মেজর মো. আবুল মঞ্জুর হত্যাকান্ড : লরেন্স লিফশুল


মেজর মো. আবুল মঞ্জুর হত্যাকান্ড : লরেন্স লিফশুলৎজ 
প্রথম আলো প্রতিবেদন

আখ্যান

১৯৮১ সালের ১ জুন মধ্যরাতে চট্টগ্রামে অবস্থিত সেনাবাহিনীর ২৪তম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মো. আবুল মঞ্জুর সেনানিবাসে সামরিক হেফাজতে থাকার সময়ে রহস্যজনকভাবে নিহত হন। একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে মঞ্জুর নিজের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রের উচ্চ সম্মান ‘বীর উত্তম’ খেতাব। 
মঞ্জুরকে যাঁরা চিনতেন, সবাই তাঁর সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। তিনি একজন মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তার পরও চট্টগ্রাম সফররত অবস্থায় ৩০ মে ১৯৮১ জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হলে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ তাঁর বিরুদ্ধে জিয়া-সরকার উৎখাতে অভ্যুত্থান সংগঠিত করার অভিযোগ তোলেন। এরশাদের সহযোগীরাও এর সঙ্গে গলা মেলান। 
সেনা সদর দপ্তর থেকে যে গল্পটি ছড়ানো হয়, তা নিয়ে শুরু থেকেই জনমনে ব্যাপক সংশয় ছিল। আমরা যারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান বা অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছি, তাদের কাছে এটা পরিষ্কার ছিল যে এই সুপরিকল্পিত গল্প ছড়ানোর পেছনে অন্য কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য আছে। যাঁদের ঘটে কিছু আছে, তাঁরা জানতেন, এই ‘দাপ্তরিক গল্প’-এর টালমাটাল ‘সত্য’কে বুঝতে হলে কঠোরভাবে যা অনুসরণ করতে হবে, তা হলো সন্দেহের মৌলিক দিকনির্দেশনা। 
চট্টগ্রামে কী ঘটেছে, তা নিয়ে সেনা কমান্ড প্রথম দিন সুবিন্যস্ত, সরল ও সুসমন্বিত ‘মিথ্যা আখ্যান’ ছড়ায়। জিয়া হত্যার ১২ ঘণ্টা পর এটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। গল্পটা এ রকম: মেজর জেনারেল মঞ্জুর ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে অভ্যুত্থান করেছেন, যার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা। 
কিন্তু চট্টগ্রামের খবরটাই ছিল গোলমেলে। মঞ্জুরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনার উদ্দেশ্য যদি হয় জিয়াকে হত্যা করে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া, তাহলে নিজের লক্ষ্য সম্পর্কে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি ছক কেটে দেখার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিল বলে মনে হচ্ছে না। 
সে সময় যাঁরা তাঁর পাশে ছিলেন এবং এখনো জীবিত রয়েছেন, তাঁরা বলেছেন, মঞ্জুরের মধ্যে তাঁরা যে চাঞ্চল্য ও দ্বিধা দেখেছেন, তাতে এটি স্পষ্ট যে তিনি নিজেই ঘটনার গতিপ্রকৃতি বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। তিনি সময় ক্ষেপণ করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলেন। আর যা-ই হোক, অভ্যুত্থানের সতর্ক পরিকল্পক ও বাস্তবায়নকারীর আচরণ তা হতে পারে না। 
বাংলাদেশের মানুষ অভ্যুত্থানের সঙ্গে পরিচিত। তারা জানে, কীভাবে তা সংঘটিত হয়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন। রক্তমাখা হাতে যাঁরা ক্ষমতা দখল করেন, তাঁরাও এক ‘গল্প’ ফেঁদে বসেন। কিছুদিন তা চলেও। তবে সময় এলে সেই ‘আখ্যান’ ভেঙে পড়ে। ‘ছয় মেজর’ মিলে ‘পুরো ঘটনাটি কীভাবে ঘটাল’ তার ‘কার্যকরী খসড়া’র তত্ত্ব ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এই অভ্যুত্থানের পেছনে যে দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা ও বিশদ যোগাযোগ সক্রিয় ছিল, ছায়ার জগৎ থেকে ধীরে ধীরে তা আলোতে চলে আসে। মার্কিন দূতাবাসের একটি অংশের সঙ্গেও অভ্যুত্থানকারীদের যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়। 
এই হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁর অধীনদের এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে চমকপ্রদ গল্প শোনা যায়। কিন্তু অভ্যুত্থান হয়ে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন, দূতাবাসের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তিনি তাঁর নির্দেশ পালন করাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের নির্দেশদাতা ছিল অন্য কোথাও। সেই গল্পের তল খুঁজতে যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হয়। (দেখুন, ‘অতীতের মৃত্যু নেই: ১৯৭৫-এর আগস্ট অভ্যুত্থানের দীর্ঘ ছায়া’, লরেন্স লিফশুলৎজ, প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট, ২০০৫)। 
সে বছর আমি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে বসবাস করলেও ৩০ মে ১৯৮১ তারিখে, চট্টগ্রামে জিয়া হত্যার সময়, এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে আমি ভারতের বিহারে ছিলাম। খবরটা শোনার পর আমি কলকাতার উদ্দেশে রওনা হই। তিন দিন পর বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে রওনা দিই ঢাকার দিকে। 
ঢাকায় আসার এক সপ্তাহের মধ্যে আমি অনেক তথ্য জোগাড় করে ফেলি। সেই সপ্তাহেরই শেষ দিকে পুলিশ আমাকে তুলে নিয়ে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করে। সে সময় অনেক বিদেশি সাংবাদিকই ঢাকায় অবাঞ্ছিত ছিলেন। মুজিববিরোধী অভ্যুত্থান ও কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ডের ওপর লন্ডন থেকে একটি বই প্রকাশ করার কারণে আমি ইতিমধ্যেই ‘কালো তালিকাভুক্ত’ হয়ে পড়েছিলাম। 
নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিচের প্রতিবেদনটি আমি ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে পাঠাতে সক্ষম হই। ঢাকার ডেটলাইনসহ এটি প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালের ১০ জুলাই: 
‘বিদ্রোহ চলাকালে যা ছড়ানো হয়েছিল, তার চেয়ে ভিন্নতর খবর এখন ঢাকায় পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, এ বিদ্রোহ মঞ্জুরের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা যথেষ্ট সন্দিহান। সেনাসূত্র অনুযায়ী, ৩০ মে জিয়া হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঢাকার সেনা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মঞ্জুর ফোন করে জানান যে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মোটেই জড়িত নন। সবকিছু ঘটেছে তাঁর অজ্ঞাতসারে। তাঁকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, চট্টগ্রামের ঘটনার ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পরে তিনি সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। 
‘বহু তথ্যের সত্যতা এখনো নিশ্চিত করা না গেলেও সেনাসূত্র দাবি করেছে, গৃহযুদ্ধ রোধে মঞ্জুর যে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রথম দিন বিকেলেই তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এরশাদের নির্দেশে ঢাকা রেডিও থেকে মঞ্জুরের বিরুদ্ধে এই মর্মে অবিরাম প্রচারণা চালানো হয় যে তিনি “খুনি” ও “বিশ্বাসঘাতক”। মঞ্জুর সে সময় মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানানো হয়েছে।...তিনি মনে করেছিলেন, ঢাকা গ্যারিসনে অবস্থানরত তাঁর শত্রুরা, বিশেষত এরশাদ ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল মহাব্বত জান চৌধুরী জিয়াউর রহমানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাঁকে খতম করে দেবে। 
‘...ব্যাপক ধোঁয়াশা সৃষ্টি হওয়ায় জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা মহিউদ্দীন আহমেদ সেনা হেফাজতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি খোলাসা করার জন্য ২১ জুন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ মৃত্যু সম্পর্কে সংবাদপত্রের কাছে বিবৃতি দিয়েছিল। সরকারি মুখপাত্রের দেওয়া বিবরণের সঙ্গে সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কর্তৃপক্ষের এমন স্ববিরোধী বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে মহিউদ্দীন আহমেদ দাবি করেন, বিচারের আগে মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যাকারী বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, তা তাঁকে জানাতে হবে।’ (‘কনফিউশন ওভার এ কিলিং’, লরেন্স লিফশুল্ৎজ্, ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ, ১০ জুলাই ১৯৮১)। 

মামলা 

১৯৯৫ সালে, হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর পর, মঞ্জুরের ভাই আবুল মনসুর আহমেদ জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর উত্তম মঞ্জুর হত্যা সংঘটনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। ইতিমধ্যে জেনারেল এরশাদের এক দশকব্যাপী সামরিক একনায়কত্বের অবসান ঘটেছে। ১৯৭১ সালে অন্য সামরিক কর্মকর্তারা যুদ্ধ করে জীবনদান করলেও এরশাদ সে সময় পাকিস্তানে ছিলেন। অবশেষে মঞ্জুরের ভাই প্রাণ আশঙ্কা থেকে মুক্তি পাওয়ায় নিরাপদে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা গেল। 
আর মঞ্জুরের ভাই মামলা দায়ের করার প্রায় দুই দশক পরে এখন ‘মঞ্জুর হত্যা মামলা’ সংবাদপত্রের শিরোনামে জায়গা করে নিচ্ছে। ১০ ফেব্রুয়ারি সেশন জজ হোসনে আরা আকতারের এই মামলার রায় ঘোষণা করার কথা ছিল। তাঁকে আকস্মিকভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন খন্দকার হাসান মাহমুদ ফিরোজ। এই হঠাৎ পরিবর্তনের রহস্য কী, তা কেউ জানে না। 
তবু সবাইকে আজ একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে। বিচারক হোসনে আরা আকতার ১০ ফেব্রুয়ারি রায় দিয়ে দিলেই কি ন্যায়বিচার সম্পন্ন হতো? ১৯ বছর ধরে চলা এই দীর্ঘ ও দুর্বল প্রসিকিউশনের পর এ গুরুতর সন্দেহের কারণ ঘটেছে যে বিচারিক আদালত যদি শেষ পদক্ষেপ নিয়ে রায় ঘোষণাও করতেন, তাহলেও তাঁর পক্ষে সত্যিই কোনো অর্থপূর্ণ রায় দেওয়া সম্ভব হতো কি না। এমনকি চূড়ান্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে বিচারপতির পক্ষে শেষ মুহূর্তে রায় প্রদান থেকে দূরে থাকারও সমূহ কারণ ছিল। 
২০১৩ সালের নভেম্বরে বিচারক হোসনে আর আকতার অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি আসাদুজ্জামান খানকে তাঁর প্রস্তুতিহীনতার জন্য প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন। আসাদুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীদের এই অযোগ্যতা কি শুধুই অযোগ্যতা, নাকি এ-ও কোনো পরিকল্পনা? আরেকজন সরকারি কৌঁসুলি আবুল কাশেম খান ২ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে ১৯৯৫ সালে এই মামলা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২২ বার এর বিচারক পরিবর্তন করা হয়েছে। 
সাধারণত এ ধরনের জটিল মামলায় একজন বিচারককেই সব জট খোলার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনিই একে নিশ্চয়তার সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। বিশ্বজুড়ে এটাই হচ্ছে সর্বোচ্চ মানদণ্ড। কিন্তু এই মামলাটি প্রমিত মানের ধারে-কাছে দিয়েও যায়নি। এই মামলাটিকে ভবঘুরে এতিমের মতো এক বিচারক থেকে আরেক বিচারক এবং এক কৌঁসুলির কাছ থেকে আরেক কৌঁসুলির কাছে পাঠানো হয়েছে। তার পরও এই মামলার গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে রয়েছে এর তাৎপর্য। 
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় মঞ্জুরের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে কি না, বিচারক খন্দকার ফিরোজের নিয়োগের মধ্য দিয়ে সেটি কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে পড়ল। এখানে উল্লেখ্য, কর্নেল তাহেরের পরিবার ন্যায়বিচার পেয়েছে ৩৫ বছর পর। মঞ্জুর ও তাহের উভয়েই বীর উত্তম খেতাবধারী—যা এরশাদ পাননি, জিয়া পেয়েছিলেন। তাঁরা দুজনই ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীনের সঙ্গে তাঁরা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে জিয়ার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময়টা এরশাদ কাটিয়ে দেন পাকিস্তানে বসে। জিয়া আর মঞ্জুর—এই দুজনের মৃত্যুর ঘটনাতেই এরশাদ ফেঁসে যেতে পারেন। 
জেনারেল এরশাদের আইনজীবী দাবি করেছেন, একজন সাক্ষীও এরশাদ বা তাঁর কোনো ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে মঞ্জুর হত্যা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে সাক্ষ্য দেননি। সে কারণে তাঁকে এই অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হোক যে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা, অনেকে যাকে বলে থাকেন পূর্বপরিকল্পিত ‘হত্যা’, তাতে তিনি একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। 
জেনারেল এরশাদ ‘সাধারণ সন্দেহভাজন’কে আটক করে আসল অপরাধীকে এড়িয়ে যাওয়ার সেই পুরোনো পুলিশি কৌশলের সুবিধাভোগী হয়েছেন। তবে এ দাবিও কেউ করতে পারবে না, কারণ গত ৩৩ বছরে একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিও মঞ্জুর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হননি। 
চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ১৯৮১ সালের ঘটনাপ্রবাহের ওপর একটি সুচিন্তিত বই লিখেছেন। ১৯৮১ সালের ১ জুন সংঘটিত মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডকে তিনি অভিহিত করেছেন চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘দ্বিতীয় খুন’ বলে। জিয়াউর রহমান ছিলেন ‘প্রথম’ খুনের শিকার। জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ভিন্ন ধাতুর মানুষ। তিনি গুরুতর প্রশ্ন তোলেন, আবার উত্তরের জন্য দুরূহ উপায় খোঁজেন। 
জিয়াউদ্দীনের ভাষ্য হচ্ছে, জিয়া ও মঞ্জুর উভয়েই খুন হয়েছেন। তিনি সেই বিরল ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, যিনি চট্টগ্রামের সেই নিয়তি-নির্ধারক দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সময় দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক অনুসন্ধান পরিচালনা করেছেন। তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন। জিয়াউর রহমান ও আবুল মঞ্জুর উভয়েরই পরিচিত হওয়ায় তাঁর অবস্থানটি ছিল অনন্য। 
২০০৯ সালে প্রকাশিত হলেও জিয়াউদ্দীন চৌধুরী সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করেছেন, সরকারি কৌঁসুলির কার্যালয় বা তদন্তকারীরা কেউই তাঁর দ্য অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড ইট্স্ আফটারম্যাথ বইয়ে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ সম্পর্কে তাঁর কাছে কিছু জানতে চাননি। 
একইভাবে কয়েক বছর আগে ঢাকায় মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আমার দুই দিন বসার সুযোগ হয়। আমরা দুজন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের সময়কার ঘটনাবলি মনে করার চেষ্টা করি। মেজর জেনারেল মইনের সঙ্গে আমার ৩০ বছরের জানাশোনা। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি লন্ডনে বাংলাদেশের মিলিটারি অ্যাটাশে হিসেবে কর্মরত ছিলেন। আমি তখন সাংবাদিকতা থেকে ছুটি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছি। তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, তাঁর কাজ ছিল আমার ওপর নজর রাখা। আমার তরফ থেকেও অনেকটা এ রকম ব্যাপার ছিল বলে আমি জানিয়েছিলাম। এ উদ্দেশ্যে আমরা ঘন ঘন নৈশভোজে মিলিত হতাম। 
এক দশক আগে জেনারেল মইন বাংলায় একটি বই প্রকাশ করেছিলেন, তার শিরোনাম ছিল এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক। ২০০৬ সালে যখন তাঁর সঙ্গে বসি, তাঁকে তখন বলেছি, তিনি যেন বইটির নির্দিষ্ট কিছু অংশের বিষয়বস্তু আমাকে বিশদভাবে জানান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি বাংলা পড়তে পারি না। এর পরের কয়েক বছর আমি ও মইন একে অপরের কাছ থেকে নানা কিছু জানার চেষ্টা করেছি। বইটির ইংরেজি তর্জমা কবে পাব, তা অনিশ্চিত হওয়ায় সেই দুই দিন চট্টগ্রামে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড-সংক্রান্ত ঘটনাবলির ওপর আমরা যতটা পারি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলেছি। 
আলোচনার নোটসমেত প্রস্থানের সময় মইন বললেন, তিনি বইটির একটি ইংরেজি তর্জমা করে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। ২০১০ সালে তাঁর অসময়োচিত মৃত্যুর আগেই বইটির ইংরেজি তর্জমা আমার হাতে এসে পৌঁছায়। দশমবারের মতো এই অনুবাদটি যখন আমি পড়ছি, তখন সেই সময়কার চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহের ওপর মইনের জ্ঞানের পরিধিকে বৃহত্তর পরিসরে জানানোর এক দায় বোধ করছি। ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখার এক অনুকূল অবস্থান তাঁর ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে তাঁর কর্মস্থল ছিল সেনাসদর। 
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর বইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত মঞ্জুর তাঁর দুই-তৃতীয়াংশ সময় ফোনে ঢাকায় কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। যাঁদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন, তাঁরা ছিলেন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। দৃশ্যপট থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ায় আমরা কখনোই জানতে পারব না যে তিনি কাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, কী বিষয়েই বা সমঝোতার চেষ্টা করছিলেন।’ 
তবে জিয়াউদ্দীনকে এ নিয়ে আর আক্ষেপ করতে হবে না। কারণ, আমরা এখন জানি, মঞ্জুর সেই চরম সময়ে সেনা সদর দপ্তরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেই ব্যক্তিটি ছিলেন মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী। মঞ্জুর তাঁকে বিশ্বাস করতেন। আর সেনাসদরে তখন মইনই ছিলেন একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা 

মইন ও মঞ্জুর একে অপরকে চিনতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। তাঁরা দুজনই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে সেটি একটি বিরাট ব্যাপার ছিল। তাঁরা যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে; আর জেনারেল এরশাদ ও জেনারেল মহাব্বত জান চৌধুরী ছিলেন সেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অংশ। তার পরও, পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং স্বাধীনতার প্রায় দশ বছর পর ‘বাংলার ভিচি’ এই রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রায় পুরোটাই দখল করে ফেলেন। পথের কাঁটা দূর করতে চূড়ান্ত নৃশংস হতেও তিনি কসুর করেননি। এই রূপান্তরের গল্প এক স্বতন্ত্র কাহিনি। 

আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় মইন স্পষ্টভাবেই বলেন, সেনাসদরে তিনিই সেই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, যাঁর সঙ্গে মঞ্জুর ফোনে আলাপ করেন। তাঁর আশা ছিল, চট্টগ্রামে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করা যাবে। এই ফোনালাপে মঞ্জুর পরিষ্কারভাবে জানান, জিয়া হত্যার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এসব আলাপচারিতা নিয়ে মইন তাঁর এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য বইটিতে বিস্তারিত লিখেছেন। 

যাঁদের অন্তর্দৃষ্টি আছে, তাঁদের কাছে মইনের এই বইটি তথ্যের এক আকর। বিশেষত জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড, জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা কীভাবে মঞ্জুরের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে কুৎসা রটিয়েছেন এবং জিয়া হত্যাকাণ্ডে তাঁকে মিছামিছি ফাঁসিয়েছেন, সে সম্বন্ধে এখানে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। 

জিয়া হত্যাকাণ্ড এবং এর সঙ্গে মঞ্জুরের অসম্পৃক্ততা—এই দুটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে মইন বিষয়গুলো খোলাসা করেছেন। এসব ঘটনার খুবই আগ্রহোদ্দীপক বিবরণ দিয়েছেন মইন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, তিনি দেখিয়েছেন কী কারণে অভিযোগকারীরা মঞ্জুরকে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাঁকে হত্যা করে। জিয়া হত্যাকাণ্ডের ১২ ঘণ্টা পরে তাঁরা হঠাৎ করে এ কাজ শুরু করেননি। তাঁরা সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যাচার শুরু করেন। 

চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন চৌধুরী বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম প্রথম ব্যক্তি, যিনি সার্কিট হাউসে গিয়ে জিয়ার মৃতদেহ দেখেন। পরবর্তী কয়েকটা দিন তিনি শুধু ভাবেন কে, কাকে, কেন এবং কী করল। তবে সদুত্তর পেতে পেতে সপ্তাহ এমনকি মাসও পেরিয়ে যায়। অবশেষে সেনাবাহিনীর প্রকাশিত ‘দাপ্তরিক প্রতিবেদন’ নিয়ে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। 

তার পরও, জিয়া হত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর সেনাসদরে এরশাদ মইনের সঙ্গে এই মর্মে তর্ক করেন যে সেখান থেকে কয়েক শ মাইল দূরে চট্টগ্রামে কী ঘটেছে তিনি তা জানেন। তাঁদের তর্কযুদ্ধের বিবরণ মইন তাঁর বইয়ে দিয়েছেন: 

‘৩০ মে জিয়া হত্যার পর সেনাসদরে আমার সঙ্গে মঞ্জুরের ফোনে কথোপকথন থেকে আমি বুঝতে পারি, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই অধিনায়ক হিসেবে তাঁকে এই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছিল। আমার এই ধারণা আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধান এরশাদসহ আমার অন্য সহকর্মী, পিএসওদের সামনে ব্যক্ত করি। কিন্তু তাঁরা বিভিন্নভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বেই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। 

‘এ ছাড়া বেশ তড়িঘড়ি করেই ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মঞ্জুরকে জড়িত করে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচারণা শুরু হয়ে যায়। যদিও আমি মত প্রকাশ করি যে কোনো প্রকার খোঁজখবর না করেই রেডিও-টিভিতে এ রকম প্রচারণা ঠিক নয়।’ 

ওপরের উদ্ধৃতিটি ‘মঞ্জুর জিয়া হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন না’ শীর্ষক অধ্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে। এই অধ্যায়ের শেষে মইন ইঙ্গিত করেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে পুরো ব্যাপারটাই মঞ্জুরকে সরানোর জন্য সাজানো হয়েছিল। অধ্যায়ের শেষে মইন বলেন, ‘মূলত জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে ক্ষমতালোভী, উচ্চাভিলাষী, ষড়যন্ত্রকারী ও কিছু অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে। এটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের ফল।’ 

হ্যাঁ, মইন বুঝতে পেরেছিলেন, এটি ছিল একটি ‘সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র’। এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা দ্রুত তাঁদের ‘মিথ্যা আখ্যান’ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটি ছিল সেই ষড়যন্ত্রের একটি বিশেষ দিক। 



{লরেন্স লিফশুলৎজ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ (হংকং)-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন; তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ: দি আনফিনিশ্ড্ রেভল্যুশন, হিরোশিমা’জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া?} 

সাক্ষীর নিরাপত্তা 

আদালত ও প্রসিকিউশনের কাছে আমি কিছু প্রস্তাব রাখছি। ২০ জানুয়ারি ২০১৪ ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন সিরীয় ‘পক্ষত্যাগকারী’ অনেক-গুলো ফ্ল্যাশ ড্রাইভসহ দেশ ত্যাগ করেছেন। সেগুলোতে ৫৫ হাজারটি ডিজিটাল ইমেজ ছিল। সেগুলো তাঁর ও অন্যান্য সরকারি আলোকচিত্রীর তোলা ১১ হাজার বন্দীর ওপর পরিচালিত অমানুষিক নির্যাতনের ছবি। পরে ওই বন্দীদের সবাইকে হত্যা করা হয়। ওই ব্যক্তি সিরিয়ার মিলিটারি পুলিশের আলোকচিত্রী ছিলেন। তাঁর কাজ ছিল প্রত্যেক বন্দীর জন্য প্রয়োজনীয় ছবির দলিল প্রস্তুত করা। 
সিয়েরা লিয়ন ও সাবেক যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধের মামলায় জাতিসংঘের প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী তিনজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী এই সোর্সকে তিনটি পর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাঁরা তাঁর বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পান। তাঁর বিবরণ ছিল ‘অসম্ভব হূদয়গ্রাহী’। (http://www.theguardian.com /world/2014/jan/20/evidenceindustrial-scale-killing-syria-war-crimes)। 
সেই সিরীয় পক্ষত্যাগকারীর সাক্ষ্য নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৩১ পাতার একটি প্রতিবেদন পেশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনটির এখন সিরীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার মূল ভিত্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেই ব্যক্তির সাক্ষ্য রেকর্ড ও নিরীক্ষা করার সময় তাঁর পরিচয় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপন রাখা হয়। 
এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে স্পষ্টতই পার্থক্য অনেক। তবে আমার পরামর্শ হচ্ছে, মঞ্জুর হত্যা মামলায়ও আমার সোর্সের পরিচয় গোপন রাখার জন্য একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। এই সোর্স তাঁর চেনা একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে মঞ্জুরের বন্দিশালায় প্রবেশ করতে দেখেছেন, যিনি তাড়াহুড়ো করে সে কক্ষ ত্যাগ করার আগে মঞ্জুরকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। 
জেনারেল মইনের দৃষ্টিকোণ 
জেনারেল মইনের সঙ্গে এ বিষয়টা নিয়ে আমি আলোচনা করি। আমার সোর্সের বিবরণ সম্পর্কে তাঁর মতামত প্রয়োজন ছিল। আমার সোর্সের পরিচয় আমি প্রকাশ করিনি কিংবা কী কারণে সেদিন তিনি ক্যান্টনমেন্টে ঢুকেছিলেন, তাও উল্লেখ করিনি। মইন আমার এ ইচ্ছার তাৎপর্য যথাযথভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। তবে মইন গোপনীয়তা রক্ষা করতে সম্মত হলে, মঞ্জুরকে বন্দী করে রাখা কক্ষটিতে সেদিন যে কথিত সামরিক কর্মকর্তা প্রবেশ করার পর তাঁকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়, তাঁর নাম আমি তাঁকে জানাই। 
এই কর্মকর্তাটি সম্পর্কে আমি মইনের মতামত জানতে চাই। আমি এও জানতে চাই, এরশাদের অজ্ঞাতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করা আদৌ সম্ভবপর কি না। মঞ্জুরকে যে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়েছিল, মইন সেটি জানতেন। তবে পিস্তলের ট্রিগারটা ঠিক কে চেপেছিলেন, সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। 
আমি যে কর্মকর্তার নাম বলেছিলাম, মইন তাঁকে চিনতেন। মইন জানান, সেই কর্মকর্তা, সে সময়ে একজন মেজর জেনারেল ছিলেন, সম্ভবত এরশাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর। তাঁকে নির্বাচন করাটাই ছিল যুক্তিগ্রাহ্য। এই ব্যক্তিকে যদি আমার সোর্স চট্টগ্রামে মঞ্জুরের সেলে প্রবেশ করতে দেখে থাকেন, তাহলে এরশাদ যদি সরাসরি হত্যার নির্দেশ নাও দিয়ে থাকেন, অন্তত তাঁর সবকিছু জানা থাকার কথা। 
আমরা উভয়েই এই বিষয়ে একমত হই যে শুধু একটি সফল তদন্ত ও বিচারিক-প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সত্য বেরিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশে কি এটা সম্ভব? 
এসব সাক্ষীসাবুদ খতিয়ে দেখার পর তিন বছর পর ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর বই দি অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড ইট্স্ আফটারম্যাথ। মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। 
জিয়াউদ্দীনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭০ সালে, ঢাকায় আমাদের এক অভিন্ন বন্ধুর বাড়িতে। কিন্তু দিন কয়েক আগে বইটি নিয়ে আলোচনার জন্য যোগাযোগ করা পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাঁর বইয়ে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের ওপর যে অধ্যায়টি আছে, সেটি আমার ও মইনের সংগৃহীত তথ্যের সঙ্গে মিলে যায়; সেটি আমাদের গবেষণাকে সম্পূর্ণতা দিয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, মঞ্জুরের বিয়োগান্ত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে যে তথ্যাদি আমাদের হাতে রয়েছে, সেসবের সঙ্গে জিয়াউদ্দীনের কথা খাপ খেয়ে যায়। যদিও তাঁর আর আমার সোর্স কিন্তু ভিন্ন। ফলে একই ঘটনার ওপর আমরা দুজন ভিন্ন ব্যক্তির বিবরণ পেলাম। 

জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর ভাষ্য হলো: 

‘সামরিক বাহিনীর সেই ডাক্তারের কাছ থেকে আমি মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী ঘটনাবলি সম্পর্কে জানতে পাই, যিনি দিন দুয়েক আগে জিয়ার মৃতদেহ প্রস্তুত করেছেন। মর্মান্তিক বিষয় হলো, এই চিকিৎসকই দাফনের আগে মঞ্জুরের মৃতদেহ প্রস্তুত (ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া) করেছেন। 
‘মঞ্জুরকে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পর একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা (ব্রিগেডিয়ার) সেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেই কর্মকর্তার একটিই উদ্দেশ্য ছিল, মঞ্জুরকে খতম করা। তাঁকে নাকি ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছিল। কর্তব্যরত সেনা-কর্মকর্তাকে তিনি বলেন, মঞ্জুরকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এসেছেন। এরপর তিনি সেলে প্রবেশ করেন, পিস্তল বের করে মঞ্জুরকে গুলি করেন, তারপর বেরিয়ে আসেন। সবকিছু পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। মঞ্জুরকে আমি চিনতাম। তাঁর মতো বুদ্ধিমান, ঠান্ডা মাথা ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এ রকম হীন ষড়যন্ত্র করা সম্ভব বলে আমার মনে হয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, মৃতেরা কথা বলতে পারে না। মঞ্জুরের কথা শোনার জন্যও আমরা তাঁকে আর পাব না।’ 
এই অনুচ্ছেদগুলো পড়ার পর আমি জিয়াউদ্দীন চৌধুরীকে ফোন করি। আমরা কিছুক্ষণ কথা বলি। আমি জানতে চাই, তাঁর সোর্স সুনিশ্চিত কি না যে সেই কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ছিলেন, নাকি মেজর জেনারেল—মইনকে নামটা বলার পর যেমনটা তিনি বলেছিলেন (জিয়াকে আমি সেই কর্মকর্তার নামটা বলিনি)। জিয়াউদ্দীন বলেন, সামরিক ডাক্তার সেই ব্যক্তির নাম ও পদবি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন কি না, সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। ডাক্তার ভদ্রলোক শুধু জানতেন, ঢাকা থেকে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসে সেনা হেফাজতে থাকা জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করেছেন। 
জেনারেল আবুল মঞ্জুরকে কে বা কারা কেন হত্যা করেছে, আলাদা আলাদাভাবে কাজ করলেও চারজন ব্যক্তি সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন বলে আমি মনে করি। যদিও শেষ পর্যায়ের কাজে এসে তাঁদের মধ্যে যোগ ঘটেছে। এই চার ব্যক্তি হচ্ছেন মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের সময় যিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল ছিলেন; চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন চৌধুরী; আমার সেই বিশ্বস্ত সোর্স যিনি দাবি করেন, ঢাকা থেকে তাঁর পরিচিত এক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে এসে মঞ্জুরের কক্ষে প্রবেশ করেন এবং তার কিছুক্ষণ পরই মঞ্জুরের মৃত্যু হয়; আর ১৯৮১ সালে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের খবর সংগ্রহ করা একমাত্র বিদেশি সাংবাদিক, আমি। 
চাক্ষুষ সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণের পরও এখন পর্যন্ত আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করতে পারিনি কিংবা এ কর্মকাণ্ডের পেছনে কোনো প্রতিষ্ঠান কলকাঠি নেড়েছে কি না, তাও স্পষ্ট করে জানা সম্ভব হয়নি। এবার আমরা অন্তত এমন একটি শক্ত ভিত্তি প্রস্তুত করতে পেরেছি, যার ওপর এই মামলার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ফৌজদারি তদন্ত সম্পন্ন হতে পারে। গত ৩০ বছরে তো এই মামলার জন্য এ রকম কোনো তদন্তও হয়নি। 

সদরউদ্দীনের সাক্ষ্য: ‘আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন’ 

এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন জেনারেল এরশাদকে বললেন, ‘আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন। এটা কিন্তু ভালো করলেন না।’ ২ জুন ১৯৮১ 

এই লেখাটি ছাপাখানায় যাওয়ার আগে আগে প্রথম আলোর এক কর্মী আমাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নথির সন্ধান দেন। সেটি হচ্ছে এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীনের ভাষ্য। সিআইডির একদল তদন্ত কর্মকর্তার সামনে তিনি এ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। 
তিনি এ সাক্ষ্য দেন ১৯৯৫ সালের ২৫ মার্চ। মঞ্জুরের বড় ভাই আবুল মনসুর জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে তাঁর ভাইকে হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করায় তাঁর এই সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তিনি এতে বলেন, ২ জুন ১৯৮১ মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে এরশাদের মুখোমুখি হয়ে কীভাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন। এটা কিন্তু ভালো করলেন না।’ হত্যার কিছু সময় আগেই মঞ্জুরকে পুলিশ হেফাজত থেকে সেনা-হেফাজতে নিয়ে নেওয়া হয়। 
এয়ার মার্শাল সদরউদ্দীন ও পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল এ বি এম জি কিবরিয়ার মনে এই শঙ্কা ছিল যে মঞ্জুর খুন হতে পারেন। মঞ্জুরের খুনের এক দিন আগে, ১ জুন ১৯৮১, তাঁরা উভয়েই রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে বলেন, মঞ্জুরকে সেনা-হেফাজতে নিয়ে আসার জন্য এরশাদ যে দাবিটি করছেন, তা যেন তিনি মেনে না নেন। মঞ্জুর চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। 
সদরউদ্দীন ও কিবরিয়া মঞ্জুরকে নিরাপদে পুলিশের হেফাজতে রাখার জন্য সাত্তারের কাছে আবেদন করেন। সেনাবাহিনী হাটহাজারী থানায় অবস্থান নিয়ে মঞ্জুরকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে তাঁদের মনে এই ভয় ছিল যে সাত্তার এরশাদের আবেদনে সাড়া দিলে মঞ্জুরের বিপদ ঘটবে। 
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন ১৯৮১ সালের বসন্ত পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর সাক্ষ্যে দেখা যায়, তিনি কীভাবে জিয়ার নিয়তিনির্ধারক যাত্রার সময় চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে যান জিয়াকে বরণ করার জন্য। এরপর ২৯ মে যশোরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম ত্যাগ করার আগে সেখানকার বিমানঘাঁটি পরিদর্শন করেন। 
পরদিন, ৩০ মে ১৯৮১, সকাল সাতটায় এরশাদ সদরউদ্দীনকে ফোন করে জানান যে জিয়া গত রাতে চট্টগ্রামে খুন হয়েছেন। এরশাদ তাঁকে অনতিবিলম্বে ঢাকায় আসতে বলেন। তিনি ঢাকায় পৌঁছান তিন ঘণ্টা পর। 
সদরউদ্দীন তাঁর সাক্ষ্যে শুধু উত্তম বিচারবোধেরই পরিচয় দেননি, সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যকার চলমান মরণপণ দ্বন্দ্বের ব্যাপারেও সজাগ ছিলেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন, কী ঘটে চলেছে। তিনি একজন বুদ্ধিদীপ্ত লোক ছিলেন, বোকা ছিলেন না। 
জেনারেল এরশাদ ও অন্যদের সঙ্গে ৩০ মে ও ১ জুন তাঁর সাক্ষাতের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে এটা স্পষ্ট যে সত্যিকার অভ্যুত্থানটি চট্টগ্রামে ঘটেনি, ঘটেছে ঢাকায়। যশোর থেকে ফিরে তিনি সরাসরি জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। 

সদরউদ্দীন তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন: 

‘[৩০ মে ১৯৮১] আমি তাঁর অফিসে গিয়ে বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন আর্মি অফিসারকে দেখি। তাঁদের মধ্যে মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর জেনারেল মান্নাফ, মেজর জেনারেল নূরউদ্দীনসহ অন্যান্য আরও কিছু আর্মি অফিসারকে দেখি। সেখানে তাঁরা চিটাগাংয়ে প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। জেনারেল এরশাদ আমাকে ঘটনা দ্রুত জানালেন। আমি সেখানে আনুমানিক ২০ মিনিট ছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথে মেজর জেনারেল শওকত ও মেজর জেনারেল মইন আমার পেছনে পেছনে আসেন। আসার পথে করিডরে তাঁরা আমাকে বলেন যে এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে। মেজর জেনারেল শওকত আরও বলেন, আমার মনে হয় না মঞ্জুর এটা করতে পারে (আই ডোন্ট থিংক মঞ্জুর কুড হ্যাভ ডান ইট।)’ এর উত্তরে আমি কিছুই বলিনি।... 
‘১ জুন ১৯৮১ তারিখ বিকেল আনুমানিক সাড়ে পাঁচটার সময় আমি বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির অফিসে ছিলাম। তখন সেখানে লে. জেনারেল এরশাদও ছিলেন। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এই সময় টেলিফোন আসে। প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট টেলিফোন রেখে জানান, আইজিপি কিবরিয়া জানিয়েছেন যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং অন্যরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। 
‘সংবাদটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে জেনারেল এরশাদ উত্তেজিত অবস্থায় চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। আর কিছু না বলে সরাসরি প্রেসিডেন্টের পাশে রেড টেলিফোনের কাছে যান এবং একটি নম্বরে ডায়াল করেন। টেলিফোনে তাঁর যে কথাটি শুনতে পেলাম তা হলো, ‘মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করেছে। এক্ষুনি তাঁকে নিয়ে নেওয়া উচিত। তারপর সেই পরিকল্পনামতো এগোও (‘মঞ্জুর হ্যাজ বিন ক্যাপচার্ড্ বাই দ্য পুলিশ। হি শুড বি ইমিডিয়েটলি টেইকেন ওভার অ্যান্ড ক্যারি আউট দ্যাট প্ল্যান।)’ বলেই তিনি টেলিফোন রেখে দেন। তখন আমি বলি, ‘জেনারেল এরশাদ, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন, আমি কি জানতে পারি (হোয়াট ইজ দ্যাট প্ল্যান ইউ আর টকিং অ্যাবাউট, মে উই নো)?’ এতে তিনি আবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এয়ার চিফ, আপনি কিছুই বোঝেন না।’ আমি বলি, ‘আমি কী বুঝি না-বুঝি, আপনার কাছ থেকে জানতে হবে না (আই ডোন্ট হ্যাভ টু নো ফ্রম ইউ)।’ পরে আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে বলি, ‘স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয় আর তিনি ন্যায্যবিচার পান। মঞ্জুরের কিছু হলে জাতির কাছে আপনাকে জবাব দিতে হবে (প্লিজ মেইক শিওর দ্যাট নাথিং হ্যাপেনস টু মঞ্জুর অ্যান্ড হি ইজ গিভেন আ ট্রায়াল। ইফ অ্যানিথিং হ্যাপেনস টু মঞ্জুর, ইউ উইল বি অ্যানসারেবল টু দ্য নেশন।)’ এর উত্তরে সাত্তার সাহেব বিচার করা হবে বলে জানান। 
‘সন্ধ্যার পর আইজিপি কিবরিয়া অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের অফিসে আসেন। আসার পরপর আর্মি চিফের সঙ্গে জেনারেল মঞ্জুরসহ গ্রেপ্তারকৃত অন্যদের সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে বাদানুবাদ হয়। আইজিপি কিবরিয়া সাহেব বারবারই গ্রেপ্তারকৃতদের বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে রাখার বিষয়ে চাপ দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে জেনারেল এরশাদ গ্রেপ্তারকৃতদের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের চাপ দিচ্ছিলেন। অবশেষে দীর্ঘ বাদানুবাদের পর আর্মি চিফের পরামর্শে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং গ্রেপ্তারকৃত অন্যদের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত দেন। এর পরপরই আর্মি চিফ কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যান এবং ফেরত আসেন। এরপর আমি চলে আসি। 
‘২ জুন ১৯৮১ তারিখ ভোররাত্রি আনুমানিক দেড়টা-দুইটার দিকে উইং কমান্ডার কামাল, ডিরেক্টর, এয়ার ইন্টেলিজেন্স, টেলিফোনে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যার খবর দেন। আমি সকাল আনুমানিক ছয়টা-সাতটার সময় এরশাদ সাহেবকে টেলিফোনে বলি, এরশাদ সাহেব, আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন। এটা কিন্তু ভালো করলেন না।’ 
(টীকা: বাংলা শ্রুতিলিখনে এরশাদের উত্তর ঠিক পরিষ্কার নয়। এতে কিছু ইংরেজি শব্দ আছে, যার অর্থ অস্পষ্ট। মনে হচ্ছে, এরশাদ বলছিলেন, ‘কিছু সৈন্য...মঞ্জুরকে হত্যা করেছে।’ সদরউদ্দীনের উত্তর অবশ্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ‘আমি একটু অবিশ্বাসের সুরে বললাম, অন্য কাউকে বলেন, আমাকে বিশ্বাস করতে বলবেন না।’) 

এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীনের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যটিতে ছয়টা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এ রকম: 

১. সদরউদ্দীন ঢাকায় আসার পর মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী ও মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁকে বলেন, জিয়া হত্যায় ‘মঞ্জুরকে ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে’। 

২. মঞ্জুর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন শোনার পর এরশাদ তৎক্ষণাৎ একজন অজানা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীকে লাল টেলিফোনে মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে আনার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর অন্য আরেকটি কথার পরিপ্রেক্ষিতে সেই ব্যক্তিকে তিনি ‘পরিকল্পনামতো’ এগোনোর নির্দেশ দেন। 
৩. সদরউদ্দীন ও এরশাদের মধ্যে বিতর্ক হয়। সদরউদ্দীন এরশাদকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন, আমরা কি জানতে পারি?’ 
৪. পুলিশের আইজি কিবরিয়া ও এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন উভয়েরই শঙ্কা ছিল যে মঞ্জুরকে পুলিশের হাত থেকে সেনা হেফাজতে নিয়ে আসা হলে তাঁর কোনো বিপদ হবে। 
৫. এরশাদ যখন ১ জুন বিকেলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নিয়ে আসার জন্য দরবার করছিলেন, তখন সদরউদ্দীন স্পষ্টতই মঞ্জুরের জীবননাশের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সাত্তারকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘মঞ্জুরের কিছু হলে’ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে জাতির কাছে ‘জবাব দিতে হবে’। সদরউদ্দীনের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে সে রাতেই চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে সামরিক কর্মকর্তাদের জিম্মায় থাকা অবস্থায় মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ উঠেছে যে ঢাকা থেকে পাঠানো একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা চট্টগ্রাম গিয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করেছেন। 
৬. পরদিন সকালে এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন এরশাদকে অভিযুক্ত করে বলেন, ‘আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন।’ তিনি বলেন, ‘না।’ শ্রুতিলিখনের এ জায়গাটা পরিষ্কার করে বোঝা যায় না। তবে এরশাদ সম্ভবত বলেন, ‘কিছু সৈন্য...তাকে হত্যা করেছে।’ (শ্রুতিলিখনের এ জায়গাটা যিনি কম্পোজ করেছেন, তাঁর ইংরেজি দুর্বল ও অবোধ্য)। সদরউদ্দীন অবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, ‘অন্য কাউকে বলেন, আমাকে বিশ্বাস করতে বলবেন না।’ (চলবে) 

লরেন্স লিফশুলৎজ 
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর (হংকং) দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ: দি আনফিনিশ্ড্ রেভল্যুশন, হিরোশিমা’জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া? 
OpenDoor.Lifschultz@gmail.com 

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন 
গোপনীয় 
বিএ ১০৩ মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুরের (সাবেক জিওসি, ২৪ পদাতিক ডিভিশন, চট্টগ্রাম সেনানিবাস) ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। 

লাশ শনাক্ত করেন: ইবিআরসির বিএসএস ৫৪২ লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুর রহমান, পিএসসি। 

মৃত্যুর সময়: ১৯৮১ সালের ১ জুন আনুমানিক রাত ১১:৩০ মিনিট 

ময়নাতদন্ত পরীক্ষার সময়: ১৯৮১ সালের ২ জুন সকাল ৭:৩০ মিনিট 

সংক্ষিপ্ত বিবরণ: 
মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুরের মরদেহ চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয় ১৯৮১ সালের ২ জুন রাত প্রায় চারটায়। আর কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। 

শরীরের বাইরের অংশের পরীক্ষা: 
লাশ শক্ত হয়ে ছিল। মস্তিষ্কের অক্সিপিটাল অঞ্চলের ডান দিকের প্রান্তে ৪ ইঞ্চি * ২ ইঞ্চি গভীর একটি বড় ক্ষত ছিল। গুলির আঘাতে হাড় ভেঙে সম্পূর্ণ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। হাড়ের বড় একটি অংশ উড়ে যায় এবং সেই ফাঁক দিয়ে মস্তিষ্কের ভেতরের পদার্থ বেরিয়ে পড়ে। শরীরে আর কোনো আঘাত ছিল না। 

শরীরের অভ্যন্তরীণ অংশের পরীক্ষা: 
সম্পন্ন করা হয়নি যেহেতু মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট। 

মৃত্যুর কারণ: 
মাথায় গুলির আঘাতে প্রচণ্ড শক ও ব্যাপক রক্তক্ষরণ। 

চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) 
তারিখ: ২ জুন ১৯৮১ 


স্বাক্ষর 

লেফটেন্যান্ট কর্নেল 
গ্রেডেড স্পেশালিস্ট, প্যাথলজি 
(এ জেড তোফায়েল আহমেদ 


পরবর্তী কয়েক বছরে এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা ‘বিক্ষুব্ধ সেনা’, ‘উত্তেজিত জনতা’ এবং ‘বিক্ষুব্ধ মানুষের’ হাতে মঞ্জুর হত্যার অনেক কাহিনি ফেঁদেছেন। 
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে বার্তা সংস্থা বিডিনিউজ-২৪ এই মামলার হাজিরায় এরশাদের এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, ‘চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পর উত্তেজিত জনতা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এই টানাহ্যাঁচড়ার মধ্যে নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুর গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।’ 
এরশাদের এক সহকর্মী মোস্তফা—লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামাল ২০১৩ সালে আদালতে বলেছিলেন, ‘কিছু বিক্ষুব্ধ মানুষ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে মঞ্জুরকে নেওয়ার পথে তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এতে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে মঞ্জুরের গায়ে বুলেট বিঁধে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।’ 
এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা যে গল্প ফেঁদেছেন এবং ৩০ বছর ধরে ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজিয়ে চলেছেন, তার প্রধান দুর্বলতা হলো বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। সে সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন বা এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা কেউই কখনো বলেননি যে তাঁরা ‘বিক্ষুব্ধ মানুষ’ বা ‘বিক্ষুব্ধ অস্ত্রধারী’ ব্যক্তিদের দেখেছেন, যাঁরা মঞ্জুরকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে গোলাগুলি হয়; আর মঞ্জুর এই ‘টানাহ্যাঁচড়া’র কারণে গুলিবিদ্ধ হন। কেউ কেউ বলেছেন, মঞ্জুরের ‘নিরাপত্তারক্ষীরা’ গুলি করেছিল; আর কেউ বলেছেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পথে মঞ্জুর মারা যান।’ কিন্তু কোনো হাসপাতালেই মঞ্জুরকে সেদিন জীবিত বা মৃত বা আহত অবস্থায় দেখা যায়নি। কেবল একজন সেনা চিকিৎসক তাঁকে দেখেছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ব্রিগেডিয়ার আজিজ, ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে তখন ছিলেন তিনি, দাফনের জন্য মরদেহ প্রস্তুত করাতে তাঁকে মঞ্জুরের ‘ক্ষত ব্যান্ডেজ’ করে দিতে বলেন। 
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর বইয়ে ফটিকছড়িতে মঞ্জুরের শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং তাঁর গতিবিধির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর বিবরণ বা চট্টগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীদের কারও কথার সঙ্গেই এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের গল্পের ন্যূনতম কোনো মিল নেই। চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক হিসেবে জিয়াউদ্দীন চৌধুরী ১ জুন মঞ্জুরের গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে হাটহাজারী থানায় সেনাবাহিনীর হাতে তাঁকে সোপর্দ করা পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি মঞ্জুর নিরাপদে ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছালেন কি না, সেটিও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ারের কাছ থেকে তিনি শুনে নিশ্চিত হয়েছেন। 
জিয়াউদ্দীন চৌধুরীর ভাষ্যের সঙ্গে এরশাদের ভাষ্যের তুলনা করা যাক: 
‘মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পরদিন সরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মঞ্জুর মৃত্যুবরণ করেছেন। এই প্রতিবেদন ছিল একটি ডাহা মিথ্যা। 
‘ক্যান্টনমেন্টে নেওয়ার পথে মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়নি। ব্রিগেডিয়ার আজিজ পুলিশের ডিআইজিকে বলেছিলেন, ২ জুন সকালবেলা মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। আজিজ এ কথা বলেননি যে মঞ্জুর বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের হাতে মারা পড়েছেন... 
‘চিকিৎসককে যখন মঞ্জুরের “ক্ষত ব্যান্ডেজ” করতে বলা হয়, তখন তিনি দেখতে পেলেন, একটিমাত্র গুলির আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। গুলিটি তাঁর মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর জন্য একঝাঁক বুলেট দরকার হয়নি...ঢাকা থেকে আসা এক সেনা কর্মকর্তা মঞ্জুুরকে হত্যা করেন, বিক্ষুব্ধ সৈন্যরা নয়। তাঁকে কেন হত্যা করা হবে? কেন বিচারের মুখোমুখি করা হবে না? তিনি কি এমন কিছু জানতেন, সেনাবাহিনী যা প্রকাশিত হতে দিতে চায়নি?’ 
এ ধরনের মিথ্যা ও প্রচ্ছদকাহিনির সমস্যা হচ্ছে, এর প্রণেতারা অনেক সময় নিজেদের লেখা চিত্রনাট্য নিজেরাই ভুলে যান। নিজেদের গা বাঁচাতে ‘বিক্ষুব্ধ সৈন্য’দের হাতে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের যেসব গল্প এরশাদ ও তাঁর সহযোগীরা ফেঁদেছেন, তার প্রতিটিতে বলা হয়েছে যে পুলিশ তাঁকে সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করার পর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ‘নেওয়ার পথে’ তাঁকে হত্যা করা হয়। 
তার পরও, সিআইডির কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে পুলিশের আইজি এ বি এম জি কিবরিয়া জানিয়েছেন, তিনি এরশাদকে সরাসরি প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আনার পরই মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়।’ 
কিবরিয়া এর আগের দিনই মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে সেনা হেফাজতে আনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এরশাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়? 
সাক্ষ্যে কিবরিয়া বলেন, ‘২ জুন বিকেলবেলা বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আমি চিফ অব আর্মি স্টাফের কাছে জানতে চাই, মঞ্জুরকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে? আদতে তো তাঁর প্ররোচনায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে নেওয়ার নির্দেশ দেন, যাঁদের হাতে—এক অর্থে তাঁরই হেফাজতে—মঞ্জুরের মৃত্যু হলো। এরশাদের জবাব ছিল, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পরপরই বিক্ষুব্ধ সেনাদের গুলিবর্ষণে মঞ্জুর নিহত হন। এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো কিবরিয়াও এরশাদের ‘বিক্ষুব্ধ সেনা’দের হাতে মঞ্জুর হত্যার গল্প বিশ্বাস করেননি।
কিবরিয়া তাঁর সাক্ষ্যে এরশাদের নিজের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই বলেছেন যে মঞ্জুরকে ‘ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পথে’ হত্যা করা হয়নি। এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য। এরশাদের স্বীকারোক্তির পর কিবরিয়া কীভাবে ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা-ও তিনি বলেছেন। প্রথমে একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি চট্টগ্রামে পাঠান। পরে নিজেই সেখানে যান। চট্টগ্রামে অবস্থিত তাঁর সহকর্মীদের তিনি বঙ্গভবনের বৈঠকের কথা জানিয়ে পুলিশ হেফাজতে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে এই শঙ্কা প্রকাশ করেন যে সেনাবাহিনী হয়তো এদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে। 
কিবরিয়া ব্যাখ্যা করেন, মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের পর ‘বেসামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এরশাদের দাবি অগ্রাহ্য করে’ তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে তিনি কীভাবে প্রভাবিত করেন। স্পষ্টভাবেই তাঁর মনে ভয় ছিল, সেনা হেফাজতে নিয়ে গেলে এদেরও মঞ্জুরের ভাগ্য বরণ করতে হবে। 
সত্যিই তাই। পরের কয়েক মাসে বহু সেনা কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে এনে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত ফিল্ড কোর্ট মার্শালে তাঁদের বিচার করা হয়। ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৩ জনকে। তৎকালীন অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর ভাষ্যমতে, এই হতভাগারা নিরপেক্ষ বিচার ও যথাযথ আইনি সুরক্ষা পাননি, যা ছিল তাঁদের মৌলিক অধিকার। আগেই বলেছি, জুলফিকার আলী মানিক তাঁর সেই সাহসী বইয়ে এসব কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। 
নোংরা সত্যটি হচ্ছে এই যে ওই মানুষগুলোকে এমন এক ‘অভ্যুত্থানের’ অভিযোগে বিচার করা হয়, যেটি আদতে কোনো ‘অভ্যুত্থান’ ছিল না বা সেই বিদ্রোহ কোনো দিন সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু জিয়া আবুল মঞ্জুরের হাতে নিহত হননি; কিংবা যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে, তাঁদের হাতেও নন। 
সেনাবাহিনীতে এরশাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার অভিপ্রায়ে তাঁদের ভিত্তিহীন ও নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ দিতে হয়। বলির পাঁঠা বানানোর জন্য এরশাদের দরকার ছিল একটি ‘অপরাধী চক্র’। 
জেনারেল মইন ও জুলফিকার আলী মানিক তাঁদের বইয়ে জানিয়েছেন, এরশাদ নির্যাতন করে ‘স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন, কিন্তু তথাকথিত বিচারটি চলেছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, কোনো তদন্ত ছাড়াই। মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর নির্দেশে বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়াটি পরিচালিত হয়। 
খালেদা জিয়া কি সত্যি সত্যিই এরশাদকে তাঁর স্বামী হত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন? প্রকৃত ‘অভ্যুত্থান’ তাহলে ঢাকাতেই হয়েছে, চট্টগ্রামে নয়। 
লেখাটি ছাপাখানায় যাওয়ার পর প্রথম আলোর হাতে থাকা কিছু দলিল আমার হাতে এসেছে। দলিলগুলো হচ্ছে ১৯৮১ সালের মে-জুন মাসের সেই নিয়তি-নির্ধারক দিনগুলোতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য চট্টগ্রামে ছিলেন, সিআইডির কাছে দেওয়া তাঁদের সাক্ষ্য। এসব সাক্ষ্য আমাদের সামনে কিছু নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই লেখা শেষ হওয়ার পর একটি উপসংহার পর্বে সেগুলো নিয়ে আমি আলোচনা করব। 

হত্যা মামলা 
এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ কী অগ্রাহ্য করা হবে? বিচারপতি কি আমার সোর্সের চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে, নতুন এই প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য না নিয়ে তাঁর রায় ঘোষণা করবেন? যে মানুষটি বললেন, তিনি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে উপস্থিত ছিলেন, একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে মঞ্জুরের সেলে ঢুকতে দেখেছেন, আর সেখানেই নাকি মঞ্জুর খুন হন—তাঁর সাক্ষ্য কি উপেক্ষা করা হবে? 
বিচারপতি ফিরোজ বা কোনো উচ্চ আদালত কি এই সাক্ষীর নিরাপদে সাক্ষ্য দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করবেন? এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীন, আইজিপি কিবরিয়া এবং অন্যদের দশক দশক ধরে চাপা পড়ে থাকা সাক্ষ্য কি শোনা হবে, নাকি অগ্রাহ্য করা হবে? 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি তাঁর সদ্য নিযুক্ত ‘বিশেষ দূত’ জেনারেল এরশাদ, যিনি এ মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন, তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক সমীকরণের স্বার্থে আপসরফা চালিয়ে যাবেন? নাকি প্রজ্ঞা জয়ী হবে? অথবা এই নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হবে যে বিচার বিভাগের কাজে নির্বাহী বিভাগ আর হস্তক্ষেপ করবে না। 
শেখ হাসিনা কি এই নতুন তথ্যের ভিত্তিতে একজন হত্যা মামলার সন্দেহভাজনের সঙ্গে রাজনৈতিক আপসরফা বন্ধ করবেন? 
এরশাদ শুধু হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজনই নন, সেনাপ্রধান হিসেবে বহু সেনা কর্মকর্তাকে নির্যাতন করে তাঁদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার ঘটনায়ও তিনি একজন হুকুমের আসামি। এসব স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাঁদের ‘দণ্ডিত’ এবং পরবর্তীকালে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এ ধরনের কাজ একদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের খেলাপ, অন্যদিকে নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক ও অবমাননামূলক আচরণবিরোধী আন্তর্জাতিক রীতি-নীতিরও পরিপন্থী। তদুপরি, এরশাদ সেনাপ্রধান থাকাকালে বেশ কয়েকটি ফিল্ড কোর্ট মার্শালে বিবাদীর অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সবগুলো অপকর্মের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ রয়েছে। 
প্রধানমন্ত্রীকে আমি বহু দিন ধরেই চিনি-জানি। আমার মনে হয় না, তাঁর সব ঔচিত্যবোধের মৃত্যু ঘটেছে। তিনিও হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার হওয়া একজন মানুষের কন্যা। তাঁর নিহত স্বজনদের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পেতে তিনি বহু দিন ধরে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন। মঞ্জুরের সন্তানদের চেয়ে কি তিনি অধিকতর সুবিধাভোগী যে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারী একই রাজনৈতিক শক্তির হাতে মঞ্জুর নিহত হওয়ার পরও তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন না? 
মঞ্জুরের পরিবারও সেই জবাবদিহি দেখতে চায়, যা প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতা, মাতা, ভাই, বোনদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দাবি করেছিলেন। নতুন তথ্যের আলোকে আমরা এই প্রত্যাশা করি যে শেখ হাসিনা তাঁর ‘বিশেষ দূত’-এর কাছ থেকে সরে এসে মঞ্জুরের সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়াবেন; তাদের বলবেন, ‘তোমাদের ন্যায়বিচারের দাবিতে আমি বিপক্ষে নই, বরং পাশে আছি।’ 
শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ দিল্লিতে ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে। তিনি তখন একটি সাদামাটা ঔপনিবেশিক কেতার বাংলোয় বসবাস করতেন। তাঁর নিরাপত্তা ছিল সুনিশ্চিত, তবে গোপন। দুর্বল হলেও তাঁকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন নারী বলেই আমার মনে হলো। তখনো তিনি তাঁর স্বজনদের মৃত্যুর শোক বয়ে চলেছেন। কে-ই বা এর ব্যতিক্রম? তাঁর চোখেমুখে শোক ও আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্ট। ঘরের ভেতর একটি শোকের আবহ সৃষ্টি হলো। প্রায় প্রতিটি কথাতেই তিনি অশ্রুসজল হয়ে উঠছেন। হূদয়বিদারক! ১৯৭৫ সালের ‘অভ্যুত্থানে’র পেছনের ঘটনা উন্মোচন করার জন্য আমি যে বইটি লিখেছিলাম, শেখ হাসিনা তার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান। 
আগস্টের সেই ঘটনার পর অনেকটা দিন চলে গেছে। তবু তাঁর সঙ্গে সেই প্রথম সাক্ষাতে অপরিমেয় সেই শোকের প্রতি আমি আমার সমবেদনা জানাই। তিনি আমার কথা শোনেন। আমি কথা বলার পর তিনি বেশ নীরব ছিলেন। ভাঙা গলায় ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানানোর পর তিনি প্রায় কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। আমরা তখন শোকাবহ স্মৃতি দূরে ঠেলে রেখে চা পান করতে করতে সামান্য কথা বলার চেষ্টা করি। 
ঢাকায় ১৯৭৩-৭৪ সালে একজন তরুণ প্রতিবেদক হিসেবে তখনকার বিক্ষোভ ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমি বেশ সমালোচনামুখর ছিলাম। তার পরও সেই ‘অভ্যুত্থান’ এবং তাতে নিহত নিরীহ মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যে ভূত আবারও জেগে ওঠে, তার খপ্পর থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পথই খোলা ছিল না। পরবর্তী বছরগুলোতে শেখ হাসিনা দৃঢ় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তবেই থেমেছেন। 
কিছুদিন আগে মঞ্জুরের বড় মেয়ে রুবানার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার দিল্লির সেই বৈঠকের কথা মনে পড়ে গেল। আবারও দেখলাম, পিতার মৃত্যু এবং এর পরবর্তী তিনটি দশক ধরে তাঁরা যে অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছেন, সেসব কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলা ভেঙে আসছে। 
সেই আলাপচারিতার কথা বলার স্বাধীনতা আমার নেই। কিন্তু আমি জানি, সেই শোকের গভীরতা যদি অল্প কেউ উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলে শেখ হাসিনাই তা করেছেন। 
শেখ হাসিনা চাইলে তাঁর পিতা-মাতার কবরে যেতে পারেন। সব পিতা-মাতাহীন সন্তানই তা করে থাকেন। তাঁদের শেষ বিশ্রামস্থলে যাওয়া প্রতিটি মানুষের জন্যই এক গভীর সান্ত্বনার বিষয়। এটি আরও বিশেষ হয়ে ওঠে, যদি কেউ সহিংসতার কারণে মারা যান। জেনারেল মঞ্জুরের স্ত্রী ও সন্তানেরা জানেন না, তাঁদের স্বামী ও পিতার আদৌ কোনো কবর আছে কি না। সেখানে গিয়ে তাঁদের প্রার্থনা করার সুযোগটুকুও নেই। 
মৃত্যুর মামলা ও সংশ্লিষ্ট সেই পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষাকে কারোরই রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি বিবেচনাবোধহীন একটি ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করব, দয়া করে আপনার যে পরামর্শকেরা এর বিপরীত কথা ভাবেন, তাঁদের কথা শুনবেন না। 

অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ 
আমি মনে করি, জেনারেল এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা নির্দোষ। তাঁদের বিচার স্বচ্ছ হওয়া উচিত। এর ভিত্তি হবে পেশাদারির ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য-প্রমাণ ও যোগ্য প্রসিকিউশন। 
আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি পবিত্র ব্যাপার। যদিও তথাকথিত সেই চট্টগ্রাম বিদ্রোহের ঘটনায় যে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের এরশাদ নির্যাতন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন, তাঁদের তিনি এ অধিকারের সুযোগ দেননি। কিন্তু যে অধিকার এরশাদ তাঁদের দেননি, ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাঁকে সেই অমূল্য অধিকারটি দিতে হবে। 
মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এমন আরও অনেকে থাকতে পারে, যাদের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি। আমার ধারণা, আমার সাক্ষী যে ব্যক্তির নাম বলেছিলেন, তিনি অভিযোগপত্রে নেই। কথিত আছে, সেই ব্যক্তিই মঞ্জুরকে হত্যা করেন। তিনি একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। মঞ্জুরকে হত্যা করতেই তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন। আবার মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে একমাত্র তিনিই নন, আরও অনেকেই জড়িত থাকতে পারেন। এ অভিযোগ সত্য হলে যে ব্যক্তিটি ট্রিগার চেপেছিলেন, তিনি একাই নিশ্চয়ই সবকিছু করেননি। 
তদুপরি ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী আমার সেই সোর্সই এ ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নন। মঞ্জুরের সেলে সেই ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে অনেকেই প্রবেশ করতে দেখেছেন। তাঁর সেই প্রবেশাধিকারকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ভয়ের কারণে অনেকে গত ৩০ বছরে মুখ খোলেননি। এই ভীতি দূর করার মতো একটি পরিস্থিতি কি সৃষ্টি হয়েছে বা তা কি সৃষ্টি করা সম্ভব? যাঁরা এ হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছেন, এভাবে তাঁদের পার পাওয়ার সময় কি শেষ হবে? 
বড় একটি পরিবর্তনের সময় এসেছে। নিম্ন আদালতে এ মামলাটি যেভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, তাতে ন্যায়বিচারকে প্রহসন করা হয়েছে। আর যাঁরা এটি পরিচালনা করেছেন, তাঁরা নিজের পেশার সঙ্গে গুরুতর অসদাচরণ করেছেন। দুই দশকে ২২ জন বিচারক এ মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। পরে আবার তাঁদের অন্য দায়িত্বে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক ফুটবল হিসেবে মামলাটিকে নিয়ে খেলাধুলা চলছেই। 
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খোলাখুলিই বলা হচ্ছে যে এই মামলাটিকে জেনারেল এরশাদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিনিময়ে এরশাদ সরকারকে তাঁর পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন এই আশায়, যাতে মামলাকে পুরোপুরি হাওয়া করে দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মঞ্জুরের ভূত এরশাদকে তটস্থ করে রেখেছে। এ মামলার সমাপ্তি নেই। 
সম্প্রসারণশীল বাজারে পণ্যের মূল নির্ধারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার যা মার খেয়েছে, তা হলো নৈতিকতা। আর এই পণ্য হচ্ছে ন্যায়বিচার। এর বিকিকিনি হয়েছে বন্ধ দরজার অন্তরালে। বাংলাদেশে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানই এই পণ্যের বাজার বন্ধ করে দিতে পারে, সেটি হলো সুপ্রিম কোর্ট। 
‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট’ হলে সুপ্রিম কোর্ট যেকোনো মামলাকে নিম্ন আদালত থেকে তাঁর ক্ষমতাবলে সরিয়ে নিতে পারেন। এই মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই মামলার মধ্যে বাংলাদেশে এক দশকের সামরিক শাসনের বীজ নিহিত রয়েছে। মঞ্জুরের হত্যকাণ্ড সেই বীজের প্রাণকেন্দ্র। এই মামলাটি যদি ‘জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট’ মামলার আওতায় না পড়ে, তাহলে আর কোন মামলা পড়তে পারে, তা আমি জানি না। হয়তো অন্য কোনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড রয়েছে। 
তাদের পিতা ‘খুনি’ ও ‘বিশ্বাসঘাতক’—এই অশেষ কানাকানিতে চারটি সন্তান বাংলাদেশ ছেড়েছে। এই ফিসফিস তাদের প্রতিনিয়ত আহত করেছে। এটি তাদের স্কুলে তাড়া করে ফিরেছে। যে বাসায় তারা গেছে, সেখানে তাড়া করেছে। তাদের অনেক পুরোনো বন্ধুও এ কারণে তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। 
বাংলাদেশ কীভাবে ‘মিথ্যার ভাইরাস’-এ আক্রান্ত হয়েছে, তা সত্যিই খতিয়ে দেখার মতো বিষয়। কিন্তু এই মিথ্যার বলি হয়েছে এক নির্দোষ মানুষের সন্তানেরা। তাদের পিতাকে যথাযথভাবে সমাধিস্থ করার অধিকার তাদের দিতে হবে। এরপর বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে যাপন করার জন্য যে দেশে তাদের ঘর, সেখানে তাদের প্রত্যাবর্তন করতে দিতে হবে। 
মঞ্জুরের আসল ‘অপরাধ’, সামরিক শাসনের পাঁয়তারা করা ক্ষমতামদমত্ত কিছু মানুষের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। আসলে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন স্বল্পসংখ্যক গণতন্ত্রমনা ‘সংবিধানপন্থী’দের একজন, যেমন ছিলেন জেনারেল মইনও, যাঁরা কখনোই আইয়ুব খানের বাংলাদেশি কোনো সংস্করণকেই বঙ্গভবনের মসনদে আসীন দেখতে চাননি, তা সে জিয়া বা এরশাদ যে নামেই হোক না কেন। উপরন্তু তাঁরা ছিলেন ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলের উত্থানের বিরোধী। এটা কি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য অভিশাপ হয়ে ওঠেনি? পাকিস্তানের জন্যও কি এটা এখনো অভিশাপ নয়? এ দুই ব্যক্তি দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। তাঁরা গণতান্ত্রিক দেশে পেশাদার সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিলেন। 
পরিশেষে, মঞ্জুরের বিধবা স্ত্রী মার্কিন মুলুক থেকে কখনোই দেশে ফিরতে চান না। কারণ, কখনোই তিনি ন্যায়বিচার পাবেন বলে মনে করেন না। তাঁর স্বামীকে হত্যাকারী পার পেয়ে গেছে। সাক্ষ্য-প্রমাণও তা-ই বলে। 
হয়তো আরেকটি পথ খোলা আছে। সে পথ গিয়ে ঠেকেছে সুপ্রিম কোর্টে। মঞ্জুরের ভাই বা তাঁর সন্তানেরা আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে নিম্ন আদালতের অন্তহীন জাল থেকে মামলাটি বের করে আনার আবেদন করলে, তা অনুমোদন করা উচিত। গত ২০ বছরে এই মামলাটি সেখানে আশা-প্রত্যাশাহীনভাবে মাটিচাপা পড়েছে। 
তাহেরের মামলায় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি জাকির হোসেন অনন্য নজির স্থাপন করে দেখিয়েছেন যে ঘটনার বহু বছর পরও কীভাবে একটি মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব। তাঁরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে জটিল বিষয়গুলোর তদন্ত ও সাক্ষী নির্বাচন করে তাঁদের আদালতের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। 
প্রয়োগ করার মতো বিপুল ক্ষমতা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের হাতে রয়েছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য জরুরি মনে করলে আদালত তা করে থাকেন। তাহের ও মঞ্জুর হত্যা মামলা এক রকম নয়। 
তাহেরের বিচার সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু বলা হয়েছে, সেটি ছিল অবৈধ ও অসাংবিধানিক। উপরন্তু সেই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের বিধান সুনির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছিল। আদালত মত দিয়েছিলেন, সেই বিচারটি নিজেই ছিল একটি অপরাধ। সেটি ছিল একটি অবৈধ বিচারপ্রক্রিয়া। সে কারণে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ছিল হত্যাকাণ্ডের সমতুল্য। 
মঞ্জুরের ক্ষেত্রে বিষয়টি তা নয়। এটি এখনো একটি চলমান বিচারপ্রক্রিয়া। ২০ বছর চলার পরও এখনো পর্যন্ত এ মামলায় কোনো রায় দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের অসামান্য এক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক ১৯৯০-এর দশকের প্রথম ও মধ্যভাগে এ মামলার এক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তপ্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুর পর সেসবের আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। 
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের মতো মানুষদের সাক্ষ্য সবে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। এটি যে সম্ভব হয়েছে, তার পেছনে আছে সেই সময়ে আমিনুল হকের অভিভাবকসুলভ সতর্ক পদক্ষেপ। সর্বোচ্চ আদালতের হাতে এই মামলার সূত্রগুলো একত্র করে জেনারেল আবুল মঞ্জুরের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা আছে। 
মঞ্জুর হত্যা মামলা বাংলাদেশের বিবেককে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এটা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়। 

‘জেনারেল এরশাদ, আমি কি জানতে পারি, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন?’ 
এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের সাক্ষ্য 
মঞ্জুর হত্যা মামলায় ২৫ মার্চ ১৯৯৫ সিআইডিকে দেওয়া জবানবন্দির চুম্বক অংশ 

‘তাঁরা আমাকে বলেন যে এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে [জিয়া হত্যাকাণ্ডে] ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে’ 
৩১ মে ১৯৮১ 
আমি এয়ার ভাইস মার্শাল সদরউদ্দীন (অব.), সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান।...সকাল আনুমানিক সাড়ে সাতটার সময় আমাকে জানানো হয় যে জেনারেল এরশাদ টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি টেলিফোন ধরি। জেনারেল এরশাদ আমাকে আগের রাত্রে চিটাগাং সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার সংবাদ দেন এবং দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করেন। আমি কিছুক্ষণ পর ঢাকার উদ্দেশে হেলিকপ্টারযোগে রওনা হই এবং আনুমানিক ১০টার সময় ঢাকায় ফিরে আসি। 
আমি সরাসরি আর্মি হেডকোয়ার্টারে সেনাপ্রধানের অফিসে যাই। আমি তাঁর অফিসে গিয়ে বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন আর্মি অফিসারকে তাঁর অফিসে দেখি। তাঁদের মধ্যে মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর জেনারেল মান্নাফ, মেজর জেনারেল নূরউদ্দীনসহ অন্য আরও কিছু আর্মি অফিসারকে দেখি। সেখানে তাঁরা চিটাগাংয়ে প্রেসিডেন্ট নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। জেনারেল এরশাদ আমাকে ঘটনা দ্রুত জানালেন। আমি সেখানে আনুমানিক ২০ মিনিট ছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে আসার পথে মেজর জেনারেল শওকত ও মেজর জেনারেল মইন আমার পেছনে পেছনে আসেন। আসার পথে করিডরে তাঁরা আমাকে বলেন যে এখানে মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ফাঁসানোর একটা পরিকল্পনা চলছে। 
...... 

‘স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয়’ 
১ জুন ১৯৮১ 
বিকেল আনুমানিক সাড়ে পাঁচটার সময় আমি বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির [বিচারপতি আবদুস সাত্তার] অফিসে ছিলাম। তখন সেখানে লে. জেনারেল এরশাদও ছিলেন। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। এই সময় টেলিফোন আসে। প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট টেলিফোন রেখে জানান, আইজিপি কিবরিয়া জানিয়েছেন যে মেজর জেনারেল মঞ্জুর এবং অন্যরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। 
সংবাদটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে জেনারেল এরশাদ উত্তেজিত অবস্থায় চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। আর কিছু না বলে সরাসরি প্রেসিডেন্টের পাশে রেড টেলিফোনের কাছে যান এবং একটি নাম্বারে ডায়াল করেন। টেলিফোনে তাঁর যে কথাটি শুনতে পেলাম তা হলো, ‘মঞ্জুরকে পুলিশ আটক করেছে। এক্ষুনি তাঁকে নিয়ে নাও। তারপর পরিকল্পনামতো কাজ করো।’ বলেই তিনি টেলিফোন রেখে দেন। 
তখন আমি বলি, ‘জেনারেল এরশাদ, আপনি কোন পরিকল্পনার কথা বলছেন, আমি কি জানতে পারি?’ এতে তিনি আবার বেশ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এয়ার চিফ, আপনি কিছুই বোঝেন না।’ আমি বলি, ‘আমি কী বুঝি না বুঝি, আপনার কাছ থেকে জানতে হবে না।’ 
পরে আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে বলি, ‘স্যার, দয়া করে নিশ্চিত করুন, যাতে মঞ্জুরের কিছু না হয় আর তিনি ন্যায্য বিচার পান। মঞ্জুরের কিছু হলে জাতির কাছে আপনাকে জবাব দিতে হবে।’ এর উত্তরে সাত্তার সাহেব বিচার করা হবে বলে জানান। 
...... 

‘আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন’ 
২ জুন ১৯৮১ 
ভোর রাত্রি আনুমানিক দেড়টা-দুইটার দিকে উইং কমান্ডার কামাল, ডিরেক্টর, এয়ার ইন্টেলিজেন্স, টেলিফোনে মেজর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যার খবর দেন। আমি সকাল আনুমানিক ছয়টা-সাতটার সময় এরশাদ সাহেবকে টেলিফোনে বলি, ‘এরশাদ সাহেব, আপনারা জেনারেল মঞ্জুরকে মেরে ফেললেন।’ (শেষ) 

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন 

লরেন্স লিফশুলৎজ 
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর (হংকং) দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি দ্য গার্ডিয়ান, লে মঁদ দিপ্লোমাতিক, দ্য নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসির পক্ষে লিখেছেন। তিনি বেশ কিছু বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন; এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ: দি আনফিনিশ্ড্ রেভল্যুশন, হিরোশিমা’জ শ্যাডো ও হোয়াই বসনিয়া? 
OpenDoor.Lifschultz@gmail.com
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:৪৬
৪৫৬ বার পঠিত১০ ০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আপনার মন্তব্য লিখুন













একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

নবীনতর পূর্বতন