হিজরত বন্ধ হয়ে গেছে? (তোহমত-৩)

সত্যিই কি হিজরত বন্ধ হয়ে গিয়েছে?

ইদানীং কিছু ধর্মীয় পণ্ডিত ও তাদের অনুসারী ভাইয়েরা "দাওয়াত ও তাবলীগ" নামে পরিচিত নবুয়্যতী মেহনত এর অন্ধ বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রায় সময় বলে থাকে ফতেহ মক্কার পর "হিজরত বন্ধ হয়ে গেছে"। তাই তাবলীগ ওয়ালারা যে হিজরত-নুসরতের কথা বলে তা মিথ্যা ও বাতিল।

যেহেতু এই সব বক্তা ও শ্রোতার অধিকাংশই হাদীস এর গভীর জ্ঞান ও ব্যাপকতার বিষয়ে দুর্বল ও দাওয়াতের মেহনতের বিদ্বেষ মনের গহীনে লুকিয়ে তাই তারাও অন্যকে খুশি/আঘাত করার জন্য (সময়ের অভাবে) "যাচাই ছাড়াই" এই কথা গুলাই ব্যাপক প্রচার করে থাকে। যদি তাদেরকে জ্ঞানীরা কুরআন-হাদিস-তারিখ এর কিতাব থেকে দলীল দেয়াও হয় তবুও তারা বলে "আপনি হুজুরের থেকে বেশি জানেন......?"
আমরা যারা নিজেকে 'কিতাব-বাহী-গাধা বা অন্ধ-অনুসারী' হিসেবে দেখতে না চাই তাদের জন্যই আমার এই লেখা যা আমি সংগ্রহ করেছি বিভিন্ন সূত্র থেকে। 

"হিজরত বন্ধ হয়ে গিয়েছে" প্রমাণের তথাকথিত দলীলঃ 

  • সহীহ বুখারী (ইফাঃ), ৪৮/ জিহাদ২৭৫৬ঃ ইসহাক ইবনু ইব্রাহীম (রাঃ) মুজাশি’ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাতিজাকে নিয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম - এর দরবারে উপস্থিত হলাম। তারপর আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল আমাদেরকে হিজরতের উপর বায়আত নিন’। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘হিজরত তো হিজরতকারীগণের জন্য অতীত হয়ে গেছে’। আমি বললাম, ‘তাহলে আপনি আমাদের কিসের উপর বায়আত নিবেন?’ তদুত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘ইসলাম ও জিহাদের উপর’।
  • সহীহ বুখারী (ইফাঃ), ৪৮/ জিহাদ২৮৬০ঃ আদম ইবনু আবূ ইয়াস (রহঃ) আবদুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন বলেছেন, ‘মক্কা বিজয়ের পর থেকে (মক্কা থেকে) হিজরতের প্রয়োজন নেই। কিন্তু জিহাদ ও নেক কাজের নিয়্যাত অবশিষ্ট রয়েছে আর যখন তোমাদের জিহাদের আহবান জানোান হবে তোমরা বেরিয়ে পড়বে। ’
  • সহীহ বুখারী (ইফাঃ), ৪৮/ জিহাদ২৫৯২ঃ আলী ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘(মক্কা) বিজয়ের পর আর হিজরত নেই। বরং রয়েছে কেবল জিহাদ ও নিয়্যাত। যদি তোমাদের জিহাদের ডাক দেওয়া হয়, তা হলে বেড়িয়ে পড়। ’
===========================================

"হিজরতে রসুল (মদীনার দিকে) বন্ধ হয়েছে কিন্তু হিজরত চালু আছে" এর প্রমান্য দলীল

===========================================
উপরের দলিল গুলি পর্যালোচনার জন্য আগে একটু গোঁড়া থেকে আলোচনা করতে হবে।

হিজরত কাকে বলে ?

হিজরতঃ দ্বীনের উদ্দেশ্যে কোন দেশ বা অঞ্চল ত্যাগ করাকে হিজরত বলে। (মেরকাত খন্ডঃ১, পৃষ্ঠাঃ৩১)
হিজরত দুই প্রকার । যথাঃ
  • ১) হিজরতে বাত্তা (অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য হিজরত): যে হিজরতের পর বাড়ি ফেরার সুযোগ থাকে না।
যেমনঃ সাহাবিরা(রাঃ) করেছেন। বর্তমানেঃ ভারত ভাগের সময় মুসলিমরা পাকিস্তানের দিকে করেছেন। সাইদ আহমদ এর ডাকে ১৮২০'এর দশকে মুসলিমরা সীমান্ত প্রদেশের দিকে হিজরত করেছিল। তাই তাদেরকে মুহাজির নামে ডাকা হয় (ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কী)। 
  • ২) হিজরতে বাদিয়া (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হিজরত ): যে হিজরতের পর বাড়ি ফেরার সুযোগ থাকে।

হিজরতের প্রকারভেদঃ হাদিস থেকে দলিল

হযরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা (রা) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি হিজরত করবে ? আমি বললাম হা করবো। তিনি বললেন হিজরতে বাদিয়া না হিজরতে বাত্তা? আমি জানতে চাইলাম এই দুটির মধ্যে কোনটি উত্তম?? তিনি উত্তরে বললেন, হিজরতে বাত্তা । হিজরতে বাত্তা হচ্ছে তুমি রাসুলুল্লাহ (সা) এর সাথে অবস্থান করবে। আর হিজরতে বাদিয়া হচ্ছে তুমি নিজের এলাকায় ফিরে যাবে । আর্থিক সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, ইচ্ছা থাকা না থাকা, তোমার উপর অন্যকে প্রাধান্য দেয়া হোক বা না হোক, আমীরের কথা শোনা তোমার জন্য অত্যাবশ্যক। (তিবারানি, মাজমায়ে যাওয়ায়েদ) (মুনতাখাব, অধ্যায়ঃ দাওয়াত ও তাবলিগ, হাদিস নং-৮৬)

হিজরত বন্ধ হয় নি, নিম্নের হাদিস গুলি তার দলিল

  • দলিল ০১ঃ হযরত মুয়াবিয়া, (রা) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন , তওবার দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হিজরত বন্ধ হবে না, । আর সূর্য যতক্ষন পর্যন্ত পশ্চিম আকাশে না উঠবে ততক্ষন পর্যন্ত তওবার দরজা বন্ধ হবে না। (আবু দাউদ,হা-নং-২৪৭১)(মুসনাদে আহমাদ, তিবরানী, মাজমায়ে যাওয়ায়েদ)
  • দলিল ০২ঃ আব্দুল্লাহ বিন ওয়াকদান আস- সাদী (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা একটা প্রতিনিধি দলের সাথে রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে আসলাম। আমাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন প্রশ্ন নিয়ে এসেছিল উনাকে (রাসুলুল্লাহ (সা)) কে জিজ্ঞাসা করার জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে আমিই সর্বশেষ আসলাম এবং বললামঃ আমি আমার পিছনে লোকদের ছেড়ে এসেছি এবং তারা এটা বলছিল যে, হিজরত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা) বললেনঃ যতক্ষন কাফেরদের সাথে জিহাদ চলতে থাকবে ততক্ষন হিজরত বন্ধ হবে না। ( সুনানে নাসাঈ, অধ্যায়ঃ বাইয়াত, হাদিস নং-২৪)
  • দলিল ০৩ঃ আব্দুল্লাহ বিন আস- সাদী (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা একটা প্রতিনিধি দলের সাথে রাসুলুল্লাহ (সা) এর কাছে আসলাম এবং আমার সংগীরা প্রবেশ করলো এবং তাদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলো। আমি সবার শেষে প্রবেশ করলাম। রাসুলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞাসা করলেন তোমার প্রশ্ন কি ? আমি বললামঃ ইয়া রাসুলুল্লাহ ! হিজরত কখন শেষ হবে ?
    তিনি বললেনঃ যতক্ষন কাফেরদের সাথে জিহাদ চলতে থাকবে ততক্ষন হিজরত বন্ধ হবে না। ( সুনানে নাসাঈ, অধ্যায়ঃ বাইয়াত, হাদিস নং-২৫)
  • দলিল ০৪ঃ আমর বিন আবাসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ,!, ঈমান কি? তিনি বললেন, সবর (ধৈর্য) ও সামাহাত (ক্ষমা)। সে বললো, কোন ঈমান উত্তম? তিনি বললেন, হিজরত। সে বললো, হিজরত কি? তিনি বললেন, খারাপ পরিত্যাগ করা। সে বললো, কোন হিজরত সর্বোত্তম? তিনি বললেন, জিহাদ। সে বললো, জিহাদ কি? তিনি বললেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তাদের মুকাবিলার সময়। (তিবরানী, হাদিসের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য)(মুসনাদে আহমেদ, ২/ ঈমান ও ইসলাম১৬)

হিজরত বন্ধ না হওয়ার পক্ষে কুরয়ান থেকে দলিলঃ

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনছারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কানন-কুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রস্রবণসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা।(সুরা তওবা,আয়াতঃ১০০)
"যারা তাদের অনুসরণ করেছে," এই শব্দের ব্যখ্যায় তাফসীর ইবনে কাসীরে খুব সুন্দর ভাবে বলা হয়েছে যে, কেয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালা সমস্ত উম্মাতই এই দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।

কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত হিজরত করার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা) এর উৎসাহ প্রদানঃ

দলিল ০১ঃ হযরত আবু ফাতিমা (রা) বর্ননা করেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তুমি আল্লাহর পথে হিজরত করতে থাক, কেননা হিজরতের মতো কোন আমল নেই। ( সুনানে নাসাঈ, অধ্যায়ঃ বাইয়াত, হাদিস নং-১৯)
দলিল ০২ঃ হযরত আবু কিরসাফাহ (রা) হতে বর্নিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, হে লোকেরা!! হিজরত করো এবং ইসলামকে মজবুত ভাবে ধরে রাখো। কেননা যতক্ষণ জিহাদ থাকিবে ততক্ষণ হিজরতও শেষ হবে না। (তাবারানী, মাজমায়ে যাওয়ায়েদঃ ) (মুনতাখাব হাদিসঃ পৃ-৭৫৮)
-----------------------------------------------------------------------------

বুখারির হাদিস গুলির ব্যখ্যাঃ

উপরের হাদিস গুলি ভালো করে কেউ পড়লে থাকলে তার মূল বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ার কথা ।
বুখারির হাদিস গুলি দ্বারা হিজরতে বাত্তা বা হিজরতে মদীন উদ্দেশ্য। হিজরতে বাদিয়া নয়। আর ওই সমস্ত এলাকা থেকে হিজরতে বাত্তার কোন প্রয়োজন নেই যেখানে দারুল ইসলাম প্রতিষ্টিত হয়ে গেছে।
 আর যেহেতু মক্কা বিজয়ের পর মক্কায় দারুল ইসলাম কায়েম হয়ে গেছে তাই এখান থেকে হিজরতে বাত্তার কোন প্রয়োজন নেই। (দলিল দেখুনঃ \সহীহ বুখারী (ইফাঃ), ৪৮/ জিহাদ২৮৬০; সহীহ বুখারী (ইফাঃ), ৪৮/ জিহাদ২৫৯২))

তবে যে জায়গা বা অঞ্চল দারুল কুফর এবং সেখানে যদি দ্বীন মানা কষ্ট হয় তাহলে সেখান থেকে হিজরতে বাত্তা করা জরুরি।

আর এই হুকুম কুরয়ানের আয়াত দ্বারা সাবেত।

দলীলঃ বুখারীর হাদিস গুলা 'হিজরতে মদীনা' সংশ্লিষ্ট

  • সূরা নিসায় আল্লাহ বলেনঃ  إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ ۖ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ ۚ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا ۚ فَأُولَٰئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا   যারা নিজের উপর জুলুম করে, ফেরেশতারা তাদের প্রাণ হরণ করে তখন বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলেঃ এ ভূখন্ডে আমরা অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলেঃ আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা দেশত্যাগ করে সেখানে চলে যেতে? অতএব, এদের বাসস্থান হল জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত মন্দ স্থান।(সুরা নিসা-৯৭)
  •  সুরা আনকাবুতে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ  يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ أَرْضِي وَاسِعَةٌ فَإِيَّايَ فَاعْبُدُونِ হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ, আমার পৃথিবী প্রশস্ত। অতএব তোমরা আমারই এবাদত কর।( Surah Al-Ankaboot, Verse 56:) এই আয়াতের তাফসীর দেখুনঃ (তাফসীর ইবনে কাসীর)
  • হাদিস দ্বারাও এই হুকুম সাবেত যে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, সহসা এক হিজরতের পর অপর হিজরত অনুষ্ঠিত হবে। তখন দুনিয়া বাসীদের মধ্যে তারাই উৎকৃষ্ট লোক হিসেবে পরিগনিত হবে যারা হযরত ইব্রাহিম (আ) এর হিজরতের স্থলে হিজরত করে স্থায়ী বসতী স্থাপন করবে এবং দুনিয়ায় তখন পাপী ও অসৎ লোকেরায় বাকী থাকবে। তারা নিজ নিজ দেশ হতে বিতারিত হবে এবং আল্লাহও তাদের ঘৃণা করবেন। আর আগুন তাদেরকে বানর ও শুকরের সাথে একত্রিত করবে। (আবু দাউদ,হা- নং ২৪)
  • তাহকিকের বিষয়ঃ মজার বিষয় হলো, বুখারি শরীফের উল্লেখিত হাদিস গুলি দ্বারা কেবল মক্কা থেকে হিজরতে বাত্তা বন্ধ হওয়ার হুকুম পাওয়া যায়। হিজরতে বাদিয়া বন্ধ হওয়ার কোন হুকুম নেই বরং হিজরতে বাদিয়া করার উৎসাহ আছে। (দেখুনঃ সহীহ বুখারী (ইফাঃ), ৪৮/ জিহাদ২৫৯২) 
  • এছাড়া অন্য কোন অঞ্চল থেকে হিজরতে বাত্তা বা বাদিয়া কোনটারই বন্ধের হুকুম বুখারি কিংবা অন্য কোন হাদিস গ্রন্থে নেই।

লেখাটি সংগ্রহ ও বিন্যাশ করেছেনঃ আবু উবাইদা।  
 
*****************************************

বর্তমান যুগে হিজরতের বিধান। 

*****************************************
লেখকঃ মুফতি হুমায়ুন কবির খালভি
হিজরত শব্দের আভিধানিক অর্থ ছেড়ে দেওয়া, বর্জন করা। পরিভাষায় হিজরত বলা হয়, কোনো কারণে নিজের দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষকে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র যেতে হয়। এটাই মানুষের চিরাচরিত রীতি। মক্কার জীবনে দীর্ঘ ১৩ বছর ধৈর্য ধারণ করার পর মহানবী (সা.) যখন দেখলেন, কাফিররা মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন তিনি শান্তির আশায় হেফাজত করার লক্ষ্যে সাহাবাদের হাবশায় হিজরতের অনুমতি দিলেন। নবুয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে ১১ জন পুরুষ ও পাঁচজন নারী আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তাঁদের মধ্যে হজরত ওসমান (রা.)ও ছিলেন। এটাই ইসলামের প্রথম হিজরত। তাঁদের অনেকে মক্কায় পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার খবর শুনে ফেরত এসেছিলেন। পরে যখন দেখা গেল, খবরটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট, তখন নবুয়তের সপ্তম বছর জাফর (রা.)-এর নেতৃত্বে প্রায় ৮৬ জন পুরুষ ও ১৭ জন নারী সাহাবা দ্বিতীয়বার আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এটি ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় হিজরত। পরে তাঁরা সপ্তম হিজরিতে সেখান থেকে মদিনায় হাজির হয়েছিলেন।

ইসলামের সবচেয়ে আলোচিত হিজরত হলো, মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত। এ হিজরতের পটভূমি তৈরি হয়েছিল ঐতিহাসিক আকাবা নামক স্থানের শপথের মাধ্যমে। নবুয়তের ১১তম বছর মদিনার ছয়জন ইমানদার আর ১২তম বছর ১২ জন আকাবা নামক স্থানে ইসলাম ও মহানবী (সা.)-কে সাহায্য করার শপথ নেন। আর ১৩তম বছরে ৭৩ জন পুরুষ ও দুজন নারী মহানবী (সা.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তাঁরা মক্কার মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। মহানবী (সা.) সাহাবাদের মহররম মাস থেকে মদিনায় হিজরত করার অনুমতি দিলেন। মদিনায় সর্বপ্রথম হিজরত করেছেন মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)। আবু বকর (রা.) রাসুল (সা.)-এর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। যাতে তিনি তাঁর সঙ্গে হিজরত করতে পারেন। সাহাবাদের হিজরতের দুই মাস পর মহানবী (সা.) রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার হিজরত করেন। হিজরতের সময় মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে আবু বকর ও তাঁর গোলাম আমের ইবনে ফুহাইরা ও পথনির্দেশক আবদুল্লাহ ইবনে আরিকত দুয়ালিও ছিলেন। তিনি বাইয়াতে আকাবার তিন মাস পর ২৭ সফর বৃহস্পতিবার রওনা দেন। তিন দিন ছুর নামক পর্বতে গোপন থাকার পর সোমবার পহেলা রবিউল আউয়াল আবার রওনা দেন। ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি কুবা নগরীতে পৌঁছেন। ১৪ দিন অবস্থান করার পর তিনি সেখানে মসজিদে কুবা প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর তিনি মদিনায় গমন করেন। (ইব্ন কাছির, আল বিদায়া, খণ্ড-৩, পৃ. ১৮৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় যাওয়ার পর দুর্বল ও অক্ষম ছাড়া মক্কার সব মুসলমানের ওপর হিজরত করা ফরজ ছিল। এটি ছিল তখন ইমানের শর্তস্বরূপ। এর কারণ ছিল প্রথমত, মুসলমানরা যেন ইসলামের নিদর্শন যেমন—জুমা, ঈদ, জামাতে নামাজ, আজান ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা যেন দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করতে পারেন। তৃতীয়ত, তাঁরা যেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও দ্বীনি দাওয়াত ব্যাপকভাবে বিশ্বে পৌঁছিয়ে দিতে পারেন। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের বিধান রহিত হয়ে যায়। 
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মক্কা বিজয়ের পর কোনো হিজরত নেই, তবে জিহাদ ও নিয়ত অবশিষ্ট রয়েছে। আর যখন তোমাদের সবাইকে (প্রতিরোধ সংগ্রামে) বের হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়, তখন তোমরা বের হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৭৮৩)
হিজরতের বিষয়ে ফুকাহায়ে কিরাম বলেন, কাফির রাষ্ট্র থেকে ইসলামের প্রাথমিক যুগে হিজরত করা মুস্তাহাব ছিল। সে নির্দেশ মোতাবেক সাহাবারা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। পরে মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করায় মুসলমানদের জন্য সেখানে হিজরত করা ফরজ ছিল, কিন্তু অষ্টম হিজরিতে সে বিধান রহিত হয়ে যায়। তাই এর পর থেকে হিজরত করা মুস্তাহাব।
অমুসলিম দেশ থেকে মুসলিম দেশে হিজরত : কোনো মুসলমান যদি এমন কোনো অমুসলিম দেশে বসবাস করে, যেখানে ইসলামের প্রকাশ সম্ভব নয়, তাহলে সামর্থ্য থাকলে নারী-পুরুষ সবার জন্য সেখান থেকে হিজরত করা ওয়াজিব। আর এ ধরনের রাষ্ট্রে কোনো মুসলমান নিজ দেশ ত্যাগ করে বসবাস বা চাকরির উদ্দেশ্যে যাওয়া হারাম। শুধু দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য যেতে পারবে।
আর যে দেশে সে নিজের ইমানের কথা প্রকাশ করতে পারে ও ইসলামের যাবতীয় কাজ আদায় করতে পারে, সেখান থেকে হিজরত করা জরুরি নয়। তবে কোনো মুসলিম দেশে হিজরত করা মুস্তাহাব, সেখানে যাতে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মোল্লা আলী কারি (রহ.) লিখেছেন, 
‘হিজরত তথা দেশ ত্যাগ করে মদিনা যাওয়া রহিত হয়ে গেছে। তবে জিহাদের জন্য বা ভালো নিয়ত তথা কাফির রাষ্ট্র ত্যাগ করা কিংবা বিদআত থেকে পলায়ন করা অথবা অজ্ঞতা ও ফিতনা থেকে পলায়ন করা বা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য হিজরত করার বিধান এখনো আছে। এ বিধান রহিত হয়নি।’ (মিরকাতুল মাফতিহ, খণ্ড-৪, পৃ. ১৮২)

মুসলিম দেশ থেকে অমুসলিম দেশে হিজরত

নসিহত অর্জনের জন্য বিভিন্ন অমুসলিম দেশ সফর করা মুস্তাহাব। তবে সেখানে বেশি দিন অবস্থান করা যাবে না। পরিদর্শন শেষে দ্রুত চলে আসবে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? তাহলে দেখত যে তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছে। শক্তিতে তারা ছিল তাদের চেয়ে প্রবল, তারা জমি চাষ করত, তারা সেটা আবাদ করত তাদের চেয়ে বেশি। তাদের কাছে এসেছিল তাদের রাসুলরা সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে। আসলে তাদের প্রতি জুলুম করা আল্লাহর কাজ ছিল না। বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ৯)

অমুসলিমদের দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে হিজরত করা মুস্তাহাব।

অন্যান্য হিজরত ও সফর

  • হজ পালনের জন্য নিজ দেশ থেকে হিজরত করা হজের জন্য ফরজ। নফল হজের জন্য নফল।
  •  যদি কোনো এলাকায় বিদআত চলে আর ইমানদার ব্যক্তি তাদের তা থেকে বিরত রাখতে না পারে, তখন সে এলাকা ত্যাগ করে সহিহ আকিদায় বিশ্বাসী নেককারদের এলাকায় হিজরত করা মুস্তাহাব। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, 
‘যখন তুমি দেখবে যে লোকেরা আমার আয়াতগুলো দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করছে, তখন তুমি তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে, যতক্ষণ না তারা অন্য কোনো প্রসঙ্গে নিমগ্ন হয়। শয়তান যদি তোমাকে এটা ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর আর এই জালিম লোকদের সঙ্গে তুমি বসবে না।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৬৮)
  • ইবনু কাসিম বলেন, আমি ইমাম মালিককে বলতে শুনেছি, কোনো মুসলিমের জন্য ওই এলাকায় বসবাস করা বৈধ হবে না, যেখানে সালফে সালেহিনদের গালি দেওয়া হয় (তাফসিরে জুহাইলি, খণ্ড-৫, পৃ. ২৩৩)
  • যে এলাকায় হালাল উপার্জন অসম্ভব, সে এলাকা ত্যাগ করে হালাল উপার্জন করা যায়, এমন এলাকায় হিজরত করা ওয়াজিব।
  • বর্তমানে অনেক অমুসলিম রাষ্ট্রে মুসলমানদের কষ্ট দেওয়া হচ্ছে, তাদের সামর্থ্য থাকলে কোনো মুসলিম দেশে হিজরত করা ওয়াজিব—যে দেশ তাদের আশ্রয় বা নাগরিকত্ব দেবে।

পরিশেষে বলা যায়, কোনো মুসলমান এমন অমুসলিম দেশে বসবাস করতে পারবে না, যেখানে দ্বীনি কাজ আদায় করা তথা ফরজ আদায় করা সম্ভব নয়। তেমনি কোনো ব্যক্তি বসবাসের জন্য বা দীর্ঘস্থায়ীভাবে সেখানে ভিসা নিয়ে যেতে পারবে না দাওয়াতের নিয়ত ছাড়া। তবে যে অমুসলিম দেশে দ্বীনি কাজ আদায় করা যায়, সেখানে হিজরত করা মাকরুহের সঙ্গে বৈধ। সেখানকার মুসলমানদের কোনো মুসলিম দেশে হিজরত করা মুস্তাহাব। তবে কেউ যদি তাদের দাওয়াত দেওয়ার জন্য যায় বা এমন কোনো প্রশিক্ষণের জন্য যায়, যা দিয়ে মুসলমানরা উপকৃত হবে আর তা কোনো মুসলিম দেশে সম্ভব নয়, তখন সে দেশে হিজরত বৈধ হবে। ব্যবসার খাতিরেও সেখানে যেতে পারবে।

লেখক : লেকচারার, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন