কোরবানির ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি। ১৯০৩ সালের সরকারি ছুটির তালিকায় দেখা যায়, মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটি ছিল মাত্র এক দিন। মূলত সাতচল্লিশ-পরবর্তী সময় হতে এই অঞ্চলে ধুমধামের সঙ্গে ‘কোরবানির ঈদ’ পালিত হতে শুরু করে। পাকিস্তান আমলেও এখনকার মতো এত অধিকসংখ্যক পরিবার কোরবানি দিতে পারত না। বিলি করা মাংস দিয়েই মিটত গো-মাংসের স্বাদ। উচ্চবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্তের সীমানা পেরিয়ে কোরবানি এখন মধ্যবিত্তের বৃত্তে।
ঈদুল আজহা ইংরেজ আমলে ‘বকরি ঈদ’ নামেই পরিচিত ছিল। হিন্দু জমিদার অধ্যুষিত এই অঞ্চলে গরু কোরবানি সম্পর্কে বৈরী মনোভাব থাকার কারণে সেসময় ছাগল তথা বকরি কোরবানি দিতে হতো। উনিশ শতকের সাহিত্য ও সংবাদ-সাময়িকপত্রে তার প্রমাণ মেলে। ১৮৮২ সালে দয়া নন্দ সরস্বতী গো-রক্ষা আন্দোলনের সূচনা করেন। প্রচারপত্রের মাধ্যমে হিন্দু জনসাধারণকে হাটে-বাজারে মুসলমান কসাই-এর কাছে গরু বিক্রি করতে নিষেধ করা হয়। সে সঙ্গে হিন্দু জমিদারদের নিজ নিজ জমিদারিতে গো-হত্যা বন্ধ করার আবেদন জানানো হয়।
তথাকথিত মুসলিম সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন এর কুরবানী বিরোধী গ্রন্থ
গো-হত্যার বিপক্ষে মত প্রকাশ করে মীর মশাররফ হোসেন রচনা করেছিলেন ‘গো-জীবন’ গ্রন্থ। মশাররফ হোসেনের ‘গো-জীবন’-এর (১৮৮৯) প্রতিবাদে মৌলভী নইমুদ্দীন রচনা করেন ‘গো-কান্ড’ (১৮৮৯)। বাদ-প্রতিবাদ শেষে তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মীর মশাররফ হোসেনের ‘গো-জীবন’ গ্রন্থের প্রতিবাদে সেসময় বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। তন্মধ্যে অন্যতম একটি রচনা হলো রেয়াজুদ্দীন মাশহাদীর ‘অগ্নিকুক্কুট’ (১৮৯০)। অগ্নিকুক্কুটের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে ১২৯৬ সালের ৩ ফাল্গুন ‘সুধাকর’ পত্রিকাতে লেখা হয়— ‘গরু কোরবানি ও গো-মাংস ভক্ষণ মোসলমানের সামাজিক কার্য, উহা লইয়া হিন্দুগণ মোসলমানদের প্রতি অত্যাচার করেন, তাহার কারণ কি এবং সেই অত্যাচার নিবারণের উপায় কি, তৎ সমুদয় এই পুস্তকে দেখান হইয়াছে। ইহার প্রথম অংশে যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ, দ্বিতীয় অংশে শাস্ত্রসম্মত প্রমাণ ও তৃতীয় ভাগে হিন্দুদিগের বেদ-সংহিতার ভূরি ভূরি প্রমাণে পরিপূর্ণ।’ যা হোক, মশাররফ-নইমুদ্দীনের মামলার নিষ্পত্তি হলেও গো-হত্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে বিশ শতকের পুরো প্রথমার্ধ। পূর্ব-বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে কোরবানি নিয়ে সহিংস ঘটনা ঠেকাতে এবং নির্বিঘ্নে গরু কোরবানির অধিকার আদায়ে ঢাকার নওয়াবদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ‘ঢাকা প্রকাশ’ (১৮৭৯) পত্রিকার প্রকাশিত তথ্য হতে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বর, ১৮৭৯ হতে ১ জানুয়ারি ১৮৮০ পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য গো-মেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে নবাব সাহেবের জমিদারিতে জাত সর্বোৎকৃষ্ট ষাঁড়টির দাম ছিল ২৫ টাকা।সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রণীত, ‘ঈদুল আজহা’ গ্রন্থের আখ্যা ভাগ, ১৯০০ সাল। ছবি: সংগৃহীত
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রণীত, ‘ঈদুল আজহা’ গ্রন্থের আখ্যা ভাগ, ১৯০০ সাল। ছবি: সংগৃহীত
সাহিত্য ও সংবাদ-সাময়িকপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়; একালে যেমন ঢাকার মাঠে-ময়দানে, রাস্তায়-রাস্তায় গরুর হাট বসে, সেকালে তেমনটি ছিল না। সেকালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল যেমন কম, কোরবানির পশুর সংখ্যাও ছিল তেমনি সীমিত। নির্দিষ্ট কিছু জায়গা যেমন রহমতগঞ্জ, গাবতলী, সোয়ারীঘাট ও জিঞ্জিরায় গরুর হাট বসত। বিশেষত ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনির নামে রহমতগঞ্জের হাটটি ছিল প্রসিদ্ধ, যা ‘গনি মিয়ার হাট’ নামে পরিচিত। এই হাটের প্রচার কৌশলটিও ছিল বেশ চমকপ্রদ। হাটের ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে চিৎকার করে বলতেন, ‘ধার করো, কর্জ করো, গনি মিয়ার হাট কর।’ হাটে মুন্সিগঞ্জ জেলার মীরকাদিম বাজার থেকে আসত সাদা নাদুসনুদুস গাই গরু। পরিমাণে কম হলেও আসে এখনো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উৎকৃষ্ট মানের মীরকাদিমের ওই গরু কিনতে আসেন বিত্তশালী ও ব্যবসায়ীরা। গরুগুলো বিশেষ পরিচর্যায় পালিত হয়। এ গরুর গোশত বেশ সুস্বাদু। সাধারণত খৈল, ভুসি, খুদ, কুঁড়া ইত্যাদি খাওয়ানো হয় এসব গরুকে।
একবিংশ শতকে এসে কোরবানি সংস্কৃতির চিত্র অবশ্য কিছুটা ভিন্নমুখী। মুসলমানদের ঈদ উৎসব পালনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে অনেকেই এখন কোরবানি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে প্রাপ্ত আতাউর সুষ্ময়ের লেখা গল্পটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ:
‘.....আমার বোনটাও বড় হইছে। তার বিয়ের জন্য লোকজন প্রায় দেখতে আসেন। কোরবান না দিলে মানুষ আল্লার ওয়াস্তে গোস্ত দিতে আসবে। যদিও আম্মু আল্লার ওয়াস্তে গোস্ত নিবে না জীবন গেলেও। তবুও মানুষ তো দিতে আসবে। বোনের বিয়ের জন্য ছেলে পক্ষরা খোজ খবর নেওয়ার সময় জেনে যাবে মেয়ের বাপ কোরবান দেয় না। ভালো অবস্থার কোনো ছেলে তখন বিয়ে করতে আসবে না। কোরবান না দেওয়ার বিষয়টা খুবই লজ্জাজনক। কোরবান না দিলে বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে যেতে পারে! অথচ কোরবান তো সবার জন্য ফরজ করা হয় নাই। নামাজ ফরজ করা হইছে। নামাজ না পড়াটা লজ্জাজনক হওয়ার কথা ছিল। নামাজ না পড়ার কারণে বিয়ে ভাঙা উচিত ছিল। কিন্তু আজকাল নামাজ না পড়াটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেককেই গর্ববোধ করে বলতে দেখি—আরে কাজকর্মে এতো ব্যস্ত, নামাজ পড়ার সময় কই!..’ গল্পের এই অংশে কুরবানি সংস্কৃতির যেই চিত্র ফুটে ওঠেছে সেটা চলমান সমাজ ব্যবস্থার জন্য নিঃসন্দেহে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার।
একালেই হোক আর সেকালেই হোক ঈদুল আজহা’র শিক্ষা চিরন্তন ও শাশ্বত। আড়ম্বরের প্রতিযোগিতায় যাতে কোরবানির মাহাত্ম্য হারিয়ে না যায় সে বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ’র আরও সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। কোরবানির আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ত্যাগ ও আত্মবিসর্জনের কল্যাণকর পথে চলাই হোক সকল মুসলিমের দৃঢ় প্রত্যয়।
সহায়ক গ্রন্থঃ
১.
স্মৃতিকথায় বাংলার মুসলিম সমাজ (১৯১১-১৯৪০), এ.এস.এম. বোরহান উদ্দীন, বাংলা একাডেমী।
২.
অন্যজীবন, জাহানারা ইমাম, চারুলিপি।
৩.
উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা ও চেতনার ধারা, ওয়াকিল আহমদ, নভেল পাবলিশিং হাউস।
*হোসাইন মোহাম্মদ জাকি: লেখক ও গবেষক
Tags
ইসলামের ইতিহাস