আফগানিস্তান থেকে আরাকান পর্যন্ত ভূখণ্ডটি হিমালয়ান উপমহাদেশ। যদি ধরে নেয়া হয় যে, প্রথম মানব হযরত আদম আ. ভারতবর্ষেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাহলে এটিই প্রথম মানববসতি। যদিও তিনি বিবি হাওয়া আ. এর সাথে সাক্ষাৎ ও জীবন যাপন করেছিলেন বিশ্বের আদি বসতি এবং সভ্যতার প্রথম সূতিকাগার মক্কা শরীফে। ভারতবর্ষে তাঁর বংশধর হযরত নূহ আ. এর পর বিস্তৃত হয়। ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্য সামের বংশধর, উপমহাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হামের বংশধর, আর দূরপ্রাচ্য ও চীন জাপান ইত্যাদিতে ইয়াফেসের বংশধর বিস্তার লাভ করে। বলা হয়, হামেরই দুয়েক পুরুষ পরের দু’জন ব্যক্তির নাম সিন্দ ও হিন্দ। যেমন, তাদের আরো নিচের দিকের কোন সন্তানের নাম বঙ্গ। উপরোক্ত সাম, হাম, ইয়াফেস হযরত নূহ আ. এর সন্তান।
সে যাই হোক ভারতবর্ষে প্রচলিত তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক ধর্ম কমপক্ষে সাত হাজার বছর পৃথিবীতে বর্তমান ছিল। আরব মুসলমানরা ভারতবর্ষের নাম হিন্দুস্তান রাখেন। হিন্দের অধিবাসীরাই হিন্দুস্তানী বা আহলে হিন্দ। প্রচলিত ভাষায় হিন্দু। হিন্দু কোন ধর্ম নয়। বর্তমানে ভারতবর্ষে যারা হিন্দু তার মূলত সনাতন ধর্মের অনুসারী। সনাতন ধর্ম অর্থ দ্বীনে হানীফ যা হযরত ইব্রাহীম আ. থেকে নতুন করে প্রাণ লাভ করে। এর মূল কথাই হল তাওহীদ। এক আল্লাহর সামনে আনুগত্যের মস্তক ঝুঁকিয়ে দেয়া, নিজের ইচ্ছা ও আশা আল্লাহর সামনে মিটিয়ে দেয়া। এ অবস্থার নাম ইসলাম। এ আদর্শের অনুসারীর নাম মুসলিম।
আজও পর্যন্ত ভারতীয় হিন্দুদের কোন ধর্মীয় গ্রন্থে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিরোধী কোন রীতি ও সংস্কৃতির উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এক আল্লাহর কথা তাদের সব গ্রন্থে লেখা আছে। আছে রিসালাতের কথা। এমনকি শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াতের কথা। তাঁর প্রতি ঈমান আনার কথা হিন্দুদের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও দালিলিক ধর্মীয় গ্রন্থ অথর্ব বেদে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পূর্ণ জীবনীই বর্ণিত আছে। এরপরও হিন্দুরা কেন শিরক করে মূর্তিপুজা করে অসংখ্য দেব-দেবীর আরাধনা করে, ধর্মের নামে নানা ধরনের রসম রেওয়াজ ও ভুল সংস্কৃতি চর্চা করে এটি একটি জবাব না পাওয়া ঐতিহাসিক প্রশ্ন, এমনকি তা ইতিহাসের এক করুণতম ট্রাজেডীও বটে। আজ যদি ভারতের হিন্দু অধিবাসীরা তাদের মূল অবিকৃত সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী হত তাহলে এরা মুসলিম ছাড়া আর কিছুই হত না। কারণ, তাদের সকল ধর্মগ্রন্থের মূল নির্দেশনাই হচ্ছে- একমে ব দ্বিতীয়ম অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আর কলিযুগে খর্জুর মণ্ডিত উপত্যকায় পরমেশ্বরের দাস নামক পিতা ও শান্তি নামক মাতার গৃহে জন্মলাভকারী নরাশংস নামক শেষ নবীর অনুসরণ ছাড়া কোন মানবের মুক্তি মিলবে না। মৃত্যুর পর মানুষকে স্বর্গ অথবা নরকে যেতে হবে। এখানে আখেরাত জান্নাত জাহান্নাম তো পাওয়া যায়ই শেষ যুগে খেজুরওয়ালা দেশে আবদুল্লাহ ও আমেনার ঘরে মুহাম্মদ নাম নিয়ে আগত নবীর কথাও পাওয়া যায়। নরাশংস অর্থ দুনিয়ার সব মানুষের প্রশংসার পাত্র অর্থাৎ মুহাম্মদ।
গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত চার হাজার বছর আগে হযরত মুসা আ. এর অনুসারী কিছু লোক আসমানী শিক্ষা ও আদর্শ নিয়েই ভারতবর্ষে আসে। এরা আফগানিস্তানের খায়বার হয়ে পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে। বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, কাশ্মীর হয়ে তারা স্থান করে নেয় গোটা উত্তর প্রদেশে। আরেক দল সমুদ্র পথে এসে দেবল, বম্বে, গোয়া, সুরাট, গুজরাটে ঘাঁটি গেড়ে বসে। অন্য একটি দল দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে আসমানী নির্দেশনা থেকে এদের উত্তরসূরীরা দূরে সরে যেতে থাকে। এক দুই প্রজন্ম পর এরা ইসলাম ছেড়ে হিন্দের স্থানীয় সংস্কৃতি ধারণ করে এবং হাজার রকম রীতি-নীতি ও প্রবৃত্তির চাহিদা মিলিয়ে এক অদ্ভুদ ধর্মাচার প্রবর্তন করে। পাশাপাশি ভারতের আদিবাসিন্দাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সীমাহীন অত্যাচার ও শোষণের কৌশল প্রণয়ন করে এদেশের মালিক-মুখতার বনে যায়। এরা ধর্মীয় প্রাধান্য ও বংশীয় কৌলিন্য বজায় রাখার জন্য নিজেদের হযরত ইব্রাহীম আ. এর অনুসারী বা বংশধর বলে পরিচয় দেয়। বলে, তারা ব্রাহমন অর্থাৎ ইব্রাহীমের সন্তান বা অনুসারী, বাংলা বানানে ব্রাহ্মণ, ওরা নিজেদের আর্য বলেও গর্ব বোধ করে। আর্য শব্দটি আরইয়া থেকে নির্গত। এই মূল থেকেই ইরান ও আরিয়ান। ভারতবর্ষে তাওহীদ রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক আদি ধর্ম বিনাশে এই পথভ্রষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদই একমাত্র দায়ী। এরা বনী ইসরাঈলের একটি শাখা এবং অভিশপ্ত ইহুদীবাদের আদি অংশ। শিরক ও অপসংস্কৃতি, শোষণ ও অনাচারের প্রবক্তা। বাংলাদেশের সকল মানুষ ছিল অনার্য। ইসলামের আগমনের পূর্বে প্রথমে সনাতন ও পরে এরা বৌদ্ধ ধর্ম পালন করত। এ দেশে দক্ষিণ ভারত থেকে ব্রাহ্মণরা এসে বৌদ্ধদের ব্যাপক গণহত্যার মাধ্যমে প্রায় নির্মূল করে দেয়। অন্যদের অস্পৃশ্য বানিয়ে শোষণ করতে থাকে। অবশেষে ইসলাম এসে এ দেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। পৃথিবীর জঘন্যতম পথভ্রষ্ট সম্প্রদায় এই ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপক্ষে বৌদ্ধ ধর্ম ছিল এক জ্বলন্ত বিদ্রোহ। ধারনা করা হয়, ব্রাহ্মণরাজার পুত্র রাজকুমার সিদ্ধার্থ সত্য দিনের পরিচয় পেয়েই গৃহত্যাগী হয়েছিলেন। বুদ্ধি বা বোধি প্রাপ্ত হয়ে তিনি যখন মুর্তিপূজাসহ ধর্মের নামে প্রচলিত সকল অধর্ম ত্যাগ করে এক প্রভুর আরাধনা শুরু করেন, যখন তিনি সাধনার দ্বারা নিজেকে বোধিপ্রাপ্ত বলে প্রচার করেন, যখন তিনি পরকালে আল্লাহর সাথে মানুষের সাক্ষাতের কথা বলেন তখন তাকে দ্বীনের হানীফ বা প্রকৃত সনাতন ধর্মেরই প্রচারক বলে মনে হয়। বর্তমান বিকৃত বৌদ্ধ ধর্ম বাদ দিয়ে এর আদিরূপ খুঁজে বের করলে এর সাথে ইসলামের তেমন দুরত্ব দেখা যাবে না।
একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা যায় যে, পবিত্র কোরআনে ‘যাল কিফল’ বলতে যে ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, এর একটি ব্যাখ্যা এমনও আছে যে, তিনিই রাজকুমার সিদ্ধার্থ তথা গৌতম বুদ্ধ। তার জন্মস্থান ‘কপিলাবস্তু’। এ নামটিই ‘কিফল’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকতে পারে। এরও আড়াই হাজার বছর পর যখন ইসলাম ভারতবর্ষে আসে তখন অসংখ্য হিন্দু ও বৌদ্ধ সত্যকে চিনে নেয়। যদিও বিদ্বেষী ইসরায়েলী ব্রাহ্মণ ও সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করেনি, বরং এদের অনেকেই দেড় হাজার বছর যাবত ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সবরকম বিদ্বেষ ও শত্রুতা চালিয়ে এসেছে। ইসলামের ৫০০ বছর আগে আল্লাহর নবী ঈসা আ. নবী হিসেবে দুনিয়ায় আসেন। শেষ নবীর আগমনে তার নবুওয়ত শেষ হয়ে যায়। তিনি তাঁর অনুসারীদের বলে গিয়েছিলেন আমার পর আসবেন শ্রেষ্ঠ নবী ও বিশ্বনবী, যার নাম হবে আহমদ। তোমরা যারা তাঁর দেখা পাবে অবশ্যই তাকেই অনুসরণ করবে। আমরা জানি খ্রিস্টানরা অনেকে ইসলাম গ্রহণ করলেও অধিকাংশই মুসলমান হয়নি। তারা খ্রিস্টানই থেকে গেছে। বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক মানুষ বৌদ্ধ, দ্বিতীয় জনসংখ্যা খ্রিস্টান এমনকি ভারতবর্ষের বিপুল সংখ্যক মানুষ হিন্দু। যদিও তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ অনুসরণ করেই তাদের মুসলমান হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এরপর পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ তো আছেই। প্রমাণ হিসেবে সত্য দ্বীনের এসব আসমানী বাণী তারা নির্দ্বিধায় অনুসরণ করতে পারত।
তাছাড়া তাদের চোখের সামনে রয়েছে আল্লাহর ঘর, যমযমের কূপ, সাফা, মারওয়া, আরাফাত, মিনা, মুযদালিফা, মহানবীর পবিত্র স্মৃতিবিজড়িত হাজারো নিদর্শন ও জীবন্ত মসজিদে নববী। রয়েছে অবিস্মরণীয় মোজেযা পবিত্র কোরআন। তাছাড়া সত্য দিনের জ্বলন্ত উপমা কোটি কোটি মুসলমান তো আছেই। কিন্তু সত্য গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ানো অহংকার, অন্যায়, দম্ভ, মনের সংকীর্ণতা, বিদ্বেষ এবং দুনিয়ার স্বার্থ ও লোভ-লালসা বিধর্মীদের চোখ অন্ধ করে রাখে। সত্যের প্রতি অনীহা তাদের বিবেকের উপর পর্দা ফেলে রাখে। আল্লাহ হেদায়াত না দিলে আর কেউই মানুষকে পথ দেখাতে পারে না।
ভারতবর্ষে ছয়শ সতের খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম অন্তত পাঁচজন সাহাবী আগমন করেন। তারা হাবশার মুহাজির ছিলেন। বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চীন যাওয়ার পথে তারা পাক-ভারত বাংলার নানা উপকূলে অবতরণ করেন। তাদের কারো কারো কবর চীনের ক্যান্টন বন্দরে সাহাবী মসজিদ প্রাঙ্গনে রয়েছে। এদের দলনেতা ছিলেন হযরত আবূ ওয়াক্কাস ওয়াহাইব ইবনে মালেক রাযি.। তিনি বিখ্যাত সাহাবী সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাযি. এর পিতা। এরপর অসংখ্য মুসলমান এ অঞ্চলে পদার্পণ করেন। সাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ পর্যায়ের কতজন বা কারা কারা এসেছিলেন তা স্পষ্ট না হলেও প্রতি যুগে অসংখ্য ইসলাম প্রচারক যে এ এলাকায় এসেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। যার ফলে আমাদের বর্ণিত অঞ্চলে আজ প্রায় আশি কোটি মুসলমান। এ অঞ্চলের মুসলমানের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী চেতনা শিক্ষা ও আদর্শ প্রচারে অতীতযুগে অনেকের উল্লেখযোগ্য অবদান অনস্বীকার্য। আধুনিক সময়ে এ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর দ্বীন-ঈমান ও আমল-আখলাকের বিষয়ে বাস্তব দিক-নির্দেশনা কারা দিচ্ছেন। অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত কারা প্রচার করছেন। কোরআন ও সুন্নাহর বিকাশ ও সুরক্ষায় কারা উপযুক্ত ভূমিকা পালন করছেন এসব বিষয় জানা ও গবেষণা করা সময়ের দাবী। উলামা ও তালাবাদের এসব বিষয়ে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসা ইসলাম ও মুসলমানের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরী।
Tags
ইসলামের ইতিহাস