মাওলানা নকীব আরসালান
লেখক, শিক্ষক ও কুরআন গবেষক
মুসলিম জাতি ধ্বংসের প্রধান কারণ হলো পরস্পর দলাদলি ও বিভক্তি। কিন্তু এই দলাদলি ও ফেরকার বিধান কি তা আমাদের অধিকাংশেরই অজানা। ফিরকার বিধান ভালোভাবে জানলে এত শত ফিরকার জন্ম হতে পারত না।
এই না জানার কারণ আমাদের দুর্বলতা নয় বরং মাদরাসার পাঠ্যভুক্ত ফেকাহ গ্রন্থগুলিতে এ জাতীয় অধ্যায়ের সঙ্কট। তাছাড়া কওমি মাদরাসা বোর্ড, আলিয়া মাদরাসা বোর্ড ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ইত্যাদিতে ফিরকা সংক্রান্ত কোন প্রশ্ন করা হয় না।
এখন প্রশ্ন হলো তাহলে কি কুরআনেও নেই এসব বিষয়? নাকি আছে আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি? বিষয়টা অনুসন্ধান ও গবেষণার কুরুক্ষেত্র।
কুরআনে অনুসন্ধান করলে আমরা দেখতে পাই- আল্লাহ তা’আলা বলেন- (মূল টেক্সট ব্যতিত কোনো বিষয় ঠিকমত হৃদয়ঙ্গম হয় না বিধায় বর্নিত আয়াতগুলি কোরান থেকে দেখে নেয়ার অনুরোধ থাকল)।
১. হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (আল-ইমরান/১০২)
তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলাদলি করে বিভক্ত হয়ো না৷ আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখো৷ তোমরা ছিলে পরস্পরের শক্র৷ তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন৷ ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানিতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো৷ তোমরা একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে৷ আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়ে নিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁর নির্দশনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলেন ৷ হয়তো এই নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের সোজা সরল পথ দেখতে পাবে। (আল-ইমরান/১০৩)
আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম। (আল-ইমরান/১০৪)
আর তাদের মতো হয়ো না যারা বিভক্ত হয়েছিল আর মতভেদ করেছিল তাদের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী আসার পরেও। আর এদেরই জন্য আছে কঠোর শাস্তি (৩: ১০৫)।
সেদিন কিছু লোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কিছু লোকের মুখ কালো হয়ে যাবে৷ তাদের বলা হবে, ঈমানের নিয়ামত লাভ করার পরও তোমরা কুফরি করেছিলে? ঠিক আছে, তাহলে এখন এ নিয়ামত অস্বীকৃতির বিনিময়ে আযাবের স্বাদ গ্রহণ করো৷ (৩/১০৬)
যোগসূত্র ও ব্যাখ্যা: সুরা আল-ইমরানের ১০২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাকে যথোপযুক্ত ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। ১০৩ নং আয়াতে ভয়ের প্রধান বিষয় হিসাবে বিভক্ত না হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
১০৪ নং আয়াতে বিভক্তির সম্ভাবনাকে চূড়ান্তভাবে অপনোদন করার লক্ষে উম্মতের দায়ী অংশের ওপর ফরয (কেফায়া) করে দিয়েছেন যে, তারা সৎকাজের আদেশ করবে আর অসৎ কাজে বাধা দিবে। অর্থাৎ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত রাখবে এবং বিভক্তিতে বাধা দেবে।
এত কিছুর পরেও যারা বিভক্তি ও ফিরকায় লিপ্ত থাকবে আল্লাহ তায়ালা তাদের ১০৫ নং আয়াতে ইহুদি-খৃস্টানের সাথে তুলনা করে কঠোর শাস্তির সংবাদ দিয়েছেন। এরপরেও যারা ফিরকাবাজি করবে আল্লাহ তা’লা তাদের ১০৬ নং আয়াতে কাফের বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, অত্র আয়াত দ্বারা কাফের মুশরিক ইহুদি নাসারা উদ্দেশ্য নয়, মুসলমান উদ্দেশ্য। কারণ আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে ‘আকাফারতুম বা’দা ইমানিকুম’ অর্থাৎ ঈমানের পর কুফরি করেছিলে?
বস্তুত ঐক্য ফরজ বিভক্তি হারাম। কাজেই যারা এই ফরজিয়্যত ও হুরমত অস্বীকার করে ফিরকায় লিপ্ত হবে তারা কাফের বলে গণ্য হবে যেমন নামাজ রোজার ফরজিয়্যত অস্বীকারকারী কাফের হয়ে যায়। তবে এই কুফুরি কুফরে জাহেদ নয়, এরা শাস্তির পর মুক্তি পাবে।
তাফসীর: (ক) ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘হুম আহলুল বিদআ’ অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের চেহারা স্বেতবর্ণ হবে আর বিদাতিদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ হবে।
(. وَالْأَحَادِيثُ فِي هَذَا الْمَعْنَى كَثِيرَةٌ. فَمَنْ بَدَّلَ أَوْ غَيَّرَ أَوِ ابْتَدَعَ فِي دِينِ الله مالا يَرْضَاهُ اللَّهُ وَلَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ فَهُوَ مِنَ الْمَطْرُودِينَ عَنِ الْحَوْضِ الْمُبْتَعِدِينَ مِنْهُ الْمُسَوَّدِي الْوُجُوهِ، وَأَشَدُّهُمْ طَرْدًا وَإِبْعَادًا مَنْ خَالَفَ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَفَارَقَ سَبِيلَهُمْ، كَالْخَوَارِجِ عَلَى اخْتِلَافِ فِرَقِهَا، وَالرَّوَافِضِ عَلَى تَبَايُنِ ضَلَالِهَا، وَالْمُعْتَزِلَةِ عَلَى أَصْنَافِ أَهْوَائِهَا، فَهَؤُلَاءِ كُلُّهُمْ مُبَدِّلُونَ وَمُبْتَدِعُونَ،
وَكَذَلِكَ الظَّلَمَةُ الْمُسْرِفُونَ فِي الْجَوْرِ وَالظُّلْمِ وَطَمْسِ الْحَقِّ وَقَتْلِ أَهْلِهِ وَإِذْلَالِهِمْ، وَالْمُعْلِنُونَ بِالْكَبَائِرِ الْمُسْتَخِفُّونَ بِالْمَعَاصِي، وَجَمَاعَةُ أَهْلِ الزَّيْغِ وَالْأَهْوَاءِ وَالْبِدَعِ، كُلٌّ يُخَافُ، عَلَيْهِمْ أن يكونوا عنوا بالآية، والحبر كَمَا بَيَّنَّا، وَلَا يُخَلَّدُ فِي النَّارِ إِلَّا كَافِرٌ جَاحِدٌ لَيْسَ فِي قَلْبِهِ مِثْقَالُ حَبَّةِ خَرْدَلٍ مِنْ إِيمَانٍ
খ. ইমাম কুরতুবি বিভিন্ন এখতেলাফসহ অত্র আয়াতের বিস্তারিত ব্যখ্যা করেছেন। তারপর হাউজে কাওসার সংক্রান্ত একাধিক হাদিস উল্লেখ পূর্বক বলেন, যে বা যারা দ্বীনের মধ্যে এমন পরিবর্তন পরিবর্ধন করবে অথবা বিদাত সৃষ্টি করবে যে বিষয়ে আল্লাহ সন্তুষ্ট নন এবং অনুমতি দেননি তারাই হাউজে কাউসার থেকে বিতারিত হবে, দূরে নিক্ষিপ্ত হবে এবং তাদের চেহারা কালো হয়ে যাবে।
বিশেষত যারাই মুসলিম জামাত (ঐক্য) এর খেলাফ করবে এবং তাদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে তারাই চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে এবং দূরে নিক্ষিপ্ত হবে। যেমন খারেজিরা এখতেলাফ করে পৃথক ফিরকা হয়ে গেছে, রাফেজিরা স্পষ্ট গুমরাহিতে লিপ্ত রয়েছে, মু’তাজিলারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। এরা প্রত্যেকেই দ্বীন পরিবর্তনকারী এবং বিদাত সৃষ্টিকারী।
দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক বক্রতা সন্ধানকারী দল, প্রবৃত্তির অনুসারী দল ও বিদাত সৃষ্টিকারীদের ওপরই এ আয়াত প্রযোজ্য হতে পারে। তবে এরা স্থায়ী জাহান্নামী হবে না, স্থায়ী জাহান্নামী হবে কাফেরে জাহেদ- যার অন্তরে সরিষা দানা পরিমাণ ঈমানও নাই।
(বর্তমানের প্রত্যেক ইসলামি দল ও ফিরকাকে ভাবতে হবে, আমরা এ আয়াতের হুকুমের আওতায় পড়ে যাই কিনা)।
২. এ ছাড়াও তাঁর নির্দেশ হচ্ছে এই: এটিই আমার সোজা পথ৷ তোমরা এ পথ অবলম্বন কর, ভিন্ন ভিন্ন মত-পথ অবলম্বন করো না তাহলে তোমরা বিভক্ত হয়ে যাবে। এ হেদায়াত তোমাদের রব তোমাদের দিয়েছেন, সম্ভবত তোমরা বাঁকা পথ অবলম্বন করা থেকে বাঁচতে পারবে৷ (আনআম/১৫৩)
৩. এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদে সন্তুষ্ট। (রুম/৩২)
৪. তিনি তোমাদের জন্য সেই ধর্ম থেকে বিধান দিচ্ছেন যার দ্বারা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আর যা আমরা তোমার কাছে প্রত্যাদেশ করছি, আর যার দ্বারা আমরা ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম এই বলে- ‘দ্বীন কায়েম করো, আর এতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। মুশরিকদের জন্য এ বড় কঠিন ব্যাপার যার প্রতি তুমি তাদের আহ্বান করছ! আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তাঁর কারণে নির্বাচিত করেন, আর তাঁর দিকে পরিচালিত করেন তাকে যে ফেরে। (৪২: ১৩)
বিধান: আয়াতে ‘কায়েম কর’ অনুজ্ঞা, আর ‘বিভক্ত হয়ো না’ নিষেধাজ্ঞা। আর কুরানের অনুজ্ঞা দ্বারা ফরজ, নিষেধাজ্ঞা দ্বারা হারাম সাব্যস্ত হয়- এই সূত্রানুসারে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ফরজ, আর বিভক্ত হওয়া- বিচ্ছিন্ন হওয়া হারাম।
৫. মানুষের কাছে যখন জ্ঞান এসে গিয়েছিল তারপরই তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিয়েছে৷ আর তার কারণ পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ। একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মূলতবি রাখা হবে একথা যদি তোমর রব পূর্বেই ঘোষণা না করতেন তাহলে তাদের বিবাদের চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়া হতো৷
প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, পূর্ববর্তীদের পরে যাদের কিতাবের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে তারা সে ব্যাপারে বড় অস্বস্তিকর সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে৷ (শুরা/ ১৪)
৬. তারা আল্লাহ্কে ছেড়ে দিয়ে তাদের আহবার ও রুহবানদের (আলেম ও পুরোহিতদের) প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে, আর মরিয়ম-পুত্র মসীহ্কেও। অথচ শুধু এক উপাস্যের উপাসনা করা ছাড়া অন্য নির্দেশ তাদের দেয়া হয়নি। তিনি ছাড়া অন্য উপাস্য নেই। তাঁরই সব মহিমা- তারা যেসব অংশী দাঁড় করায় সে-সব থেকে তিনি মুক্ত? (তওবা: ৩১)
তাফসিরকারকদের মতামত: এখানে ইহুদি নাসারারা তাদের পুরোহিত রাব্বাইদের রব হিসাবে গ্রহণ করার অর্থ এ নয় যে তারা ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে নামাজ রোজা উপাসনা করত, পূজা করত বরং এর অর্থ হল আল্লাহ যা হালাল করেছেন পুরোহিতরা তা হারাম করত আর অনুসারীরাও তা মেনে নিত।
আর আল্লাহ যা হারাম করেছেন ধর্মগুরুরা তা হালাল করত আর তারাও তা মেনে নিত। এ সম্পর্কে একাধিক সনদে বর্ণিত হাদিস–
ক. আদি বিন হাতেম রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসুল সা. এর কাছে গেলাম, তখন আমার গলায় স্বর্ণ নির্মিত একটি ক্রুশ ঝুলানো ছিল। তিনি বললেন, ‘হে আদি তোমার গলা থেকে এ মূর্তি দূরে নিক্ষেপ কর। আমি তা নিক্ষেপ করলাম। আমি পৌঁছার সময় তিনি উক্ত আয়াতটি পাঠ করছিলেন।
তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আমরা তো আমাদের আলেমদের ইবাদত করি না, অন্য
বর্ণনায় এসেছে, আমরা তো তাদের উদ্দ্যেশ্যে নামাজ পড়ি না। তখন রাসূল সা. বললেন ‘ঠিকই বলেছ। কিন্তু আল্লাহ যা হালাল করেছেন তারা যখন তা হারাম করে তখন কি তোমরা তা মেনে নাও না, আবার আল্লাহ যা হারাম করেছেন তারা যখন তা হালাল করে তখন কি তোমরা তা হালাল হিসাবে মেনে নাও না? তখন আমি বললাম ‘জী হাঁ। রাসূল সা. বললেন ‘তাদের ইবাদতের অর্থ এটাই।
খ. হযরত হুযায়ফা রা. কে জিজ্ঞেস করা হল যে, ইহুদি খৃষ্টানরা কি তাদের আলেমদের ইবাদত করত? উত্তরে তিনি বললেন, না বরং তাদের আলেমরা যা হারাম করত তারাও তা হারাম হিসেবে মেনে নিত আর যা হালাল করত তারাও তা মেনে নিত।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর অবাধ্যতায় তারা আলেমদের আনুগত্য করত।
গ. ইবনে আব্বাস রা. বলেন, তাদের আলেমরা নিজেদের সিজদা করার হুকুম করত না বরং তারা আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ দিত আর অনুসারীরাও তা মেনে নিত এবং আলেমদের আনুগত্যে আত্মপ্রসাদ লাভ করত।
বাস্তব শিক্ষা: আল্লাহ তা’লা ঐক্য ফরজ ও বিভক্তি হারাম করেছেন। এখন চিন্তার বিষয় হল, আমাদের মুরুব্বি ও আলেমরা তো এসব নিয়ে কথা বলছেন না, তাহলে কি তারা এসব বিভক্তিকে ইতিবাচক বা জায়েজ হিসেবে নিচ্ছেন? আর আমরাও তা মেনে নিয়েছি?
৭. প্রথমে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে তো বিভেদ সৃষ্টি হলো তাদের কাছে (সত্য পথের ) সুস্পষ্ট প্রমাণ এসে যাওয়ার পর। (বায়্যিনা/ ৪)
৮. বলুন, হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আস-যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান-যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না, তাঁর সাথে কোন শরীক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে বলে দাও যে, সাক্ষী থাক আমরা তো অনুগত। (আলে ইমরান:৬৪)
তাফসীর: ঈমাম কুরতুবি ‘আমরা আল্লাহকে ছাড়া একে অন্যকে রব হিসাবে গ্রহণ করব না’ এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আমরা কোন জিনিস হালাল ও হারাম করণের ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ্র বিধান ছাড়া অন্য কাউকে অনুসরণ করব না।
অর্থাৎ ইহুদি নাসারারা যেমন তাদের ধর্মগুরুদের হালাল ও হারামকৃত বিষয়গুলি মেনে নিয়ে তাদের ধর্মগুরুদের রবের স্থলে অধিষ্ঠিত করেছিল- আমরা তেমনটা করব না।
অর্থাৎ আমাদের আলেমরা আল্লাহ প্রদত্ত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করলে আমরা তা মেনে নেব না, যেমন মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি ফিরকাবাজি ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
ইমাম তাবারির মতে- এর অর্থ হল আল্লাহ্র অবাধ্যতার বিষয়ে কেউ হুকুম করলে আমরা তার আনুগত্য করি না, আল্লাহকে যেভাবে সিজদা করা হয়, সেভাবে আমরা কাউকে (মাযারে) সিজদা করি না।
ইবনে জুরাইজ বলেন, আল্লাহ্র অবাধ্যতায় আমরা একে অন্যের আনুগত্য করি না। আর রব হিসাবে গ্রহণ করা অর্থ তাদের উদ্দেশ্যে নামায পড়া নয় বরং ইবাদতের বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতা ও সর্দারদের আনুগত্য করা।
৯. বলুন, আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিব জীবনে ব্যর্থ হয়েছে, অথচ তারা মনে করে যে, তারা উত্তম কর্মই সম্পাদন করেছে (কাহফ-১০৩ ও ১০৪)
তাফসির: ইমাম তাবারি বলেন, আমাদের কাছে সঠিক মনে হচ্ছে, অত্র আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য এমন প্রত্যেক আমলকারী যে স্বীয় আমলকে সঠিক মনে করে এবং স্বীয় আমল দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যকারী এবং আল্লাহকে সন্তুষ্টকারী মনে করে।
অথচ তার সেই কর্ম দ্বারা সে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে। (ফিরকাও এর অন্তর্ভুক্ত)
বাস্তব শিক্ষা: ইসলামের নামে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমরা মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি ও ফিরকা সৃষ্টি করছি। ফলে আমাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে, ইসলাম ও উম্মাহ ধ্বংস হচ্ছে আর আমরা আল্লাহর বিরাগভাজন হচ্ছি।
১০. আপনাদের এই উম্মত সব তো একই ধর্মের অনুসারী এবং আমি আপনাদের পালনকর্তা; অতএব আমাকে ভয় করুন। অতঃপর মানুষ কিতাবাদির (যুবুর) ভিত্তিতে তাদের বিষয়কে (ধর্ম) বহুধা বিভক্ত করে দিয়েছে, প্রত্যেক দল নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট। অতএব কিছু কালের জন্যে তাদের অজ্ঞানতায় নিমজ্জিত থাকতে দিন। (মুমিনুন- ৫২, ৫৩, ৫৪)
মুফাসসিরীনে কেরামের মতামত
ক. ইমাম ইবনে জারির তাবারি এ আয়াতের দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় বলেন, وقال آخرون من أهل هذه القراءة: إنما معنى الكلام: فتفرقوا دينهم بينهم كتبا أحدثوها يحتجون فيها لمذهبهم.
আয়াতটি সম্পর্কে অন্যদের অভিমত হল, তারা দ্বীনকে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত করল কিতাবাদির ভিত্তিতে- যেগুলি তারা নিজেদের মযহাব প্রতিষ্ঠার জন্য দলীল আদিল্লা হিসাবে রচনা করেছে।
খ. ইমাম কুরতুবি উক্ত আয়াতের চতুর্থ ব্যাখ্যায় ৭২ ফিরকার হাদিস এনে প্রমাণ করেছেন, এ আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য মুসলমানগণ যারা মযহাবি কিতাবাদির ভিত্তিতে দ্বীনকে বিভক্ত করেছে।
১১. নিঃসন্দেহে যারা তাদের ধর্মকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দল হয়ে গেছে, তাদের জন্য তোমার (রাসুলের) কোনো দায়দায়িত্ব নেই। নিঃসন্দেহে তাদের ব্যাপার আল্লাহ্র কাছে, তিনিই পরকালে তাদের জানাবেন যে তারা কী করেছিল। (আনআম: ১৫৯)
মুফাসসিরীনে কেরামের মতামত
ক. আবু হুরায়রা রা. বলেন, উক্ত আয়াত এ উম্মতের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে।
খ. আবু জাফর বলেন, সঠিক কথা হচ্ছে আল্লাহ তার নবীকে জানিয়ে দিচ্ছের, যে বা যারা দ্বীনের মধ্যে বিভক্তি আনবে, বিভিন্ন ফিরকায় বিভক্ত হবে রাসূল তাদের থেকে দায়মুক্ত আর তারাও রাসূল থেকে দায়মুক্ত।
গ. হযরত আবু হুরায়রা এবং হযরত উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. হযরত আয়েশা রা. কে বলেন- উক্ত আয়াত দ্বারা এ উম্মতের বিদাতী, প্রবৃত্তির অনুসারী ও গুমরাহ লোকেরা উদ্দেশ্য।
হে আয়েশা, প্রত্যেক গুনাহগারের তাওবা আছে কিন্তু বিদাতী ও প্রবৃত্তির অনুসারীদের কোন তাওবা নাই অর্থাৎ তাদের তাওবা কবুল করা হয় না। আমি তাদের থেকে দায়মুক্ত তারাও আমার থেকে মুক্ত, বিচ্ছিন্ন। (কুরতুবি)
আলোচনা: উল্লেখিত আয়াত সমূহের আলোকে বুঝা গেল ইসলামের বিধান সমূহের মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি ও ফেরকাবাজির বিধান হল সবচেয়ে কঠিন এবং কঠোর।
যেমন সূরা নিসার ১০৬ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ফিরকাবাজদের কাফের বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং তারা হাউজে কাউসার থেকে বিতাড়িত হবে।
সুরা আনআম-এর ১৫৯ নং আয়াতে রাসূলের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ নামাজ রোজা হজ যাকাত ইত্যাদি অন্য যে কোনো বিধানের ক্ষেত্রে এত কঠোর হুকুম আসেনি। এই কঠোরতার কারণ হলো কেউ নামাজ রোজা ইত্যাদি আদায় না করলে তার নিজের ক্ষতি হয় কিন্তু ইসলাম ও উম্মাহর তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি ও ফেরকাবাজি থাকলে ইসলাম ও উম্মাহর ক্ষতি হয়, কাফেররা প্রাধান্য পেয়ে যায়।
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। অথচ এসব বিধান সম্পর্কে আমরা জানি না, এই না জানার কারণ মাদরাসায় পাঠ্যভুক্ত ফিকাহ গ্রন্থগুলিতে ফেরকা সংক্রান্ত কোন অধ্যায় নেই, আমাদের ওস্তাদরাও পৃথকভাবে এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞানদান করেন না।
মাদরাসা বোর্ড, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগেও কোন দিন এ জাতীয় প্রশ্ন করা হয় না। সঙ্গত কারণেই ফেরকার বিধান আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না।
এখানেই প্রশ্নটা, আমাদের উস্তাদ, মুরুব্বি ও আলেম সমাজের কাছে প্রশ্ন হলো-
১. আপনারা কি কুরআনের এসব আয়াত বাদ দিয়ে দিলেন? বাদ না দিলে এগুলির বিধান কেন শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না? এসব কঠোর বিধান জানা থাকলে আমরা কখনোই বিভক্ত হতাম না, সমগ্র উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ থাকতাম।
২. সূরা মুমিনুন-এর ৫৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘তারা মাযহাবী কিতাবের ভিত্তিতে দ্বীনকে বিভক্ত করেছে’ তাহলে আমরা কি স্ব স্ব মাযহাবী কিতাবের ভিত্তিতে দ্বীনকে বিভক্ত করি নাই? না করলে আমাদের মধ্যে এত দল ফিরকা কেন?
ওলামায়ে কেরামের কাছে জিজ্ঞাসা, আমরা ফিকহী কিতাবের অনুসরণ করতে গিয়ে কুরআনের বিধান লঙ্ঘন করছি কিনা?
৩. কুরআন কি মানবজাতি বিশেষত মুসলমানদের ঐক্যের জন্য নাজিল হয়েছিল নাকি বিভক্তির জন্য? কাজেই উম্মাহর ইহকাল ও পরকাল রক্ষার্থে সময়ের দাবী হল, ফিরকা সংক্রান্ত কুরআন-হাদীসের নসগুলির ভিত্তিতে লিখিত একশ নম্বরের বিষয় পাঠ্যভুক্ত করা হোক, মাদরাসা বোর্ডগুলি থেকে বেশি বেশি এ জাতীয় প্রশ্ন করা হোক এবং উম্মাহর বিভিন্ন দল ও ফিরকার মধ্যে ঐক্য স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হোক। আর এসব দায়িত্ব আলেমদেরই বহন করতে হবে।
Source: http://ourislam24.com/2018/08/11/দ্বীন-প্রতিষ্ঠায়-আলেমদের/