পাকিস্তানের খ্যাতিমান ২৬ জন আলেম ভারতের তাবলিগের প্রধান মারকাজ নিজামুদ্দিন, পাকিস্তানের মারকাজ রায়েবেন্ড ও বাংলাদেশের মারকাজ কাকরাইলের মুরব্বিদের প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ চিঠি পাঠিয়েছেন।
গতকাল রোববার পাকিস্তানের শীর্ষ আলেমদের স্বাক্ষরিত এ চিঠি তিনটি মারকাজে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানা যায়।
চিঠিতে লেখা রয়েছেঃ-
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
এ চিঠি আমরা তাবলিগের মুরব্বি হজরতদের নিকট হৃদয়ে অত্যন্ত দরদ ও ভালোবাসা নিয়ে লিখছি। আলহামদুলিল্লাহ বিশ্বব্যাপী তাবলিগের মেহনতের মাধ্যমে দীনের অনেক বড় কাজ হয়েছে, হচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ আজ তাবলিগের মেহনতের কারণে দীনের নুর তাদের হৃদয়ে পৌঁছেছে। এক নতুন বিপ্লবের সন্ধান পেয়েছে।
তাবলিগের বড় বড় ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত আমরা এ কাজ শুধু করেই যাচ্ছি না, সাধারণ মানুষ ও আহলে ইলমদেরকেও এ মেহনতের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ মেহনতের সঙ্গে সর্বক্ষণ যুক্ত থাকার চেষ্টা করছি।
কিন্তু বিগত দিনে তাবলিগে যে সব ফাটল তৈরি হয়েছে, যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে, দেখতে দেখতে তাবলিগ দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে, এর কারণে আমরা কঠিনভাবে চিন্তিত। তাবলিগ জামাত এ কারণে আজ গোটা বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশে সম্প্রতি যে দুঃখজনক ও লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে, এতে করে আমাদের তাবলিগ নিয়ে শঙ্কা আরো বেড়ে গিয়েছে। কখনো কল্পনাও করতে পারিনি, দীনদারগণ এভাবে দু’দলে বিভক্ত হয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটাবে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
এখন আমরা পাকিস্তানের আলেমগণ ‘আদদিন আন্নাসিহা’ এর উপর আমল করে তাবলিগের বর্তমান দুটি গ্রুপের মুরব্বিদের প্রতি আমাদের আবেদন, আল্লাহ ও তার রাসুল সা. এর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাবলিগের এ বিভক্তি যে কোনো মূল্যে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন।
আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী এ বিভক্তি নিরসের পদ্ধতি এভাবে হতে পারে, তাবলিগের উভয় দলের মুরব্বিগণ সব মত আর দাবিগুলোকে এক পাশে রেখে আমরা একটি জায়গায় বসি। এক ও নেক হতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। তাহলেই এর সমাধান সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি।
হজরত হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি রহ. বলেন, ঐক্যবদ্ধ হতে মৌলিকভাবে দু’টি জিনিস দরকার। এক. ইসার- একে অপরকে প্রধান্য দেয়া। দুই. তাওয়াজু- বিনয়, নম্রতা। আর সততা একনিষ্ঠতা সব কাজের মূল। আমরা মনে করি এ তিনটি গুন হৃদয়ে রেখে খোলামেলা আলোচনা করলে আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।
আমাদের কাছে তাবলিগের জন্য আমির ও মাশওয়ারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমির ও শুরা সদস্য নির্বাচনও মাশওয়ারা বা পরামর্শমত করা উচিত। শরিয়তের এ মূলনীতিগুলো সামনে রেখে তাবলিগের উভয় দল একনিষ্ঠতা, একে অপরকে প্রধান্য দেয়া, বিনয় ও নম্রতার মাধ্যমে যদি ফায়সালা করতে চায় তাহলে আল্লাহর মেহেরবানিতে ঐক্যের পথ অবশ্যই বের হয়ে আসবে।
এ ঐক্যের পথে আমাদের কোনো সাহায্য-সহযোগিতার যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা মন-প্রাণ দিয়ে আমরা চেষ্টা করবো।
এ মজলিসে আমাদের এ কথা সামনে রেখে এগুতে হবে, যদি আমাদের জীবন দিয়ে হলেও ঐক্য সম্ভব হয়, তাহলে আমরা সেটাই করবো। আর যদি উভয় দল নিজেরদের জেদে অটল থাকে তাহলে মনে রাখতে হবে, তাবলিগের মাধ্যমে এ পর্যন্ত উম্মতের যে লাভ হয়েছে এ অনৈক্য এর চেয়ে বেশি উম্মতের ক্ষতি করবে। সামনে আমাদের কোনো পথও আর খোলা থাকবে না। তাবলিগের কঠিন দুর্দিনেরও আশংকা দেখ দিবে এতে।
অমাাদের মূল আবেদন হলো ইখলাস, ইসার, লিল্লাহিয়্যত ও তাওয়াজুর ভিত্তিতে উভয় দল সংকট নিরসনে অবশ্যই কোনো না কোনো রাস্তা বের করবেন। কিন্তু যতক্ষণ না উভয় দলের কোনো সমন্বয় না হয়, আমরা আশা করবো উভয় দল তাদের নিজেদের জায়গায় নিজেদের মত করে দীনের কাজ করে যাবে। এক দল অন্য দলের রাস্তায় বিরোধ করতে যাবে না।
উভয় দলের মুরব্বিদের প্রতি আমাদের আবেদন তারা যেনো তাদের অনুসারিদের খুব গুরুত্বের সঙ্গে এ কথা বলে দেয়, তারা অন্য দলের সম্পর্কে দোয়া ছাড়া আর কোনো মন্তব্য না করে। বিশেষ করে ঝগড়া সৃষ্টি করে এমন কোনো কথা বা আলোচনা যেনো তারা না করে।
কোনো জায়গায় যদি কোনো দলের আধিক্য বেশি হয়, বা তাদের মারকাজ নির্মাণ করে সেখানে অন্য দল জোড় করে ঢুকতে চেষ্টা থেকে বিরত থাকবে। আর যদি এমনই বিরোধ চলতে থাকে তাহলে দাওয়াতের মেহনত পৃথিবীর মানুষের কাছে জঘণ্যতম হয়ে ওঠবে।
মানুষ হেদায়াতের দিকে আসবেই না বরং এর মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে ঘৃণা সৃষ্টি হবে। আর আমাদের ঐক্য নষ্ট করে ইসলামকে মিটিয়ে দিতেই চায় ইসলাম বিদ্বেষীরা।
প্রিয় মুরব্বিয়ে দীন, দয়া করে আমাদের আবেদনগুলো দীনের হেদায়ত ও ইসলামের উদারতা দিয়ে চিন্তা করে দেখবেন। দয়া করে উম্মতের এ টালমাটাল কাসতি আরো ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবেন না। আল্লাহর দিকে তাকিয়ে উম্মত এ কঠিন অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করবেন।
আমরা পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম বিশ্বের আলেমদের কাছেও আবেদন করছি আপনারা এমন বয়ান থেকে বিরত থাকুন, যাতে দু’দলের কোনো দলের পক্ষে যায়। আপনারা নির্দলীয় অবস্থায় থাকলে আশা করা যায় খুব দ্রুত এ সমস্যা থেকে আমাদের উত্তরণ সম্ভব হবে।দারুল উলুম করাচি মাদরাসায় আলেমদের এ বৈঠকে যে ২৬ জন আলেম উপস্থিত ছিলেন, চিঠিতে তাদের স্বাক্ষরও ছিলো-
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন-
১.মুফতি রফি উসমানি, মুহতামিম, দারুল উলুম করাচি
২.মুফতি তাকি উসমানি, নায়েবে মুহতামিম, দারুল উলুম করাচি
৩.মাওলানা আনোয়ারুল হক, মুহতামিম, দারুল উলুম হক্কানিয়া
৪.মাওলানা ফজলুর রহিম, মুহতামিম, লাহোর জামিয়া আশরাফিয়া
৫.মাওলানা জাহেদ রাশদি, মুহতামিম, জামিয়া নাসরাতুল উলুম
৬.মাওলানা মুফতি গোলামুর রহমান মুহতামিম, পেশোয়ার জামিয়া উসমানিয়া
৭.মুফতি আবদুর রহিম, মুহতামিম, জামিয়াতুর রশিদ
৮.মাওলানা হাকিম মুহাম্মদ মাজহার, মুহতামিম, করাচি আশরাফুল মাদারিস
৯.মাওলান তাইয়্যেব, মুহতামিম, জামিয়া ইমদাদিয়া ফয়সালাবাদ
১০.মাওলানা ড. আদেল, মুহতামিম, জামিয়া ফারুকিয়া করাচি
১১.মাওলানা কাজি আবদুর রশিদ, মুহতামিম, জামিয়া ফারুকিয়া রাওয়েলপিন্ডি
১২.মাওলানা মেহেরুল্লাহ
১৩.মাওলানা তানভিরুল হক, মুহতামিম, জামিয়া উহতেশামিয়া
১৪.মাওলানা এমদাদুল্লাহ, মুহাদ্দিস, জামিয়াতুল উলুমুল ইসলামিয়া, করাচি।
১৫.মুফতি মাহমুদ আশরাফ উসমানি, মুহাদ্দিস, জামিয়া দারুল উলুম করাচি।
১৬.মাওলানা আজিজুর রহমান, মুহাদ্দিস, দারুল উলুম করাচি।
১৭.মাওলানা রাহাত আলি হাশেমি, নাজেমে তালিমাত, দারুল উলুম করাচি।
১৮.মুফতি মুহাম্মদ, মুহাদ্দিস, জামিয়াতুর রশিদ
১৯.মাওলানা দাউদ, শাইখুল হাদিস, জামিয়া এমদাদিয়া কোয়েটা।
২০.মাওলানা ড. জুবায়ের আহমদ উসমানি, মুহাদ্দিস, দারুল উলুম করাচি।
২১.মাওলানা ইমরান আশরাফ উসমানি, মুহাদ্দিস, দারুল উলুম করাচি।
২২.মাওলানা তাহের মাসউদ, মুহাম্মদ, জামিয়া মিফতাহুল উলুম, সারগোদাহ।
২৩.মাওলানা খালেদ আব্বাসি, শিক্ষক, জামিয়া মিফতাহুল উলুম সারগোদাহ।
২৪.মাওলানা মুহাম্মদ নোমান, শিক্ষক জামিয়া বিন্নুরিয়া করাচি।
২৫.মাওলানা হাসান আশরাফ উসমানি, শিক্ষক, মুহাদ্দিস, দারুল উলুম করাচি
২৬.মাওলানা সালমানুল হক, শিক্ষক জামিয়া হক্কানিয়া।
এ বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহিত হয়।
- ১. অল্প দিনের মধ্যেই তাবলিগের মুরব্বিদের নিকট চিঠি পাঠানো হবে।
- ২. উলামায়ে কেরামের বৈঠকে নির্ধারিত কমিটির সদস্যগণ তাবলিগের দুই গ্রুপের মুরব্বিদের সঙ্গে দেখা করে উভয় গ্রুপের দাবিগুলো শুনে সে অনুযায়ী পরামর্শ করে চলমান দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা করবেন।
- ৩. উভয় দলকে নিয়ে একদিন এক জায়গায় বসার জন্য সময় নির্ধারণ করবে।