালীভাবে আছে, হিন্দুদের একটা অংশের মধ্যে এর বিরোধিতা সত্ত্বেও । রাজনৈতিকভাবে ভারতে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্ৰ মোদির উত্থান মুসলমান বা খ্রীস্টানদের জন্য যত বিপজ্জনক হয়েছে তার থেকে বেশী বিপজ্জনক হয়েছে নিম্নবর্ণের হিন্দু বা দলিতদের জন্য। কারণ মুসলমান ও খ্রীস্টানদের মত দলিতরাও প্রকৃতপক্ষে হিন্দু নয়। কিন্তু ধর্মের কাঠামোর মধ্যে নানা কৌশলে তাদেরকে আটকে রাখলেও, ভোটের প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যবহার করলেও, উচ্চবর্ণেরদেব দেবতারা তাদের দেব দেবতা নয়, হিন্দু মন্দিরে প্রবেশের অধিকার তাদের নেই, উচ্চব্ররণের হিন্দুর কাছে তারা অস্পৃশ্য। শুধু তাই নয়, সামাজিক দিক দিয়ে মুসলমান ও খ্ৰীস্টানদের সাথেও বর্ণহিন্দুদের যে ওঠা বসা হয়ে থাকে দলিতদের সাথে তারা সেটা করে না। ডক্টর আম্বেদকারের মত একজন প্রতিভাশালী, পণ্ডিত ও বড় মাপের মানুষের সাথে বর্ণ হিন্দুরা এমনকি কংগ্রেস নেতারাও যে আচরণ করেছিলেন তা সুবিদিত।
ভারতে বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী এখন হিন্দুত্বের পতাকা উড়িয়ে মুসলমান ও খ্ৰীস্টান, প্রধানতঃ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে অবস্থান গ্রহণ করেছেন এটা এক ধরনের রাজনৈতিক উল্লম্ফন বটে। কিন্তু এটা হঠাৎ করে বা রাতারাতি হয়। নি। এ অবস্থা ভারতের রাজনীতির ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কংগ্রেস ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলে প্রচার করলেও এবং ব্যাপকভাবে মানুষ তার দ্বারা প্ৰতারিত হলেও কংগ্রেস তিরিশ চল্লিশ দশকে পরিণত হয়েছিল একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক দলে। এ কারণেই তিরিশ দশকের শেষ দিকেই মৌলানা আজাদ, রফি আহমদ কিদওয়াই, আসিফ আলীর মত সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া জাতীয়তাবাদী মুসলমান নামে পরিচিত কংগ্রেসী মুসলমানরা কংগ্রেস ছেড়ে দিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে বিড়লার মত কিছু বড় পুঁজির প্রাধান্য স্থাপিত হওয়ার কারণে এমন অবস্থা তৈরী হয়েছিল যাতে কমিউনিস্ট পাটি, এম এন রায়, এমনকি সুভাষ বসু পর্যন্ত বাধ্য হয়েই কংগ্রেস থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা কংগ্রেসী শাসনে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছেন। কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে। কাজেই হিন্দুত্বের নামে নরেন্দ্র মোদির দল এখন যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ভারতে ছড়াচ্ছে ও এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা উঠাচ্ছে, একাজ তাদের পূর্ববর্তী শাসক দল কংগ্রেসও করেছিল। তফাৎ শুধু এই যে, কংগ্রেস একাজ করার সময় অসাম্প্রদায়িকতার নেংটি পরে ছিল, বিজেপি সে নেংটি ফেলে দিয়ে হিন্দুত্বের নামে সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার ফেরিওয়ালা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িকতার কারণে কংগ্রেস। শুধু মুসলমান স্বার্থের বিরোধীই ছিল না। তারা আরও কঠোরভাবে ছিল নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু বা দলিতদের বিরুদ্ধে, কারণ কংগ্রেস নেতৃত্ব ছিল পুরোপুরিভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দু নিয়ন্ত্রিত। ভারতের অবস্থার দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়। এখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেও ছিল বর্ণ হিন্দুরা এবং এখনো তাই আছে। এটা কোন সচেতন সাম্প্রদায়িক কারণে হয় নি। হিন্দু সমাজ কাঠামো এমনভাবে গঠিত যাতে এই কাঠামোই হলো বর্ণ হিন্দুর রক্ষক এবং নিম্নবর্ণ হিন্দুর শত্রু।
বিস্ময়ের আরও বিষয় এই যে, কংগ্রেস তো নয়ই, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি পর্যন্ত জাতিভেদ ও জাতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন করে নি। এক্ষেত্রে তাদের কোন নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা ও কর্মসূচী ছিল না। কংগ্রেস নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরকে হিন্দু সমাজের কাঠামোর মধ্যে ধরে রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছিল তাদের জন্য কিছু না করেই। এদিক দিয়ে তাদের কৌশলের অভাব ছিল না। মুসলমানদের ভারত আগমণের পর থেকে যারা ইসলাম ধর্ম গ্ৰহণ করেছিল তারা ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া। এ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দের বক্তব্য হলো, “ভারতে দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা এত বেশী কেন? এ কথা বলা মূর্খতা যে, তরবারীর সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য করা হইয়াছিল।” (শিকাগো থেকে লিখিত পত্র, ১৮৯৪ । উদ্ধৃত: সৈয়দ আবদুল হালিম) এবং “মুসলমানদের ভারতাধিকার দরিদ্র পদদলিতদের উদ্ধারের কারণ হইয়াছিল। এ দারিদ্র্য ও অবহেলার জন্যই আমাদের এক পঞ্চমাংশ লোক মুসলমান হইয়া গিয়াছে। কেবল তরবারী ও অগ্নির বলে ইহা সাধিত হইয়াছিল, একথা মনে করা নিতান্ত পাগলামি।” (ভারতের ভবিষ্যৎ, উদ্ধৃতি: ঐ)
লক্ষ করার বিষয় যে, বিবেকানন্দ শুধু হিন্দুদের দারিদ্র্য এবং অবহেলিত অবস্থার কথা বললেও এবং কখনো কখনো জাত পাতের বিরুদ্ধ বললেও বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে তাঁর কোন ধর্মীয় সংগ্রাম ছিল না। তিনিও ছিলেন প্রকৃতপক্ষে বর্ণপ্রথার রক্ষক। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ভারতের যে অচলায়তনের কথা বলেছেন সেই অচলায়তনেরই পাহারাদার ।
এ কথা মনে হয় অতি নগণ্য সংখ্যকের মাথায় আছে যে, ভারতে ধমীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাধারণ আন্দোলন থেকে ফল লাভের বিশেষ সম্ভাবনা নেই। মুসলমান ও খ্রীস্টানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা বন্ধের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে ভারতে বর্ণপ্ৰথা ভেঙে দেওয়া। কারণ হিন্দুদের এই বর্ণপ্রথার কারণে তাদের নিজেদের ধর্মের নিম্নবর্ণের বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ঘৃণা আছে, শোষণ নির্যাতন আছে তার সাথে মুসলমান খ্ৰীস্টানদের প্রতি ঘৃণা ও তাদের বিরুদ্ধতা একই সূত্রে প্রোথিত। ভারতে নিম্নবর্ণের হিন্দুর সাথে মুসলমান খ্ৰীস্টানদের কোন দ্বন্দ্ব বিরোধ নেই। এ দ্বন্দ্ব বিরোধ উচ্চ বর্ণের হিন্দুর সাথে। এটাই ঐতিহাসিক সত্য এবং বর্তমান বাস্তবতা। ভাবতে অবাক লাগে যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একদিকে ঠিক একইভাবে তারা মুসলমানদের অবস্থার ওপর রচিত ‘সাচার কমিটিও’ প্রত্যাখ্যান করেছে! মণ্ডল কমিশন প্রত্যাখ্যান করে জ্যোতি বসু ও তাদের সিপিএম সরকার বলেছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গে কোন বর্ণবৈষম্য নেই! তাদের আমলেও পশ্চিমবঙ্গে ৩০ শতাংশের বেশী মুসলমান হলেও সরকারী চাকরী ২ শতাংশেরও কম ছিল। এখনো সেই অবস্থাই চলছে। এদিক দিয়ে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পাটি, তৃণমূল কোন পার্থক্য নেই!!
ভারতে নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই ভাল থেকেছে। এমনকি সুলতানী আমল থেকে মোগল আমল পর্যন্ত উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু মুসলমানের মধ্যেও খারাপ সম্পর্কের থেকে সুসম্পর্কই বেশী ছিল। ইংরেজরা নিজেদের সাম্রাজ্যিক স্বার্থে এই সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছিল। এই ফাটল ইংরেজ আমলে উনিশ শতকের বাঙলায় বড় হতে শুরু করে। উনিশ শতক ছিল হিন্দু জাগরণের কাল। সেই ‘জাগরণের’ মধ্যেই হিন্দুত্বের যে বীজ নিহিত ছিল তাই এখন শাখা প্ৰশাখা ও পত্রপল্লবে বিকশিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। নরেন্দ্ৰ মোদির আরএসএস মার্কা হিন্দুত্বে। এই ধারাবাহিকতার বিবরণ ও বিশ্লেষণ যেভাবে হওয়া দরকার ছিল তা হয় নি। ইংরেজ স্বার্থের সাথে জড়িত সুবিধাবাদী ইতিহাসবিদদের দ্বারা ইতিহাসের বিকৃতকরণের কারণেই তার প্রয়ােজন বােধ পর্যন্ত দেখা যায় নি। একথা বলাই বাহুল্য যে, উনিশ শতকে হিন্দু জাগরণের নামে যা হয়েছিল সেটা ছিল। উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের জাগরণ, তার সাথে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের কোন সম্পর্ক ছিল না। কোন সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সাথে নিম্ন বর্ণের হিন্দুর স্বাৰ্থ সম্পর্কিত ছিল না। কাজেই সেই ‘জাগরণের’ মধ্যে যেমন মুসলমান বিরোধিতা ছিল, তেমনি ছিল নিম্ন বর্ণের হিন্দুর স্বার্থের প্রতি চরম ঔদাসীন্য।
নিম্ন বর্ণের হিন্দু বা দলিতদেরকে নিজেদের ভোট ব্যাংকে আটক করার জন্য যত রকম ভণ্ডামী ও ধাপ্পাবাজি করা দরকার নরেন্দ্ৰ মোদি তা করছেন। এদিক দিয়ে গান্ধীর থেকে তিনি অনেক শিক্ষা নিয়েছেন। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা উচ্চ বর্ণের নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে ইসলাম, বৌদ্ধ বা খ্ৰীস্ট ধর্মান্তরিত হওয়ার দিকে যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন। তখন গান্ধী তাদের ‘হরিজন” বা ‘ঈশ্বরের মানুষ’ আখ্যা দিয়ে, হরিজন নামে পত্রিকা বের করে তাতে অবিরাম ধর্ম সম্পর্কিত কথা লিখে, তাদেরকে কিভাবে প্রতারিত করেছিলেন সে ইতিহাস ভালভাবেই জানা। তিনি ছিলেন আম্বেদকারের ঘোর বিরোধী, তাঁকে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন হিন্দু ধর্মের সব থেকে বড় শক্ৰ হিসেবে। এর কারণ আম্বেদকার উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে নিম্ন বর্ণের লক্ষ নিম্ন বর্ণের হিন্দুকে নিয়ে নিজে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
নরেন্দ্ৰ মোদির ওপরওয়ালা দল আরএসএস তখন ছিল আম্বেদকারের ঘোরতর শত্রু। কিন্তু নরেন্দ্ৰ মোদি দলিতদেরকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে এখন হয়েছেন আম্বেদকারের মহাভক্ত! তাঁর জন্ম মৃত্যু দিবস তিনি মহা আড়ম্বরে পালন করে তাঁর প্রস্তর মূর্তিতে মালা পরিয়ে অনেক ভন্ডামী করছেন দলিতদের ভোট ব্যাংকে ধরে রাখার জন্য। এজন্য তিনি মুসলমানদের বিরোধিতাকেও কাজে লাগাচ্ছেন। এক্ষেত্রে তিনি যে বড় রকম সাফল্য অর্জন করেছেন। এর বড় প্রমাণ সদ্য অনুষ্ঠিত উত্তর প্রদেশের নির্বাচন। সেখানে ২০ শতাংশ লোক মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও, তিনি একজন মুসলমানকেও মনোনয়ন দেন নি, যদিও অল্প কিছু দালাল মুসলমান নেতা বিজেপিতে যোগদান করে ব্যক্তিগত ফায়দা ওঠাচ্ছে। ২০১৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনেও উত্তর প্রদেশে বিজেপি একই কাজ করেছিল।
নরেন্দ্ৰ মোদির কৌশল এক্ষেত্রে হলো, দলিতদেরকে মুসলমানদের থেকে শুধু সরিয়ে রাখা নয়। তাদের মধ্যে শক্ৰতা তৈরীর চেষ্টাও তিনি করছেন । এই দলিতরা যতদিন পর্যন্ত তাদের জাত শক্র নরেন্দ্ৰ মোদি এবং তাঁর দল বিজেপির পক্ষে থাকবে। ততদিন বিজেপির শক্তি খর্ব হবে না। এজন্য নরেন্দ্ৰ মোদিকে ও তাঁর হিন্দুত্বের রাজনীতিকে পরাজিত করার জন্য অপরিহার্য প্রয়োজন দলিতদের থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা। দলিতদের মধ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটানো। নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি যে তাদের জাত শত্রু এটা তাদেরকে নোতুন করে শেখানো। এর জন্য বর্ণপ্রথা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে ধমীয় ও রাজনৈতিক লড়াই করা। কিন্তু এভাবে ভারতে কিছুই হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদি নিজেদের স্বার্থে সঠিক কৌশল অবলম্বন করে রাজনৈতি আন্দোলন করছেন, কিন্তু কমিউনিস্টসহ কোন গণতান্ত্রিক শক্তিই দলিতদের বিভ্রান্তি দূর করে, তাদেরকে বর্ণপ্রথার কাঠামো থেকে বের করে আনার জন্য কোন রাজনৈতিক আন্দোলন করছে না। এর ফলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনও নেই, যদিও নানা সাম্প্রদায়িক ঘটনার বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ আছে। যতদিন ভারতের জনগণ ও প্রগতিশীল মহল একথা না উপলব্ধি করছেন যে ভারতের বর্ণপ্ৰথা ভেঙে না ফেললে প্রকৃত কোন গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তো নয়ই, এমনকি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন পর্যন্ত সম্ভব নয়, ততদিন সম্ভব নয় ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিনাশ সাধন। কারণ নিম্ন বর্ণের দলিতদের ওপর বর্ণ হিন্দু পুঁজি মালিকদের শোষণ নির্যাতন ও মুসলমান খ্ৰীস্টানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর তাদের নির্যাতন ঐতিহাসিকভাবে একই সূত্রে গাথা।
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়ঃ সংস্কৃতি মার্চ - এপ্রিল ২০১৭ এর সংখ্যায়।
ছবিঃ দেশ পত্রিকা থেকে সংগ্রহিত।
Tags
ইসলামের ইতিহাস